সত্যজিৎ রায়ের গণশত্রু দেখলাম তার লাস্ট জন্মদিনে।
ফিল্মে একটা দৃশ্য আছে বুঝার মত, যখন ডাক্তার সৌমিত্র তার বউরে জিগান, তার মন্দিরে যাইতে ইচ্ছা করে কি না।
যারা দেখেন নাই তাদের জন্য ফিল্মের কাহিনী সারাংশ, শহরের মন্দিরের চরণামৃততে রোগের বীজাণু পাওয়া গেছে বলে ডাক্তার পরীক্ষা করে জেনেছেন। তিনি মন্দির বন্ধ করাতে চান কিছুদিনের জন্য। কিন্তু তার আপন ভাই ও প্রভাবশালীরা ওইটা চান না, কারণ মন্দির বন্ধ হলে মানুষের আসা কমে যাবে শহরে, তাদের ব্যবসায়িক লস হবে। ডাক্তার তার ভাইয়ের লগে তর্ক করছিলেন। ভাই ও শহরের প্রভাবশালী এক ব্যক্তি যুক্তি দিলেন, চরণামৃততে তুলশী পাতা ইত্যাদি থাকে তাই বিষ কেটে যায়।
বিজ্ঞান পড়া ডাক্তার যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারেন না। তার ভাই এই কুসংস্কার মানে দেখে।
এরপরের দৃশ্যে, কথাপ্রসঙ্গে ডাক্তার তার বউ মায়ারে জিগান, তুলশী পাতায় বিষ কেটে যায়, এমন কথা শুনেছ কখনো?
মায়া তখন গম্ভীর হইয়া যান, বলেন, ছোটবেলায় শুনেছি বাবার কাছে।
ডাক্তার বলেন, আশ্চর্য!
এরপর মায়া ডাক্তাররে একটা খোঁচা দেন, এখন তো বিজ্ঞান পড়া স্বামী হয়েছে, তখন তো ছিল না।
খোঁচা কেন দিলেন তিনি? এই বিষয়ে ডাক্তারের প্রতি তার এক অবদমিত ক্ষোভ ছিল।
এই খোঁচায় ডাক্তার সৌমিত্রের মনে অন্য একটা সন্দেহ আসে, তিনি ক্ষোভের টোন ধরে ফেলেন, পরিচালক সৌমিত্রের মুখের ক্লোজ শট নিয়া সেটা দেখান আমাদের। ডাক্তার তার বউরে জিগান, তোমার মন্দিরে যেতে ইচ্ছা করে না?
এই প্রশ্নে মায়া নীরব দাঁড়িয়ে থাকেন।
এই নীরবতা বলে তার ইচ্ছে করে।
পরে ডাক্তার বসা থেকে উঠে যান, আবার তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, মায়া আমার দিকে দেখো, সত্যি বলো তো, তোমার কী মন্দিরে যেটে ইচ্ছে করে না?
এইটা দেখায় ডাক্তারের কর্তৃত্ব, পাওয়ার। তিনি সরাসরি করতে গেছে। ক্যামেরায় তখন সামনে থাকে মায়ার স্যাড মুখ, পেছন থেকে যেন আগ্রাসী ডাক্তার সৌমিত্র।
মায়ার ভেতরের কনফিউশন বুঝা যায়।
তিনি বলেন, এই প্রশ্নটা আর কেন।
অর্থাৎ এর আগেও তাদের এ বিষয়ে কথাবার্তা হইছে।
ডাক্তার আবার বলতে জোর করেন।
মায়া তখন বলেন, এখন আর আমি আমি তোমার আর আমার আমার ইচ্ছার মধ্যে তফাত রাখতে চাই না।
এইটা জোর করে একটা ব্যাখ্যা দেয়া।
নাছোড়বান্দা একগুঁয়ে ডাক্তার আবার জিগান, আগে?
মায়া বলেন, তুমি ধর্ম টর্ম বিশ্বাস করো না, এই নিয়ে আমার কোন দুঃখ নেই। এক কালে ছিল মিথ্যে বলব না। কিন্তু এখন বুঝতে পারি একটা মানুষ এসব না মেনেও কত সৎ হতে পারে।
সৌমিত্র ডাক্তার খুশি হয়ে যান। কথা এখান থেকে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়।
গল্পের ডাক্তার সৌমিত্র ভালো মানুষ এতে সন্দেহ নাই। তিনি তো নায়কই এখানে। কিন্তু এই দৃশ্যে মায়ার দিকটাও দেখান পরিচালক, এই ভালো মানুষটার ভালো মানুষীর পাওয়ারে তার স্ত্রী মায়া নিজ ইচ্ছারে বিসর্জন দিতে বাধ্য হইছেন, এবং ওইটা মনে করে তিনি স্যাডও। স্বামী স্ত্রীর পাওয়ারের ডায়নামিকসও আমরা দেখি। যুক্তিবাদী ডাক্তারের কাছে ইমোশনাল মায়ার পরাজয় দেখি।
মায়ার মন্দিরে যাবার ইচ্ছায় সৌমিত্র হয়ত সরাসরি বাঁধা দেন নাই। কিন্তু, তার একটা উহ্য পাওয়ার আছিল, যা মায়ার স্বাধীনতারে গ্রাস করে নিছে। এটা দেখাইতেই সত্যজিৎ ডিটেইলে দৃশ্যটা দেখান।
সৌমিত্রের পরিবার কেমন ছিল তার এক আভাস মিলে, তার মেয়ে যখন পত্রিকা অফিসে গিয়ে সম্পাদকের লগে আলাপ করেন। সম্পাদক তারে একটা গল্প অনুবাদ করতে দিছিলেন। তিনি বইটা ফেরত দিয়ে বলেন, এটা অনুবাদ করবেন না। খুবই বাজে গল্প। অবাস্তব সব কথা লেখা এই গল্পে, যা পত্রিকাটির আদর্শের সাথে যায় না।
অর্থাৎ, ডাক্তারের মেয়েটি গল্পের মধ্যেও র্যাশনালিটি খুঁজেন। এই ফিল্মটা বানাইছেন কে? শঙ্কুর লেখক! এই জায়গায় হয়ত দর্শক ভাববে তিনি পক্ষ নিছেন ডাক্তারের মেয়ের, বা র্যাশনালিজমের, কিন্তু আসলে এখানে সত্যজিৎ ক্রিটিক করছেন। সম্পাদক এই কথা শুনে যে হা হা করে হাসে, ওইটা সত্যজিতের হাসি ধরা যায়, যে এরা গল্পের মধ্যেও র্যাশনালিজম খুঁজে। কিন্তু এই দৃশ্যটা আনা হইছে সৌমিত্র ডাক্তারের ঘরের পরিবেশ কেমন ছিল তা আরেকটু বুঝাইতে। মেয়েরে তিনি তার আদর্শেই বড় করছেন।
মায়ার জন্য সত্যজিৎ যে মায়া দেখাইলেন, তার দিকটাও দেখাইলেন সূক্ষ্মভাবে, এইটা তার র্যাশনালিজমের ক্রিটিক।