গল্পের শুরুতেই বলা হয় এলাকার লোকেরা “জটিলতায়” পড়েছে এবং তা খোরশেদ আলমের বেকার পুত্র আব্দুল করিমের ময়মনসিংহ যাওয়াকে কেন্দ্র করে। এলাকার একজন ব্যাক্তি যখন এভাবে সামান্য কারণে পুরো এলাকায় লোকের কাছে গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠল তখন তাকে আর আলাদা ব্যাক্তি হিসেবে দেখার কোন উপায় নেই।
লেখক শহীদুল জহির এলাকার লোকদের “আমরা” বলে উল্লেখ করেছেন। এলাকার লোকেরা অর্থাৎ ‘আমরা’ এক অংশ এবং ‘আব্দুল করিম’ এখানে অন্য অংশ। আব্দুল করিমকে “আদার” ধরে এগুলে দেখা যায়, মহল্লার লোকেরা বিশ্বাস করতে চায় না আব্দুল করিম ময়মনসিংহ যাবে। ফলে আজিজ ব্যাপারি তাকে ডাইলপুরি বা আলুপুরি খাওয়াইতে খাওয়াইতে নানাভাবে প্রশ্ন করে জানতে চায় সে আসলে কোন উদ্দেশ্যে যেতে চায়।
এই জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে আব্দুল করিম বলে সে তার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছিল এবং বন্ধুত্ব হয়েছিল বাসস্ট্যান্ডে। তার নাম শেফালী।
কিন্তু তবুও এলাকাবাসীর বিশ্বাস হয় না আব্দুল করিম যাবে অথবা তাদের সন্দেহ দূর হয় না। এরপর এক সময় আব্দুল করিম আজিজ ব্যাপারির ছেলে দুলাল মিয়াকে সাথে নিয়ে ময়মনসিংহ রওনা দেয়। দুলাল মিয়াকে সাথে দিয়েছিল আজিজ ব্যাপারি। এলাকার লোকেরা এতে খুশি হয়। কারন দুলাল মিয়ার কাছ থেকে জানা যাবে তাদের ময়মনসিংহ ভ্রমণের বিত্তান্ত বা সেখানে গিয়ে শেফালীর সাথে দেখা হল কি না।
আব্দুল করিম শেফালির দেয়া অদ্ভুত ঠিকানা ধরে কিছুদূর যায়। তারপর হঠাৎ করেই সে ফিরে আসে। দুলাল মিয়াকে বলে,
“ল, দুলাল, যাইগা”
দুলাল এতে বিস্মিত হয়। কিন্তু তারা সেই রাতেই এলাকায় ফিরে আসে।
এখানে আব্দুল করিম কেন গেল আবার ফিরেই বা আসল কেন, তা জ্যাক লাকান এর ফ্যান্টাসী তত্ত্ব দ্বারা বুঝা যাক। শেফালি, ময়মনসিং, ডাল কেনা, আলু কেনা ইত্যাদি হল আব্দুল করিমের ফ্যান্টাসীভিত্তিক চাওয়া। আব্দুল করিমের এই আকাঙ্খার বস্তুগুলোর হয়ত অস্তিত্বই নেই, হয়ত পুরোটাই কাল্পনিক। কিন্তু আব্দুল করিম এগুলো চেয়েছে এবং এগুলোর পাওয়ার চেষ্টার কল্পণা সে করেছে, আজিজ ব্যাপারির সাথে ডাইলপুরি খেতে খেতে এ নিয়ে আলাপ করেছে। লাকান যেমন বলেন, আমরা যা চাই তা ঐ বস্তু নয় যা আমরা চাই বরং ঐ বস্তু চাওয়ার কল্পণা এবং উত্তেজনাই আমরা চাই মূলত।
ব্যাক্তিত্বের আমরা অংশ (এলাকার লোকজন) বুঝেনা অন্য অংশ (আব্দুল করিম) কি চায়, কেন চায়।
গল্পে দেখা যায় “আমরা” অর্থাৎ এলাকার লোকজনদের অংশ আজিজ ব্যাপারি, আলী আকবর, বাবুল মিয়া কথোপকথনে আব্দুল করিমের সাথে জানতে চায় সে কেন যাচ্ছে ময়মনসিংহ। আজিজ ব্যাপারী এই ক্ষেত্রে এলাকার লোকজনদের অংশ হয়ে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে।
লাকান বলেন –
“Desire full stop is always the desire of the Other. Which basically means that we are always asking the Other what he desires” (My Teaching, p.38).
এখানে আদার বা অন্য অংশ আব্দুল করিম।
আবার দেখা যায় আব্দুল করিম বাবুল মিয়ার জন্য আলু কিংবা আজিজ ব্যাপারির জন্য ফুলবাড়ি থেকে ডাল আনতে চায় কমদামে। আব্দুল করিমের কাছে শুধুমাত্র শেফালিকে দেখতে যাবার ইচ্ছাই একমাত্র হয়ে উঠে না ময়মনসিংহ যাওয়ার ক্ষেত্রে। সে “আমরা” অংশে যা নেই (ডাল,আলু) তাও চাইতে থাকে, এর দ্বারা সে যেন “আমরা” অংশের কাছ থেকে তার ময়মনসিংহ ভ্রমনের স্বীকৃতি আদায় করে নিতে চায়।
আর আমরা চায় আব্দুল করিমের ইচ্ছা জানতে। এখানে আমরাকে ব্যাক্তি আব্দুল করিমের অংশ এবং আলাদা হিসেবে অর্থাৎ দুইভাবেই দেখা যেতে পারে।
“যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহ পাই তাহা চাই না” বলে রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার লাইন আছে। ওস্কার ওয়াইল্ডের একটা কথা আছে, জীবনের দুইটা মাত্র ট্রাজেডি। এক- যা চাইলা তা পাইলা না, দুই- তা পাইয়া গেলা। এই ধরনের অনুভূতির মাঝে মানুষের চাওয়া জিনিসের দূর্বোধ্যতা ধরা পড়ে। মানুষ জানে না সে কি চায়, যেইরূপ আব্দুল করিমও আসলে জানতো না, ধরা যাক। মাঝপথে গিয়ে তার মনে হয়েছে শেফালির সাথে সে দেখা করতে চায় না। তাই সে ফিরে এসেছে।
আব্দুল করিমের চাওয়ায় অন্য ব্যাক্তিদের প্রভাব বুঝতে অন্যদের আদার হিসেবে নিলে বলা যায়, আলু কেনা, ডাল কেনা বিষয়ক চাওয়াগুলোর উৎপত্তি হয়েছে সমাজ, সংস্কৃতি এবং অন্য ব্যাক্তিদের চাওয়ার প্রেক্ষিতে। এক্ষেত্রে জ্যাক লাকানের কথা –
“Man’s desire is the desire of the Other” (Seminar XI, p.235).
গল্পের নামটাও ইন্টারেস্টিং, “কোথায় পাবো তারে”। বাউল গগন হরকরার বিখ্যাত গানের লাইন থেকে গল্পের নামকরণ। কিন্তু এর মধ্যে যে জিজ্ঞাসা আছে তা যেন মানুষের চিরন্তন ডিজায়ার ঘটিত জিজ্ঞাসাই? কোথায় পাবো তারে বা তার অস্তিত্ব আছে নাকী বা তাকে আসলে চাই কি?