লেখকদের জন্য টিপসঃ জন গ্রিন, পাওলো কোয়েলহো, কুর্ট ভনেগাট

লেখকদের জন্য প্রতিষ্ঠিত লেখকেরা বিভিন্ন সময়ে উপদেশাবলী দিয়ে থাকেন। তাদের লেখার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে থাকেন।  এখানে উল্লেখ করা যায়, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সৈয়দ মুজতবা আলীকে বলেছিলেন – “বুঝলি, যদি কখনো লিখতে চাস তাহলে একটা কথা খুব মনে রাখবি। সেটা হলঃ লেখা হবে সব সময় Precise, concise and exact”.

এগুলো অনেক সময় নতুন লেখকদের বা লেখক হতে চাওয়া ব্যক্তিদের সাহায্য করে। অনেকসময় লেখকদের জীবনও নতুন লেখকদের অনুপ্রেরণা দেয়।

এই লেখায় জন গ্রিন, পাওলো কোয়েলহো এবং কুর্ট ভনেগাটের দেয়া লেখালেখি নিয়ে কিছু টিপস তুলে ধরা হয়েছে।

জন গ্রিন একজন আমেরিকান লেখক এবং ভিডিও ব্লগার। তার শিক্ষামূলক ভিডিও ব্লগগুলো উপকারী। ইনি বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন যা বিখ্যাত এবং আমি পড়ি নাই। তার বইদের বিত্তান্ত তার নাম লিখে গুগলে সার্চ দিলেই পাবেন। সুতরাং, এখানে বর্ননা না করি।  তার ভিডিও ব্লগের ইউটিউব চ্যানেলটার নাম “ক্রাশকোর্স”। এই ক্রাশকোর্সে তিনি এবং তার ভাই মিলে সাহিত্য, ইতিহাস, সাইকোলজি ইত্যাদি বিষয়ে ছোট ছোট শিক্ষামূলক ভিডিও তৈরী করে থাকেন।

জন গ্রিন বলেছেন  লেখালেখি নিয়ে বলেছেন –

প্রতিদিন আমি অনেক নতুন নতুন লেখকের ইমেইল পাই। তারা কীভাবে একজন লেখক হওয়া যায় সে সম্পর্কে আমার উপদেশ চান। আমি এই একটিমাত্র উপদেশই আসলে দিতে পারিঃ

শুধুমাত্র টাকা উপার্জনের জন্য লিখবেন না। কারণ কখনোই আপনার যথেষ্ট টাকা উপার্জন হবে না। এবং বিখ্যাত হবার বাসনাতে লিখবেন না। কারণ কখনোই আপনি যথেষ্ট বিখ্যাত অনুভব করবেন না। মানুষের জন্য উপহার তৈরী করুন। এই উপহার গুলো তৈরী করতে কঠোর পরিশ্রম করুন যাতে লোকজন তা লক্ষ্য করে এবং পছন্দ করে।

হয়ত তারা বুঝতে পারবে আপনি কত কঠোর পরিশ্রম করেছেন । হয়ত পারবে না। তারা যদি লক্ষ্য না করে, তাহলে আমি বুঝতে পারছি এটা হতাশাজনক। কিন্তু আসলে মূল ব্যাপারটা হল, এতে কোন কিছুর পরিবর্তন হয় না। কারণ আপনার দায় দায়িত্ব মানুষের উপর না, যে উপহার আপনি তৈরী করেছেন, তার উপর।

জন গ্রিন

 

ব্রাজিলিয়ান লেখক পাওলো কোয়েলহোর বই দি আলকেমিস্ট ৮০ টি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। জীবিত লেখকের বইয়ের ক্ষেত্রে এটা একটা বিশ্বরেকর্ড। এই জনপ্রিয় লেখক লেখালেখি নিয়ে দিয়েছেন আটটি টিপস।

 

পাওলো কোয়েলহো, ছবি -paulocoelho.com
পাওলো কোয়েলহো

 

লেখকদের জন্য কোয়েলহোর আট টিপসঃ

১। আত্মবিশ্বাসঃ আপনি আপনার নতুন প্রকাশিত বই বিক্রি করতে পারবেন না যদি নিজেই বইয়ের মান সম্পর্কে সন্দিহান থাকেন। আপনার যা আছে তাতে গর্বিত হোন। নিজের লেখাকে ছোট করে দেখবেন না।

২। পাঠকদের প্রতি বিশ্বাস রাখুনঃ আপনার পাঠকদের প্রতি বিশ্বাস রাখুন। সবকিছু বর্ণনা করতে যাবেন না। শুধুমাত্র হিন্টস দিয়ে যান। পাঠক তার কল্পণা শক্তি দিয়ে বুঝে নেবেন।

৩। অভিজ্ঞতাঃ লেখার সময় নিজের অভিজ্ঞতা ব্যবহার করুন। আপনি কোন কিছু শূন্য থেকে সৃষ্টি করতে পারবেন না। কিছু অভিজ্ঞতার দরকার।

৪। সমালোচনাঃ লেখকেরা সমালোচকদের সন্তুষ্ট করতে চান। দেখা যায় তারা প্রতিষ্ঠিত হতে চান সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষন করে। কিন্তু এসব ভুলে যান। আপনি আপনার ভেতরের কথা প্রকাশ করার কথা ভাবুন। অন্য লেখকদের সন্তুষ্ট করার কথা না।

৫। নোট সম্পর্কেঃ আপনি যদি আইডিয়া নোট করে রাখতে যান তাহলে আপনি হয়ত রাখতে পারবেন। কিন্তু আবেগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন। আপনি হয়ে যাবেন একজন অবজার্ভার। তাই আমি বলি, ভুলে যান নোট রাখার কথা।যা গুরুত্বপূর্ণ তা এমনিতেই থাকবে। যা গুরুত্বপূর্ণ না তা চলে যাবে।

৬। গবেষনা প্রসঙ্গেঃ আপনি যদি খুব খুব গবেষনা করে, প্রচুর তথ্য উপাত্ত্ব দিয়ে বই লিখেন তাহলে নিশ্চিত আপনি হয়ে উঠবেন একজন বিরক্তিকর লেখক আপনার পাঠকের কাছে। বই আপনি কতটা জানেন তা দেখাতে নয়। বই আপনার আত্মার শক্তি দেখাতে।

৭। লেখা নিয়েঃ আসলে আমি যে বই লিখি সেটা আমার মনে হয় নিজে নিজেই লিখিত হতে চায়। প্রথম বাক্য আমাকে টেনে শেষ পর্যন্ত নিয়ে যায়।

৮। লেখার স্টাইলঃ স্টাইল নিয়ে বেশী মাথা ঘামানোর কিছু নেই। আপনি একটি সুন্দর গল্প বলবেন। যাদুকরী গল্প বলবেন। এখন দেখা যায় মানুষ লেখার স্টাইল নিয়ে বেশী কথা বলছে, একই গল্প বিভিন্ন স্টাইলে লিখছে। ফ্যাশনের মত। লেখার স্টাইল হচ্ছে পোষাক। পোষাক এর ভিতরের জিনিসকে পরিবর্তন করতে পারে না।

এখানে আমার কাছে যৌক্তিক ও ভালো উপদেশ মনে হয়েছে।

এরপরের উপদেশদাতা আমেরিকান লেখক কুর্ট ভনেগাট।  উপরে উক্ত দুজনের চেয়ে ইনি সাহিত্যে বেশী  বিখ্যাত বা প্রতিষ্ঠিত। তার একটি বিখ্যাত বইয়ের নামটা সুন্দর, ক্যাটস ক্র্যাডল।

 

কুর্ট ভনেগাট , ছবি - feelguide.com
কুর্ট ভনেগাট

 

লেখকদের জন্য কুর্ট ভনেগাটের আট টিপস

১। পাঠকের সময় যাতে নষ্ট না হয়ঃ  এমনভাবে লিখো যাতে, পুরোপুরি অপরিচিত যে ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা বইটি পড়বেন- তিনি যেন পড়ে মনে না করেন “ধুর! সময়টা নষ্ট হল”।

২। চরিত্র বিষয়েঃ  পাঠককে অন্তত একটি চরিত্র দাও যা ধরে তিনি এগুতে পারেন।

৩। চরিত্রের প্রকৃতিঃ  প্রতিটি চরিত্রই যেন কিছু চায়। এক গ্লাস পানি হলেও।

৪। লেখার বর্ননা বিষয়েঃ  প্রতিটি বাক্য যেন চরিত্রকে প্রকাশ করে কিংবা ঘটনাকে এগিয়ে নেয়।

৫। গল্পের শুরুঃ শেষের যত কাছে যাওয়া যায়, সেখান থেকেই শুরু করো।

৬। চরিত্রের প্রতি নির্দয় হওয়া বিষয়েঃ  একজন স্যাডিস্ট বা দুঃখকামী হও। তোমার চরিত্র যতই ভালো এবং নির্দোষ হোক না কেন তাদের মারাত্মক খারাপ ঘটনার মুখোমুখি করো।

৭। সবাইকে খুশি করার চেষ্টা না করাঃ একজনকে খুশি করতে লিখো। তুমি যদি জানলা খুলে সবার প্রতি ভালোবাসা দেখাতে যায় তাহলে বাস্তবিক অর্থেই তোমার গল্পকে নিউমোনিয়া টুঁটি চেপে ধরবে।

৮। বর্ননা ও তথ্যঃ  তোমার পাঠক যতটা সম্ভব তথ্য দাও। পাঠকেরা যেন পরিস্কারভাবে বুঝতে পারেন কি হচ্ছে, কোথায় হচ্ছে? কেন হচ্ছে? এমনকী শেষ কয়েকপাতা যদি তেলাপোকা খেয়ে ফেলে তবুও যেন তারা গল্পটি নিজের মত করে শেষ করে নিতে পারেন সেই রসদ দিয়ে দাও।

এই টিপসগুলো আশা হয়ত কারো উপকারে আসতে পারে। বিশেষত ভনেগাটের কথাবার্তা।

সমারসেট মম আবার উপন্যাস লেখা বিষয়ে মজার একটি কথা বলেছিলেন। সেটিকে কথোপকথন আকারে সাজিয়ে একবার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। এই লেখা শেষ করছি সেই স্ট্যাটাসটা দিয়েঃ

সমারসেট মমের লগে দেখা হইল। তার চেহারা সুরত ভাল। জিজ্ঞাসিলাম, “কেমন আছেন?”

তিনি জবাব দিলেন না। মুখ গম্ভীর করিয়া রইলেন।

আমি বলিলাম, “উপন্যাস লেখা নিয়া টিপটুপস দেন কিছু…”

তিনি এইবার আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকাইয়া বললেন, “উপন্যাস লেখার নিয়ম আছে তিনটা…”

বলিয়া আবার চুপ করিয়া রইলেন। আমি তাগাদা দিয়া বলিলাম, “কী কী?”

তিনি গম্ভীর হইয়া উত্তর দিলেন, “দূর্ভাগ্যজনক বিষয় হইল সেইগুলা যে কী কী তাহা কেউ জানে না।”

বলিয়া তিনি উদাস হইয়া জানালা দিয়া বাইরে তাকাইয়া রইলেন। আর আমি সে স্থান পরিত্যাগ পূর্বক অন্যত্র গমন করিলাম।