শহীদুল জহিরের গল্প “তোরাব সেখ” এর সাইকোএনালিসিস

শহীদুল জহিরের তোরাব সেখ গল্পটি শুরু হয়েছে রোদের বর্ননা দিয়ে। প্রচন্ড চৈত্রের রোদ যা বাড়িঘর গাছপালা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। প্রথম প্যারার এই বর্ননাটা আসলে তোরাব সেখের মনের অবস্থার প্রতীক। যদিও এই প্যারায় তোরাব সেখ নেই। তোরাব সেখ আসে প্রথম প্যারার ঠিক পরের লাইনে। কিন্তু তোরাব সেখকে আনার পূর্বেই লেখক পাঠকের সামনের প্রখর রৌদ্রের রূপ তুলে ধরার রূপকে আসলে তুলে ধরেন তোরাব সেখের মনের অবস্থার চিত্র।

তোরাব সেখ একজন বৃদ্ধ মানুষ। সে রোগে ভোগে শক্তিহীন। তার এক ছেলে জমির, এক মেয়ে লালবানু, স্ত্রী রহিমা এবং পুত্রবধূ লতিফা। ঘরের সব সদস্যরা দিনে কাজে চলে যায়। বস্তির সবাই কাজে চলে যায়। শুধু বসে থাকে শক্তিহীন তোরাব সেখ।

যেন এক রৌদ্র ঝলসানো মরুভূমিতে বসে থাকে এক বৃদ্ধ। সাধারণভাবে চিন্তা করলে বস্তিতে তোরাব সেখের একা বসে থাকা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কারণ যেহেতু এটা বস্তি তাই সেখানে আরো বৃদ্ধ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু “একটা লোকও নেই সারা বস্তিতে” কিংবা “জোয়ান মেয়ে মরদ সব বাইরে” দিয়ে বস্তির লোকশূন্যতা বুঝানো অপেক্ষা তোরাব সেখের মানসিক একাকীত্বতা বুঝানো হয়েছে বেশী। অর্থাৎ তোরাব সেখ যেকোন কারণে অন্যদের থেকে আলাদা। তার সাথে অন্যদের মিলে না। তাই সে একা।

গল্প এগিয়ে গেলে দেখা যায় তোরাব সেখ অল্পতে রাগান্বিত হয়ে যায়। সে খিটখিটে এবং একগুয়ে স্বভাবের এক বৃদ্ধ। সে তার পুত্রবধূর লাগানো কুমড়া গাছ পা দিয়ে মাড়িয়ে ফেলে অন্যমনস্কভাবে। কিন্তু এরপর তার রাগ আরো বেড়ে যায়। এবং সে নিজের দোষ না দেখতে পেয়ে পুত্রবধূকে গালিগালাজ করে।

ছবিঃ বাংলা সাহিত্যের এক অসাধারণ গল্পকার শহীদুল জহির।
ছবিঃ বাংলা সাহিত্যের এক অসাধারণ গল্পকার শহীদুল জহির।

তার স্ত্রী রহিমা বাসায় এসে যখক কুমড়া গাছের ব্যাপারে কথা বলে তখনো সে নিজের দোষ স্বীকার না করে বলে “চুপ কর বুড়ি। মানা করছিলাম না, কইছিলাম দরজার কাছথন হরায়া লাগা। হুনছিলি!”

এখানে স্পষ্ট দেখা যায় তোরাব সেখের নিজের দোষ অন্যের উপর চাপিয়ে দেবার প্রবণতা আছে।

কিন্তু গল্পের প্রথম থেকেই দেখা যায় নিজে কাজ করতে পারে না, পরিবারের অন্য সব সদস্যদের আয়ের উপর নির্ভর করতে হয় বলে তোরাব সেখের মধ্যে এক ধরণের গ্লানিবোধ কাজ করে। লেখক লিখেছেন, “তোরাবের খারাপ লাগে রোগ কাতর বুড়ো হবার জন্য।”

কুমড়া গাছ নিয়ে তোরাব সেখ এবং রহিমার কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে তোরাব সেখের প্রতিবেশি নিজামের আগমন হয়। এখানে দারুণ লক্ষণীয় একটা বিষয় হল লেখক তোরাব এবং রহিমার ঝগড়া এড়িয়ে গেছেন।

গল্প এক লাফে চলে গেছে পরের দিনের বর্ননায়। প্রশ্ন হতে পারে, লেখক কেন তোরাব এবং রহিমার ঝগড়া এড়িয়ে গেলেন?

পরদিন তোরাব সেখ নিজামের সাথে কাজে যায়। সংসারে কিছু টাকা যোগ করতে পেরে তার তৃপ্তি হয়। সারাদিন পরিশ্রম শেষে ক্লান্ত হয়ে সে শুয়ে পড়ে। কিন্তু দেখা যায় তার ঘুম আসে না।

গল্পের প্রথমেই বলা হয়েছে তোরাব সেখ রোগ কাতর বুড়ো। রোগে ভোগে তার শক্তি কম। তাই সারাদিনের পরিশ্রম শেষে তার ঘুম আসাটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু দেখা যায় ঘুমহীন তোরাব সেখ অস্বস্থির সাথে ঘরের বেড়ার ওপাশে ছেলে জমির এবং ছেলের বউ লতিফার শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনে। এই শব্দ শুনে তার রাগ হয়। ধরা যাক, জমির এবং তার স্ত্রী স্বাভাবিক যৌন মিলনে ব্যস্ত এবং তারই শ্বাস-প্রশ্বাসের অস্পষ্ট শব্দ গিয়েছে তোরাব সেখের কানে। কিন্তু তোরাব সেখ চায় না এই শব্দ তার কানে আসুক। এজন্য তার নিজের উপর রাগ হয়।

এরই সাথে সাথে আরেকটি দারুণ ঘটনা ঘটে। পাশের ঘরের কফিলের ছোট ছেলেটা কেঁদে উঠে। কফিল এবং তার স্ত্রী রোমেজা গল্পের আর কোথাও নেই। শুধু এইখানে আছে। তাদের বাচ্চা কেঁদে উঠে। তখন তোরাব সেখ বের হয়ে তাদের দরজায় ডেকে বলে “ওই তর পোলার চিক্কর বন্দ কর।”

তোরাব সেখ যখন তার পুত্র ও পুত্রবধূর শ্বাস প্রশ্বাসের অস্পষ্ট শব্দ শুনছিল (এবং এজন্য তার রাগ হচ্ছিল নিজের উপর) তখনই এই ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনার ফ্রয়েডিয়ান ব্যাখ্যা দেয়া যায় ওডিপাস কমপ্লেক্স থেকে।

ফ্রয়েড মতে একটা পর্যায়ে তিন থেকে ছয় বছর বয়েসে শিশু বুঝতে পারে সে তার মায়ের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে নয়। তখন ইড এবং ইগোর দ্বন্দ্বের মাধ্যমে সে তার মাকে মা হিসেবেই ভাবতে শুরু করে। এবং ভবিষ্যতে মায়ের মত একজন সঙ্গী খুঁজে নিতে মনস্থ করে (মেয়ে শিশুর ক্ষেত্রে তা বাবার দিকে যায় এবং সে বড় হয়ে বাপের মত সঙ্গী খুঁজে নিতে মনস্থ করে)। এই দ্বন্দ্বের ফলে জন্ম হয় তার সুপারইগোর।

id-ego-superego

দেখা যায় তোরাব সেখের মধ্যেও এক ধরনের দ্বন্দ্ব কাজ করছে। তা সরাসরি ওডিপাস কমপ্লেক্স নয় অবশ্যই। কারণ তোরাব সেখ শিশু নয়, এখানে তার পিতামাতাও নেই। তোরাব সেখ বুড়ো এবং তার দ্বন্দ্বটা হচ্ছে ফ্রয়েডিয়ান ইড এবং সুপারইগোর মধ্যে। তার কানে পুত্র-পুত্রবধূর শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ আসছে। তার ইড একে প্রশ্রয় দিচ্ছে। মূলত এইজন্যই তার ঘুম আসছে না বলা যায়। হয়ত তার ইগোও একে প্রশ্রয় দিতে চাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে সুপারইগো তার নৈতিক দিক নিয়ে হাজির হয়ে সুপার ইগোকে শাস্তি দিচ্ছে অপরাধবোধ দিয়ে। ফ্রয়েড মতে ইড এর ইচ্ছা অনৈতিকভাবে ইগো প্রশ্রয় দিলে সুপার ইগো তাকে অপরাধবোধের মাধ্যমে শাস্তি দিতে পারে। এই অপরাধবোধের কারণেই তোরাব সেখের নিজের উপর রাগ হচ্ছে, তা না হলে তার নিজের উপর রাগ হবার কোন কারণ নেই।

তোরাব সেখের ভেতরের এই দ্বন্দ্বকে তুলে ধরতেই লেখক কফিল, রোমেজা এবং তাদের বাচ্চাকে ছেলেকে এনেছেন। এখানে স্পষ্টভাবে ফ্রয়েডিয়ান ইড ইগো এবং সুপারইগোর দ্বন্দ্বকে বুঝানো হচ্ছে।

আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে সারাদিন নিজামের সাথে কাজ করে ক্লান্ত হয়ে এসেও তোরাব সেখকে এই অপরাধবোধের ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। তাহলে ধরে নেয়া যায় যেসব দিনে সে কাজে যায় না সেসব রাতেও সে একইভাবে অপরাধবোধে জর্জরীত হয়। একই ভাবে ইড, ইগো এবং সুপারইগোর দ্বন্দ্বে সে বিপর্যস্ত হয়ে উঠে।

এরপর গল্প আর বেশিদূর যায় না। তোরাব শেখের ছেলে জমির লালবানুকে মজিদ মিয়া নামে এক লোকের সাথে বিয়ে দিতে চায়। লোকটার আগে এক বউ ছিল। লাল বানুও বিয়েতে রাজী। কিন্তু তোরাব সেখ বেঁকে বসে। সে মজিদের সাথে মেয়ের বিয়ে দেবে না। লালবানু বাপের কথা না শোনে পালিয়ে যায়। তোরাব সেখ বুঝতে পারে মজিদের ঘরেই গিয়েছে এবং পরিবারের বাকী সদস্যরা বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে। তার শক্তিহীনতা, বুড়ো হয়ে যাওয়া শরীরের গ্লানিতে জর্জরীত হয়ে উঠে তোরাব সেখ এই ঘটনায়। তার অমতে লালবানুর বিয়ে দিয়ে পরিবারের সদস্যরা যে অপমান তাকে করেছে সেটা সে নিতে পারে না। তার রাগান্বিত কথোপকথন হয় জমিরের সাথে। এবং সে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় অন্ধকার রাতে। আর ফিরে আসে না। তার ছেলে জমির নিজের অপরাধবোধ নিয়ে এবং আশায় নিয়ে বসে থাকে তার পিতা তোরাব শেখ ফিরে আসবে। কিন্তু তোরাব সেখ আর আসে না।

কিন্তু বাহ্যিক দৃষ্টিতে লালবানুর বিয়েকে তোরাব সেখের নিরুদ্দেশ হবার কারণ মনে হলেও প্রতিদিন রাতের সেই ইড, ইগো এবং সুপারইগোর দ্বন্দ্ব এবং তৎসংস্লিষ্ট অপরাধবোধের প্রভাবও এতে কম নয়।