মুরাদুল ইসলাম » গল্প » গল্পঃ রহমান সাহেব ও আশরাফ মৃধা

গল্পঃ রহমান সাহেব ও আশরাফ মৃধা

জুলাই, ২০১৪ তে লেখা গল্প।

norokhadok

রহমান সাহেব ট্রেনিং এ এসেছেন। এক মফস্বল শহরে। অফিস থেকেই একটা হোটেল ভাড়া করা হয়েছে। এখানে একা একা থাকতে থাকতে রহমান সাহেব বেশ হাঁপিয়ে উঠেছেন। তিনি যে খুব মানুষের সঙ্গ পছন্দ করেন তা না। কিন্তু একেবারে একা থাকাটাও তার বিশেষ ভালো লাগে না।

এই হোটেলে আরো যারা থাকেন তারা সবাই ব্যস্ত লোক। কারো সাথেই এই এক সপ্তাহের মধ্যে রহমান সাহেবের কথা হয় নি। তাই একটু মনমরা হয়ে বিকেলের দিকে পত্রিকা নিয়ে হোটেলের সামনের বাগানে বসেছিলেন তিনি। কাছের একটি জারুল গাছে কয়েকটি পাখিকে দেখছিলেন উদাসভাবে।

এমন সময় একটি ভারী কন্ঠ বলল, “আপনি কি এখানেই উঠেছেন?”

রহমান সাহেব তাকিয়ে দেখলেন একজন মধ্যবয়স্ক লোক তাকে প্রশ্নটি করেছেন।  তিনি বেশ খুশি হয়ে জবাব দিলেন, “হ্যা। আপনি?”

লোকটি বলল, “আমি আশরাফ মৃধা। এই হোটেলের কাছে যে বড় বাড়িটা দেখছেন ওটা আমার বাড়ি। বারান্দা থেকে দেখলাম আপনি মনমরা হয়ে বসে আছেন। তাই কথাবার্তা বলতে আসলাম।”

রহমান সাহেব বললেন, “ভালো করেছেন। আমি আসলে একজন কথা বলার মানুষ খুঁজছিলাম। চলুন ভিতরে গিয়ে চা খেতে খেতে কথা বলা যাবে।”

আশরাফ মৃধা মাথা নেড়ে বললেন, “না ভাইসাহেব। আমি ঘরের বাইরে হোটেল রেস্টুরেন্ট, চায়ের দোকান কোথাও কিছু খাই না।”

রহমান সাহেব হেসে বললেন, “আপনি তো বেশ স্বাস্থ্য সচেতন।”

আশরাফ মৃধা গম্ভীর হয়ে বললেন, “স্বাস্থ্য সচেতন…তা বলতে পারেন। কিন্তু আমি আসলে সম্পূর্ন ভিন্ন একটা কারণে বাইরে কোন কিছু খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।”

রহমান সাহেব বললেন, “কারণটা কি জানতে পারি?”

আশরাফ মৃধা বললেন, “পারেন। সেজন্য আমার বাসায় চলুন। চা খেতে খেতে আপনাকে পুরো গল্পটা বলা যাবে।”

রহমান সাহেব গল্প শুনতে আশরাফ মৃধার বাড়িতে গেলেন। প্রকান্ড বাড়ি মৃধা সাহেবের। তার বারান্দায় দুটি চেয়ারে তারা দুজন বসলেন। আশরাফ মৃধা কাজের লোকটিকে দু কাপ চা দিতে বললেন। মিনিট দুয়েকের মধ্যে চা চলে এল। সেই চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আশরাফ মৃধা তার গল্পটি শুরু করলেন…

“বুঝলেন আমার যে বাড়ি গাড়ি দেখছেন এক সময় এর কিছুই ছিল না। আমি ছিলাম সামান্য এক বেকার যুবক। অল্প বিস্তর শিক্ষা দীক্ষা ছিল। তাই একটি মাঝারি মানের চাকরি পেয়ে গেলাম। তখন ওটাই ছিল আমার কাছে অনেক বড়। পোস্টিং ছিল একটা শহরে। এই মফস্বলের মত ছোট শহর।”

আশরাফ মৃধা একটু থেমে বললেন, “একটু দাড়ান। আমার কাছে পুরো গল্পটা লেখা আছে। ওটা পড়ে যাই। না হলে অনেক কিছু মিস করে ফেলতে পারি। ইদানীং স্মৃতি বেশ প্রতারণা করা শুরু করেছে।”

আশরাফ মৃধা পকেট থেকে একখানা কাগজ বের করে পড়তে শুরু করলেন…

নতুন শহরে এসেছি। কিছুই চেনাজানা নেই। এরকম গ্রামের মত শহর খুব কম দেখা যায়। চাকরির খাতিরে আসা। কে জানে কতদিন থাকতে হয়। তবে আমার বেশিদিন থাকার ইচ্ছা নেই একেবারেই। খুব বেশি হলে মাস দুয়েক। এই মাস দুয়েক থাকতেই হবে আসলে। এর আগে ট্রান্সফারের কোন নিয়ম নেই। তাই এখানে এসে বিরক্ত লাগছে খুব।

এখানে এসে একটা ঘর ভাড়া নিয়েছি। বাড়িওয়ালা বেশ অমায়িক। খুব খাতির করেছে। কিন্তু ঘরে ঢোকে এই ভাল ব্যবহারের রহস্য বুঝতে পারছি কিছুটা। দেখেই মনে হচ্ছে এই রুমে বছর খানেক কেউ থাকে নি। মাকড়শার জালে ভরে আছে।

বাড়িওয়ালা ঘরের দরজা খোলে দিতে দিতে হেসে হেসে বলেছে, বাবাজী, ঘরখানা খাসা! তবে আমি একা মানুষ। যত্ন আত্তি করতে পারি না। তাই একটু আধটু অপরিস্কার হয়ে আছে। এগুলো তুমিই পরিস্কার করে নিতে পারবে।

আমাকেই পরিস্কার করে নিতে হয়েছে। কাজের লোক নাকী এই এলাকায় পাওয়া যায় না। ঘর পরিস্কার করতে করতে চারটে বেজে গেল। খিদে পেয়েছে খুব। তাই হাতমুখ ধুয়ে কিছু খেতে বের হলাম। একটা সুবিধা আছে এখানে থাকার। মেইন রোডের সাথেই ঘর। খাওয়া, সিগারেট ইত্যাদির জন্য দীর্ঘ ভ্রমণের দরকার হবে না।

দরজা বন্ধ করে বাইরে বের হলাম। বারান্দায় বাড়িওয়ালা বেতের একটা চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে পত্রিকা পড়ছিল। আমাকে বেরোতে দেখে বলল, বাবাজী, সন্ধ্যার আগে ফিরে আসবেন। অন্ধকার নেমে এলে পথ ভুল করতে পারেন। নতুন জায়গা। তার উপর কাছেই শশ্মান।

আমি বললাম, ঠিক আছে।

রাস্তায় যখন হাটছিলাম তখন মনে হচ্ছিল বুড়ো শশ্মানের কথা কী যেন বলল। জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল।

দুই মিনিট হাটতেই একটা হোটেল চোখে পড়ল। দি নিউ রেস্তোরা। আমি এর ভিতরেই ঢুকে পড়লাম। ঢুকেই তো চক্ষুস্থির। চারদিক ঝকঝক করছে এমন পরিস্কার। এ আমার কল্পণাতেই ছিল না। আমার কিছুটা শুচিবাই আছে। অপরিস্কার জিনিস সহ্য করতে পারি না। এ হোটেলের ভিতরটা দেখে আসলেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আরো অবাক হয়ে দেখলাম পরিবেশনকারী থেকে শুরু করে সবাই পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে খুব সচেতন। দেখছিলাম আর ভাবছিলাম আমাদের সব বড় শহরের রেস্টুরেন্টগুলোর জন্য এই হোটেল আদর্শ হওয়া উচিত।

আমি দাঁড়িয়ে আছি দেখে একজন ওয়েটার এসে বলল, স্যার, বসে পড়ুন। লাঞ্চ করবেন?

আমি বললাম, হ্যা।

ওয়েটার বলল, আমাদের এখানে ভাত ছাড়া কিছু নেই।

আমি বললাম, তাই দেন। সমস্যা নেই।

আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ছেলেটি চলে গেল। আর এর দু মিনিট পড় গরম ভাত এবং কুচি কুচি করে কাটা এক ধরনের মাংস নিয়ে হাজির হল। মাংসের উপর ছিটানো ধনেপাতা। কড়া স্বাদের গন্ধ বের হচ্ছে। এই গন্ধে খিদে বেড়ে যাচ্ছে কয়েকশ গুণ।

ভাবলাম ভালো জিনিস এনেছে তো। হতে পারে এটা এই এলাকার বিখ্যাত খাবার। এলাকা অনুযায়ী কিছু খাবার বিখ্যাত হয়। আমি খেতে শুরু করলাম। খাবার আসলেই ভালো। এমন ভালো রান্না করা খাবার অনেক দিন খাই নি মনে হল।

খাওয়ার মাঝখানে অয়েটার কে ডেকে বললাম, এই যে খাচ্ছি, না বলে এনে দিলে, এগুলোর দাম কত? আমাকে আবার বিপদে ফেলবে না তো!

ছেলেটি হেসে বলল, কি যে বলেন স্যার। আপনি খাচ্ছেন তাই তো অনেক। সব মিলিয়ে দাম পঞ্চাশ টাকাও হবে না।

আমি আবার অবাক হলাম। বললাম, বলো কি! পঞ্চাশ টাকাও হয় নি? তাহলে আরেক প্লেট নিয়ে আসো তো।

ছেলেটি আরেক প্লেট নিয়ে এল। কুচি কুচি করে কাটা মাংস, ধনেপাতা ছিটানো। এর উপর দিয়ে ধোঁয়া উড়ছে।

পুরো প্লেট ঢেলে নিয়ে আমি খেতে শুরু করলাম। নরম মাংস। আচ্ছা এটা কি খাসির মাংস? খাসির মাংস কি এত নরম হয়! গরুর হবে না অবশ্যই। তবে গরুর মগজের মত। কিন্তু মগজ না, দেখা যাচ্ছে মাংসের আঁশ। হালকা হাড়ও আছে। তরুণাস্থি। খেতে মৃদু শব্দ হয়। মধুর শব্দ। কোন জাতের পাখি বা হাঁসের মাংস হবে মনে হয়। ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

কিন্তু ছেলেটা এল না বেশ কিছুক্ষণ। আমার খাওয়া শেষ হল। হাত ধুয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুললাম। সেই সময়ে ছেলেটি প্লেটগুলো নিতে এল। আমাকে দেখে এক গাল হাসল।

আমিও প্রশান্তির হাসি দিয়ে বললাম, কীসের মাংস খাওয়ালে এটা? তোমাদের বাবুর্চী ভালো পাক জানে। একেবারে অসাধারণ।

ছেলেটি অমায়িক ভঙিতে হেসে বলল, জি স্যার। তবে এগুলো তো খায় না কেউ। আপনারা যে ক’জন খান তাদের জন্যই রান্না হয় আসলে। এই জন্য আমাদের বাবুর্চী অনেক দুঃখ করে বলেন, তার সেরা রান্না লোকে খায় না।

আমি প্রশ্ন করলাম, খায় না কেনো? এ তো চমৎকার রান্না!

ছেলেটি হতাশ মুখে বলল, কিন্তু মানুষেরা যে স্যার ব্যাকডেটেড। তারা মনে করে অন্য মানুষের মাংস খাওয়া ঠিক না। কিন্তু স্যার রান্না করলে ত সবই এক! ঠিক না বলেন? এই যে যাকে খেলেন, ইনি খুব সুদর্শন ছিলেন। এক বছর আগে আপনার মতই এসেছিলেন আর উঠেছিলেন রাস্তার পাশের ওই ছোট একতলা বাড়িটার একটা রুমে। প্রথম রাতেই যখন উনি মারা যান ভয়ে তখন উনাকে কেটে আমরা ফ্রীজে রেখে দেই। তরতাজা লোক ছিলেন। তাই মাংস বেশ নরম। চর্বিও ছিল অনেক।

ছেলেটি কথা বলতে বলতে ব্যস্তভাবে প্লেট নিয়ে চলে যায়।

আর আমি ছুটে সেই হোটেল থেকে বেরিয়ে আসি। আমার মাথা ঘুরছিল। পেটের ভেতর যেন শুরু হয়েছিল ভুমিকম্প। যা খেয়েছি সব গলা দিয়ে ছুটে বের হয়ে আসতে চাইছে। আমি কিছুদূর গিয়ে বমি করতে করতে মাথা ঘুরে পড়ে যাই।

এরপর আমার কিছু মনে নেই।

জ্ঞান ফিরলে দেখতে পাই একটা হাসপাতালে। আর তার পরদিন আমি সেই শহর ত্যাগ করে বাড়ি ফিরে আসি।

বাড়ি ফেরার পরও ছয়মাস অসুস্থ ছিলাম। সুস্থ হবার পর একটু খোঁজ করার চেষ্টা করেছিলাম যেখানে আমাকে বদলি করা হয়েছিল ওখানকার ব্যাপারটা সম্পর্কে ঠিকমত জানার। অফিসে যোগাযোগ করলে অফিস থেকে জানানো হল, যেখানে বদলি করা হয়েছিল সেখানে আমি যাই ই নি। তখন আমি বুঝতে পারলাম মাঝপথে অন্য কোথাও নেমে গিয়েছিলাম ভুল করে। তবে সে জায়গাটা যে ঠিক কোন জায়গা তা এখনো বের করতে পারি নি।

তবে সে ঘটনা ভুলতে পারি না। তাই এখনো কোন হোটেল বা রেস্টুরেন্ট দেখলে আৎঁকে উঠি। পাশ দিয়ে গেলে ভেতর থেকে বমি ছুটে বেরিয়ে আসতে চায়। তাই কোন দিন বাইরে কিছু খাওয়ার প্রশ্নই উঠে না।

গল্প শেষ হলে রহমান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “সত্যি আপনি মানুষের মাংস খেয়েছিলেন?”

আশরাম মৃধা মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যা। বলতে খারাপ লাগলেও সতি যে ওরকম সুস্বাদু মাংস আমি আর কোনদিন খাই নি। এখনো স্বাদ জিভে লেগে আছে।”

রহমান সাহেবের মনে হল তিনি কোন পাগলের পাল্লায় পড়েছেন। মানুষের মাংস খাওয়া! তাও কি সম্ভব!

তিনি ভাবলেন আর কথা বাড়য়ে লাভ নেই। সন্ধ্যা হবো হবো করছে। এখান থেকে উঠতে হবে।

রহমান সাহেব বললেন, “আচ্ছা, তাহলে আজ উঠি।”

তিনি উঠে পড়লেন।

আশরাফ মৃধা মৃদু মৃদু হেসে ভারী কন্ঠে বললেন, “ভয় পেলেন নাকী?”

রহমান সাহেব এই প্রশ্নে সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। ইতস্তত করে বললেন, “না। ভয় পাব কেন? আপনি তো আর ইচ্ছে করে খান নি!”

আশরাফ মৃধা মাথা নেড়ে বললেন, “একেবারে ঠিক বলেছেন। ইচ্ছে করে খাই নি। কিন্তু খেয়ে লাভই হয়েছে। এই যে বিত্ত বৈভব দেখছেন সব কিন্তু হয়েছে ঐ মাংস খাওয়ার ফলে।”

রহমান সাহেব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “মানে?”

আশরাফ মৃধা একটু ঝুকে এসে বললেন, “যে লোকটাকে খেয়েছিলাম তার অর্থভাগ্য ছিল চমৎকার। বিরাট পয়সাওয়ালা লোক ছিল। তার মাংস খাওয়ার পর তার মত অর্থবুদ্ধি আমার হয়ে গেল। চাকরি ছেড়ে তাই ব্যবসায় নামলাম আর কাড়ি কাড়ি টাকা কামাতে লাগলাম। তাই আপনাকে বলি, মাংস খেতে হলে পয়সাওয়ালার মাংস খাবেন। খেতেও টেস্ট আর ফলও ভাল। পয়সাহীনদের মাংস খেলে মজা পাবেন না। হাড্ডি আর হাড্ডি। চর্বি টর্বি কিছু নেই। আলাদা স্বাদও নেই। উলটো বরং দাত টাত ভেঙ্গে যেতে পারে। তখন আবার আরেক সমস্যা। ডেন্টিস্টের কাছে যাও, ফিলিং করাও, রুট ক্যানেল করাও! হ্যান ত্যান!”

রহমান সাহেব বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে ছিলেন।

আশরাফ সাহেব অপরাধী কন্ঠে বললেন, “এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আমি কি করব বলুন। একবার খেলে তা কি আর ছাড়া যায়? তাই মাঝে মাঝে…একটু আধটু…হঠাৎ হঠাৎ…কদাচিৎ…”

রহমান সাহেব আর শুনলেন না। প্রায় দৌড়েই চলে এলেন হোটেলে। এসে একজন ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করলেন পাশের বাড়িটার ভদ্রলোক সম্পর্কে। ওয়েটার জানাল ওই লোক অনেকদিন দেশের বাইরে ছিলেন। শোনা যায় ওখানকার কোন এক গোরস্থানের পাহারাদার ছিলেন। কি একটা অপরাধের কারণে তার চাকরিটা চলে যায়। এরপর তিনি দেশে ফিরে আসেন। এখন বদ্ধ পাগল।

via GIPHY

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং