সম্পদ এবং টাকা এক নয়। টাকা হইল একটা মূল্যমান। যা প্রচলিত হইছে বিনিময় প্রথারে আরো সশৃঙ্খল করার জন্য।
একজন কলা উৎপাদন করল। আরেকজন লাউ। তারা একে অন্যের জিনিশ বিনিময় করত প্রথমদিকে। পরে দেখা গেল এতে একটা ঝামেলা থাকে। লাউ উৎপাদনকারীর কলার চাহিদা না থেকে পটলের চাহিদা থাকতে পারে। আবার কলা উৎপাদনকারীর লাউয়ের চাহিদা না থেকে মুরগীর চাহিদা থাকতে পারে। এইজন্য সহজ এক বিনিময় মাধ্যম বাইর করা হইল। ধাতব মুদ্রা। যা বর্তমানে টাকা বা ডলার। যাতে তারা সকলে একটা বৃহত্তর সিস্টেমের ভিতরে বিনিময় চালাইয়া যাইতে পারে এবং নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসাদি পায়।
কিন্তু টাকা মানেই সম্পদ নয়। সম্পদ আপনে তৈরী করতে পারবেন। সেই সম্পদ বিক্রি কইরা টাকা জমাইতেও পারবেন। কিন্তু কোন দেশের বেশী টাকা থাকলেই তারে ধনী বলা যায় না; যদি যেই প্রোডাক্ট দেশের মানুষেরা কিনতে চান টাকা দিয়া তার স্বল্পতা উপস্থিত থাকে। তাহলে বেশী টাকা কেবল দামই বাড়াবে।
সম্পদ হইল কাপড়, কম্পিউটার, টুথব্রাশ, কমোডের ফ্ল্যাশ, পর্যটন স্পট ইত্যাদি। যেসব সম্পদ প্রয়োজন তার সব যদি আপনি পাইয়া যান আলাদিনের কোন দৈত্যের সাহায্যে, তাহলে আপনার টাকা না থাকলেও চলবে। আবার, আপনার কাছে যদি দুনিয়ার সব টাকা থাকে আর আপনি এমন জায়গায় থাকেন যেখানে প্রয়োজনীয় জিনিসেরা নাই, তখন আপনার ঐ টাকাগুলা মূল্যহীন।
সম্পদ তৈরী করা বলতে কী বুঝায়? যেমন ধরেন একটা সফটওয়ার আপনে বানাইলেন। এটা সম্পদ। একটা মাটির পাত্র বানাইলেন কুমার। এটা সম্পদ।
একটা দেশ উন্নত বা ধনী হয় এই সম্পদ বানানোর উপর ভিত্তি কইরা। সম্পদ বানান কারা? উদ্যোক্তারা সাধারনত। এজন্য আমেরিকায় উদ্যোক্তা সংস্কৃতিরে তারা প্রমোট করে। তারা মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্জয় কাটাইয়া উঠতে পারে। তাদের পৃথিবীর ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে সরানো যায় না। তারা ধনী। কারণ তারা এটা বুঝে সম্পদ তৈরী করাই হইল আসল কথা।
একটা দেশের দুর্নীতি যদি উদ্যোক্তাদের সম্পদ তৈরীতে বাঁধা হইয়া দাঁড়ায়, তখন সেই দেশ ধনী হইতে পারে না। সেই দেশের অবস্থা হইয়া যায় সামন্তবাদের মত। যেখানে সামন্তরা অন্য কাউরে ধনী হইতে দিত না। তাদের সম্পত্তি গ্রাস করত।
আমাদের এই অঞ্চলে পূর্ন সামন্তবাদ ছিল না ইউরোপের মত। এমন কথা বলেছিলেন প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক আহমদ ছফার যদ্যপি আমার গুরুতে। তিনি উদাহরন দিছিলেন মনসামঙ্গল কাব্যের চাঁদ সদাগরের। এই ক্যারেক্টার এত ঋঝু, এত প্রবল যে এর উদাহরন দিয়া সমাজ বিজ্ঞানী রাজ্জাক বলেন, সামন্তবাদ থাকলে এমন ক্যারেক্টার তৈরী হইত না ঐ সময়ের সাহিত্যে।
এই উদাহরন বুঝতে হবে মনসামঙ্গল কাব্য দিয়া। মনসা প্রতাপশালী দেবী। তিনি নিজের পুজা চান চাঁদ সদাগরের কাছ থেকে। সদাগর বলেছেন পূজা দিবেন না, তিনি তার কথায় অনড়। দেবী তারে নানা বিপদ দেন। তবুও সদাগর ভাঙ্গেন না।
এই মনসা দেবী হইলেন সামন্ত প্রতীক যে একটা ব্যবশায়ীরে করায়ত্ত্ব করতে চায়। কিন্তু ঐ ব্যবশায়ীর মনের বল এত যে প্রতাপশালী দেবীরে তিনি কেয়ার করেন না। নত হইতে তিনি জানেন না।
এই দিক থেকেই বলা যায়, ইউরোপে সামন্তবাদের কালে সামন্তদের যে প্রতাপ ছিল ব্যবশায়ীদের উপর, তা এখানে ছিল না। চাঁদ সদাগরেরা ব্যবশা করতে পারতেন। বা তারা শুরু থেকেই বিবাদে জড়াইয়া গেছিলেন, সামন্তদের সামন্তগিরি মানতে চান নাই। যেটা ইউরোপে হইছে সামন্তবাদ পতনের দিকে। ব্যবশায়ীরা এবং তাদের সাথের লোকেরা জড়ো হইয়া যখন সামন্তদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান।
এই বঙ্গে এটা শুরু থেকেই ছিল হয়ত। এইজন্যই সামন্তবাদ ইউরোপের মত ছিল না এখানে, এটা বলা যায়।
ইউরোপে সামন্তবাদের পতনের পরে ব্যবশায়ীরা ধনী হইয়া তাদের ধন উপভোগ করার সুযোগ পাইলেন। তখন তা ধীরে ধীরে যায় শিল্প বিপ্লবের দিকে। মানুষ যখন নিজের ধন নিজে উপভোগ করার সুযোগ পাবে, কেউ তার কাছ থেকে কেড়ে নিবে না অর্জিত সম্পদ, সে নিরাপত্তা পাবে; তখন সে সম্পদ তৈরীর জন্য খাটবে। এতে বৃদ্ধি পাবে দেশের মোট সম্পদ, দেশ হবে ধনী।
কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের কারণে যেটা হয়, মানুষের সম্পদ তৈরী করার আগ্রহ কমে যায়। ফলে মোট সম্পদ উৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস পায়। কম্যুনিস্ট রাষ্ট্র এটা করে অর্থনৈতিক সমতা বিধানের জন্য। ভালো উদ্দেশ্য কিন্তু তা ভালো ফল আনে না। সবচেয়ে ভালো হইল, মানুষের সম্পদ তৈরীর প্রতিযোগীতা এবং অর্থনৈতিক সমতা এই দুইয়ের মধ্যে একটা ভারসাম্যের তৈরী করা। তাহলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি বজায় থাকবে।
মোটকথা, মানুষরে সম্পদ তৈরী করার পরিবেশ দিতে হবে। নিজ সম্পদ উপভোগের সুযোগ দিতে হবে। এ ব্যাপারে উৎসাহ বাড়াইতে হবে, যদি কোন দেশ আসলেই ধনী হইতে চায়।