বাংলাদেশ সরকার ফেসবুক, হোয়াটসএপ, ভাইবার বন্ধ করে দিয়েছেন। সেই সুবাধে বাংলায় আজ অফুরন্ত সময়। হঠাৎ করে আমাদের ইয়াং জেনারেশন বেকার হয়ে পড়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, তারা বুঝতে পারছে না এই সময়গুলো দিয়ে করবে কী?
সময় ধ্বংশ করার এক মহামাধ্যম হচ্ছে ফিল্ম দেখা। একবার আমার এক বন্ধু মুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটিতে কীসব ফিল্ম কোর্স করল। সে তখন বেশ লম্বা চওড়া কথা বলার চেষ্টা করত ফিল্ম নিয়ে। আমাকে একদিন বলেছিল ফিল্ম এবং মুভির পার্থক্য। আমি ভুলে গেছি। তাই আমার কাছে ফিল্ম এবং মুভি দুইটাই এক। রাশোমনও ফিল্ম আবার স্ট্রেইট স্টোরিও ফিল্ম। কিংবা মুভি। খামকা পার্থক্য করে কী লাভ। আর্ট এবং এন্টারটেইনমেন্ট দুইটারই তো দরকার। রাশোমন কিংবা টুয়েলভ এংরিম্যান কী কম এন্টারটেইনিং?
কিছুদিন ধরে কয়েকটি ফিল্ম দেখার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। (যেমন ব্রিক, হেভেনলি ক্রিয়েচারস ইত্যাদি)। শেষে ইউটিউবে দেখলাম টেনিদার গল্প নিয়ে পুরানা ফিল্ম চারমূর্তি। ভালো লাগল। এরপর ব্যোমকেশ। তার রাজনীতি নিয়ে একটা পোস্টও দিয়ে দিলাম।
আজ দেখলাম এবার শবর। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের শবর দাশগুপ্তের সাথে পরিচয় সাম্প্রতিক ডট কমে একটা লেখার মাধ্যমে। সেখানেই এই গোয়েন্দা সম্পর্কে পড়ে তার বইগুলো পড়ার ইচ্ছে হয়। কিন্তু সে ইচ্ছে আর পূর্ন হয় নি।
অতঃপর ইউটিউবে যখন দেখলাম শাশ্বত চ্যাটার্জি শবর হয়েছেন তাই ভাবলাম দেখে ফেলি। দেখা যাক শবর গোয়েন্দা কেমন।
শবর কাহিনী শুরু হয় একজন ভদ্রমহিলার খুনের মাধ্যমে। ভদ্রমহিলা নিজগৃহে খুন হয়ে যান। কে যেন তার কোমল পেটে বিদ্ধ করে ফেলে ধারালো ছোরা। তিনি তখন পার্টি শেষ করে এবং আকন্ঠ মদ্যপান করে ছিলেন কঠিন নেশাগ্রস্ত।
শবর গোয়েন্দা এই কেসের একটা সুরাহা করতে লাগেন। অনেক সন্দেহভাজন ব্যক্তি বের হয়। তাদের বিভিন্ন মোটিভ। যেরকম আর দশটা ডিটেকটিভ থ্রিলারে হয় আর কী।
শবর তার গোয়েন্দা কার্যকলাপ চালিয়ে যান। শবরের কথাবার্তায় বুঝা যায় তার সেন্স অব হিউমার ভালো। ডায়লগগুলোতে হালকা হাস্যরস ছিল। শবরের চরিত্র আরো দুই বাঙালী গোয়েন্দা ব্যোমকেশ এবং ফেলু মিত্তির থেকে আলাদা। তার প্রশ্ন করার ধরন কিংবা একশনও ভিন্নরকম। পুলিশি ভাব তার মধ্যে বিদ্যমান। শাশ্বত চ্যাটার্জির আরেকটা ফিল্ম দেখেছিলাম প্রলয় নামে। সেখানেও তার এইরকম একটা ভাব ছিল।
শবর পড়ি নাই। কিন্তু ফিল্মে যা দেখলাম, গোয়েন্দা হিসেবে তাকে ভালোই লেগেছে।
তবে ফিল্মটা ডিটেকটিভ থ্রিলার হতে গিয়ে মাঝখানে পথ হারিয়ে রোমান্টিক ফিল্মে পরিণত হতে গিয়েছিল আর কী। সুতরাং, স্লো হয়ে যায় কিছুটা। এবং রোমান্টিক গল্পের গড়পরতা জটিলতা বিরক্তিকর ঠেকে।
শেষদিকে গল্প আবার ট্র্যাকে ফিরে আসে।
যেই ভদ্রমহিলা খুন হয়েছিলেন তার খুনের ব্যাপারে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের প্রতিসন্দেহ ঘনিয়ে উঠে নি সেভাবে। কাউকেই তেমনভাবে সন্দেহ করার মত না আবার তারা সন্দেহের বাইরেও থাকার মত না- এই অবস্থায় এগিয়েছে কাহিনী।
ফলে খুব অসাধারণ রহস্য হয়েছে তা বলা যায় না।
গল্পের চাইতে ফিল্মে সহজে রহস্য তৈরী করা যায়। এই ধরনের মার্ডার মিস্ট্রি জাতীয় থ্রিলার দেখতে হলে জাল্লো সব দেখে ফেলতে পারেন। ইতালিয়ান জাল্লো গুলোতে খুব দারুণভাবে সাসপেন্স তৈরী করে একেবারে সাধারণ গল্প দিয়ে। উদাহরন হিসেবে লুসিয়ানো এরকোলির ফরবিডেন ফটো অফ এ লেডি এভাব সাসপিশন কিংবা ডারিও আরজেন্টোর ডারিও আরজেন্টোর দ্য বার্ড উইথ ক্রিস্টাল প্লুমেজ এর কথা বলা যায়।
নিউজিল্যান্ডের একটা মার্ডার মিস্ট্রি দেখেছিলাম ইন মাই ফাদার’জ ডেন। কিছুটা স্লো হলেও ধীরে ধীরে দারুণ রহস্য তৈরী করে শেষে এক অস্বস্থিকর সত্য বের করে আনা হয়েছে। এবং ফিল্মটার আরেক বিশেষত্ব হল তাতে কোন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা চরিত্র ছিল না।
মরিস গী’র উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে নির্মিত “ইন মাই ফাদার’জ ডেন” আমার দেখা অন্যতম সেরা একটি মিস্ট্রি ফিল্ম।
পল প্রায়র একজন বিখ্যাত সাংবাদিক। সে লন্ডনের একটা পত্রিকার জন্য যুদ্ধের ছবি তুলত। এর জন্য বেশ বড় পুরস্কারও পেয়েছে। কিন্তু তার কিছু মানসিক সমস্যা দেখা যায়। সে হতাশ এবং সর্বদা বিষন্ন লোক। অনেক আগে সে এক অজ্ঞাত কারণে তার বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল।
সতের বছর পর তার বাবার মৃত্যুর পরে সম্পত্তির কারণে সে আবার ফিরে যায় তার বাড়িতে। বাড়িটি নিউজিল্যান্ডের সাউথ আইল্যান্ডের একটি ছোট শহরে।
তার বাবার ঘরের নিচে ছিল একটি পড়ার ঘর তথা ডেন। সেখানে মুক্তচিন্তা, সাহিত্য, দর্শন ইত্যাদির বিভিন্ন ধরনের বইয়ে ভর্তি ছিল। পলের বাবা সেখানে পড়াশোনা করতেন।
ছোটবেলায় পল এই ঘরের খোঁজ পেয়েছিল। সে বই পড়তে আসত। এবং আসত তার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে। সেটা তার বাবা জানতেন। তিনি তাকে একরকম উৎসাহই দিতেন।
পলের মা ছিলেন ধার্মিক মহিলা। পলের বাবা তার ধার্মিক স্ত্রীর দৃষ্টি এড়িয়ে এই ঘরে এসে সাহিত্য দর্শনের চর্চা করতেন, মদ খেতেন।
কিন্তু সতের বছর পর অনেক কাহিনী বদলে গেছে। পলের সেই গার্লফ্রেন্ড এখন আছে আরেক লোকের সাথে। একই শহরেই। তার আবার একটা টিনেজার মেয়ে আছে। সেই মেয়ে শিল্প সাহিত্যে আগ্রহী।
পল বাড়িতে ফিরে আসার পর লোকাল স্কুলে তার বক্তৃতার আয়োজন করা হয়। কারন সে একসময় এই স্কুলেরই ছাত্র ছিল।
এই সময় পলের গার্লফ্রেন্ডের মেয়ে সিলিয়া পলের ফটোজার্নালিজমের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক গড়ে উঠে। এই পর্যায়ে দর্শকের মনে সন্দেহ হতে থাকে এই সিলিয়া হয়ত পলের মেয়ে।
এক পর্যায়ে সেই মেয়েটি হারিয়ে যায়।
পুলিশ মনে করে পল হয়ত খুন করেছে। বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে গল্প এগিয়ে যায়। এবং বেরিয়ে আসে এক সত্য যা লুকায়িত ছিল। পলের ফাদার’জ ডেনের রহস্যের সাথে সিলিয়ার মৃত্যুর একটি সংযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই ফিল্ম নির্মান করেছিলেন ব্র্যাড ম্যাকগান। তিনি অসাধারনভাবে ফিল্মে রহস্য তৈরী করেছেন, ধরে রেখেছেন এবং গভীর দর্শনের সাথে যুক্ত করেছেন। রহস্য ফিল্মে তিনি হয়ত আরো কিছু বড় সৃষ্টি উপহার দিতে পারতেন পৃথিবীকে, কিন্তু প্রকৃতি তাকে সে সুযোগ দেয় নি।
গতকালের আগেরদিন দেখেছিলাম রোমান পোলানস্কির চায়নাটাউন। আমেরিকান ফিল্ম ইন্সটিটিউটের মিস্ট্রি ফিল্মের লিস্টে যার অবস্থান দ্বিতীয়। জ্যাক নিকলসন অভিনিত এই মুভিতেও শুরুর দিকে একটা মার্ডার হয় এবং প্রাইভেট ডিটেকটিভ জে জে গিটিস (জ্যাক নিকলসন) এর সাথে জড়িয়ে পড়েন। শেষে অস্বস্থিকর কিছু জিনিস বের হয়।
এইসব রহস্য গল্পে দেখা যায় অস্বস্থিকর একটা সত্য থাকতে হয় রহস্যের পেছনে। যেটা শবরের গল্পতেও ছিল। কিন্তু শবরের গল্পের অস্বস্থি হিসেবে যা আছে তা খুব একটা অস্বস্থিকর কিছু না।
তবে গল্প কাহিনী যাইহোক একটা অভিনেত্রীকে দেখতে ভালো লেগেছে ফিল্মে। তাকে একেবারে নিরীহ রোমান্টিক চরিত্রে রেখে দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে একটা কুটিল ভাব এবং তাকেও সন্দেহের মধ্যে আনলে ভালো হত।
যদিও পার্থক আছে তথাপি প্রায় একইরকম একটা ব্যাপার ছিল আগাথা ক্রিস্ট্রির ডেথ অন দ্য নাইলে, যেখানে এক ছেলেরে দুই বোনই লাইক করত। এক বোন মার্ডার হয়ে যায়। ডেথ অন দ্য নাইল আগাথা ক্রিস্টির গোয়েন্দা চরিত্র এরকোল পোয়ারো’র কাহিনী। ১৯৭৮ সালে এটি নিয়ে ফিল্ম হয়।
ফিল্মে এক বোন খুন হয়ে যান।
এরকোল পোয়ারো সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং রহস্যের মীমাংসা করতে সচেষ্ট হন। এরকোল পোয়ারো যেভাবে সন্দেহভাজনদের সরাসরি অভিযুক্ত করার মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তেমনি শবরের ফিল্মে শবরকেও তা করতে দেখা যায়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের তরিকা একই রকম।
ডিটেকটিভ ফিল্মের ভালো এক উদাহরণ ডেথ অন দ্য নাইল। প্রায় এক ঘন্টা সময় নেয়া হয় ভূমিকা তথা পরিবেশ তৈরীতে। সেসময় বিভিন্ন চরিত্রের পরিচয় ঘটে। বাকি এক ঘন্টার অধিক সময় ব্যয় হয় রহস্য তৈরী এবং তার সমাধানে।