শুভাশিষ দেব তার বাবার মৃত্যুর প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর পর এক বিকেলে পিতার মৃত্যুশয্যায় বলে যাওয়া কথাটির অর্থ বুঝতে পারলেন। তিনি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে একটি হাসির গল্পের বই পড়ছিলেন এবং এই বই পড়তে পড়তেই হঠাৎ তার কেন যেন পিতার বলে যাওয়া শেষ কথাটি মনে পড়ল। আর সাথে সাথেই প্রায় বিদ্যুৎ চমকের মত তার মনে চমকে উঠল এই কথাটির মর্মার্থ। আশ্চর্য! তিনি এতদিন কথাটি এভাবে ভেবে দেখেন নি। শুভাশিষ দেবের শরীর ঘামতে শুরু করল। অসহ্য ভয় এবং অতি তীক্ষ্ণ বেদনা একরাশ পাশবিক হৃদয় নিংড়ানো ঘৃণার মোড়কে আবদ্ধ হয়ে শুভাশিষ দেবের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
শুভাশিষ দেব চোখে অন্ধকার দেখলেন। তার যাবতীয় সব জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পেল। তিনি হাতের বইটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সোজা সিঁড়ি ভেঙ্গে তার বিশাল বাড়ির ছাদে গিয়ে উপস্থিত হলেন। বিরাট ছাদের উপরে অপার সৌন্দর্য নিয়ে স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে আছে নীল আকাশ। তাতে টুকরো টুকরো সাদা মেঘের সমারোহ দেখলে মনে হবে এ যেন যেন স্বর্গীয় কর্ষিত ভূমি।
শুভাশিষ দেবের এত কিছু দেখার সময় ছিল না। লজ্জা, ঘৃণা আর অপমানে তিনি কাঁপছিলেন। খুব কম ধরনের অবস্থা আছে যখন মানুষের চিন্তা শক্তি একেবারে লোপ পেয়ে যায়। শুভাশিষ দেব এ রকম একটি অতি প্রাকৃতিক ভয়ংকর অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাই তখন তার মত বিচক্ষণ লোকের মাথাতেও চিন্তা কিছু ছিল না। ছিল শুধু একটি নির্দেশ। যা তিনি নিচ থেকে স্থির করে এসেছেন।
শুভাশিষ দেব ছাঁদের একেবারে কিনারে গেলেন। হাটু সমান উঁচু রেলিং এর উপর উঠলেন এবং আকাশের দিকে মুখ করে মুহুর্তমাত্র সময় ব্যয় না করে লাফিয়ে পড়লেন। বলাবাহুল্য, অভিকর্ষের টানে তিনি নিচে পতিত হন এবং মারা যান।
শুভাশিষ দেবের এই মৃত্যু এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করল। তিনি সু প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ি লোক ছিলেন। এলাকার সব ছোট বড় প্রতিষ্ঠানে চাঁদা দিয়ে সাহায্য সহযোগীতা করেছেন। তার ব্যবহার ছিল অমায়িক। তিনি ছিলেন একজন ভদ্রলোক ও নিপাট ভালোমানুষ। তার এরকম মৃত্যু অনাকাঙ্খিত ও অপ্রত্যাশিত। এলাকায় হঠাৎ করেই শোকের ছায়া নেমে এল।
পুলিশের লোকজন এল খবর পেয়েই। তারা এসে প্রাথমিক আলামত দেখে কিছু ইনভেস্টিগেশন শুরু করল। এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে থানার ওসি সাহেব বুঝতে পারলেন শুভাশিষ দেবের সাথে তার স্ত্রীর ভালো সম্পর্ক ছিল না।
এলাকার লোকেরা বলে, শুভাশিষ দেব দেখতে শুনতে সাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। যদিও তিনি বিচার বুদ্ধি ও ব্যবসায়িক জ্ঞাণের দিক থেকে দেশের শ্রেষ্ট ব্যক্তিদের কাতারে পড়তেন। তিনি বিয়ে করেছিলেন পয়ত্রিশ বছর বয়সে। তার স্ত্রী অসম্ভব সুন্দরী। ভদ্রমহিলা সাধারণ চেহারা ও চালচলনের স্বামীকে বিশেষ পছন্দ করতেন না। এ নিয়ে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য হত। এছাড়া আরেকটা কারণ ও ছিল। বিয়ের পনের বছর পর ও তাদের কোন সন্তান হয় নি।
শুভাশিষ দেবের বিশাল বাড়িতে অসংখ্য চাকর বাকরের সাথে তার দূর সম্পর্কের এক ভাই ও থাকত। সে এখানে থেকে পড়ালেখা করত এবং লোকজনের ধারনা এই ছেলেটির সাথে শুভাশিষ দেবের সুন্দরী স্ত্রীর বিশেষ কোন সম্পর্ক ছিল। এর কারণ হিসেবে লোকেরা বলে, প্রতিদিন বিকেলে শুভাশিষ দেবের স্ত্রী এবং ওই ছেলেটিকে ছাদে দেখা যেত। খুব ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যেত তারা হাসাহাসি করছে এবং কখনো কখনো কোন মেঘলা দিনে দেখা যেত শুভাশিষ দেবের সুন্দরী স্ত্রী ওই যুবক ছেলেটির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে।
এলাকার লোকদের ব্যাপারটা প্রচন্ড খারাপ লাগত। কারণ শুভাশিষ দেব তাদের সকলের খুব প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। তারা বিশ্বাসভঙ্গকারী নারীটির কথা ভেবে ভেতরে ভেতরে রেগে উঠত। আবার শুভাশিষ দেবের কথা মনে হলে তাদের মন খারাপ হয়ে যেত এবং তারা ভাবত হয়ত শুভাশিষ দেব এখন কোথাও বসে জীবনানন্দ দাসের কবিতা পড়ছেন, সুরঞ্জনা, ঐখানে যেও নাকো তুমি, বলো না কো কথা ঐ যুবকের সাথে।
থানার ওসি সাহেব এলাকার লোকদের কথা মনযোগ দিয়ে শোনার পর শুভাশিষ দেবের স্ত্রীর সাথে কথা বলতে গেলেন। এরকম ঘটনা তিনি অনেক দেখেছেন। এই নগর সভ্যতার যুগে বিশ্বাস জিনিসটা দুষ্প্রাপ্য- ভাবতে ভাবতে তিনি শুভাশিষ দেবের স্ত্রীর কক্ষে প্রবেশ করলেন।
শুভাশিষ দেবের স্ত্রীর চেহারায় তখন শুকিয়ে আসা অশ্রুজলের রেখা বুঝা যাচ্ছে। ওসি সাহেব দেখলেন ঐ কক্ষে একটি যুবক ছেলে বসে আছে। সম্ভবত সে স্বান্তনা দিচ্ছিল। শুভাশিষ দেব বুঝতে পারলেন এই ছেলেটি সেই ছেলে। মনে মনে ভাবলেন দুজনকে একসাথে পেয়ে ভালোই হয়েছে।
ওসি সাহেব তার গুরুগম্ভীর মেজাজে শুভাশিষ দেবের স্ত্রী ও ছেলেটিকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করলেন। তার অভিজ্ঞ ভঙ্গি ও তীক্ষ্ণ প্রশ্নের স্রোতে ভেঙ্গে পড়লেন শুভাশিষ দেবের স্ত্রী। ছেলেটিও সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। তার চোখ মুখ হয়ে গেল ফ্যাকাসে।
ওসি সাহেবের মুখে হাসি ফুটল। নিজের কাজে আজ তিনি নিজেই মুগ্ধ। এই প্রথম একবারের জেরাতেই তিনি একটি খুনের কিনারা করে ফেললেন। তাও যেই সেই খুন না। শহরের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ীদের একজন ব্যক্তিকে খুনের কেস।
ওসি সাহেবের নির্দেশে শুভাশিষ দেবের লাশকে মর্গে পাঠানো হল। শুভাশিষ দেবের স্ত্রী ও তার দূর সম্পর্কের সেই ভাইকে পাঠানো হল জেলে। এলাকার লোকেরা কারিৎকর্মা ওসি সাহেবের কর্মদ্রুততায় মুগ্ধ হয়ে গেল। তারা তাকে বার বার ধন্যবাদ দিতে লাগল। তারা মনে মনে এই স্বান্তনা পেল যে খুনীরা তো ধরা পড়েছে।
কিন্তু আসলে কেউই জানতে পারল না শুভাশিষ দেব কেন মারা গিয়েছিলেন। কেন তিনি আকাশের দিকে মুখ করে লাফিয়ে পড়েছিলেন ছাদ থেকে। তার বাবা কি এমন কথা বলে গিয়েছিলেন তাকে মৃত্যুশয্যায়। কিছুই কেউ জানতে পারল না। সব রহস্যকে সাথে নিয়েই শুভাশিষ দেব লাফিয়ে পড়েছিলেন।
ছবিঋণ – obliqueapproach