সিএনজির পাছানুসন্ধান

CNG

রাস্তায় পাছাবান এবং পাছাবতী সিএনজি দেখা যায়। তারা পাছা নিয়ে চলে যায় নিজস্ব গতিতে। যেহেতু তারা কিম কার্দেশিয়ান বা সেরকম কেউ না, তাই তাদের পাছায় লোকের আগ্রহ কম। গাঢ় সবুজ বর্নের এইসব সিএনজির দেহকে ভাগ করা যায় তিনভাগে। প্রথমে সিএনজির মুখ। সেখানে বসেন ড্রাইভার। তার দু’পাশে দুজন আরোহী। এর পিছনে থাকে সিএনজির পেট। সেখানে আরো তিনজন লোক বসতে পারেন। এরপরের অংশ সিএনজির পাছা। যেখানে মালামাল রাখা হয়।

cng gothon

এ গেল সিনএজির পাছার ভেতরের খবর। বাইরের দিকে তার পাছা আরো ইন্টারেস্টিং। সেখানে বিভিন্ন ধরণের কথাবার্তা লেখা থাকে। কোন কথা ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে পূর্ন, কোন কথা পূর্ন আবেগী ভালোবাসায়। আর কোন কোন কথায় আছে অনুরোধ কিংবা উপদেশ।

কোন এলাকার সিএনজির পাছা দেখে ধারণা পাওয়া যায় সে অঞ্চলের মানুষের মন মানসিকতা কীরকম অথবা তারা কীভাবে চিন্তা করেন। একবার আমি দেখেছিলাম একটা সিনএজির পেছনে লেখাঃ

গ্যাসেতে চলে গাড়ি পানিতে নয়

ভালোবাসা বাড়িতে গাড়িতে নয়

এই কাব্যিক লাইনগুলো থেকে বুঝা যাচ্ছে এই সিএনজির মালিক গাড়িতে ভালোবাসা বিরোধী। আরো ধারণা করে নেয়া যায়, সেই অঞ্চলে সিএনজিতে ভালোবাসা চলে। যদি না চলত তাহলে এই উপদেশের কোন দরকার ছিল না।

একদিন বিকাল সাড়ে তিনটায় সিএনজির পাছার লেখাগুলো দেখতে বের হয়েছিলাম। আম্বরখানা, জালালাবাদ, পুলের মুখ ইত্যাদি জায়গায় দাঁড়িয়ে কৌতুহলের সাথে গমনরত সব সিএনজির পাছা প্রত্যক্ষ করলাম। সিএনজিদের প্রাণ নাই, তাই তারা কোন আপত্তি করে নি।

বেশিরভাগ সিএনজির পেছনে লেখা ধর্মীয় কথাবার্তা। যেমন, ফি আমানিল্লাহ। আল্লাহ সর্বশক্তিমান। মা শা আল্লাহ। নামায কায়েম করুন। নামায বেহেশতের চাবি। খোদা হাফেজ। ভয় নাই সংকটে, আল্লাহ আছেন নিকঠে। নিজে নামায পড়ুন, অন্যকেও নামায পড়তে বলুন। নিশ্চয়ই নামায অশ্লীল কাজ হইতে বিরত রাখে। আপনার শিশুকে ইসলামী শিক্ষা দিন। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর নির্ভর করে তাহার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। ধৈর্য এবং নামাযের দ্বারা আলাহর কাছে সাহায্য চাও।

এখন ধরা যাক সিলেট সম্পর্কে আমার কোন ধারনা নাই। আমি একজন এলিয়েন সিলেটে এসেছি এবং অবাক বিস্ময়ে পাছা নিয়ে চলে যাওয়া সিএনজিদের দিকে তাকিয়ে তাদের পেছনে থাকা লেখাগুলো পড়ছি।

এগুলো দেখে আমি কী সিদ্ধান্তে আসতে পারি?

এই অঞ্চলের মধ্যবিত্ত ধর্মকে গুরুত্ব দেয়। বিশেষত ইসলাম ধর্মের বেশ ভালো প্রভাব রয়েছে এই এলাকায়।

ধর্মীয় বানীগুলোর একেবারে ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে চলেছে যে বানীগুলো সেগুলো হচ্ছে, মায়ের দোয়া। মা বাবার দোয়া।

যদি মায়ের দোয়া টাইপের বানীগুলো এক অর্থে ধর্মীয় বানীর কাতারে ফেলা যায় তথাপি দুই ধরনের বানীর মধ্যে এক সূক্ষ্ণ পার্থক্য রয়েছে । মায়ের দোয়া টাইপ বানীগুলোতে ধর্মের সাবজেক্টিভ দিক গুরুত্ব পেয়েছে। এই ধরনের বানীগুলোকে ধরা যায় অবজেক্টিভ বিশ্বাসের বিপরীতে একটি সাবজেক্টিভ বিশ্বাসের রূপ হিসেবে।

সি এন জি

আল্লাহর দান মায়ের দোয়া লেখাও দেখা যায় অনেক সিএনজিতে। এর দ্বারা ধর্মের সাবজেক্টিভ, অবজেক্টিভ দুই দিকই উঠে এসেছে। তবে এগুলোর ঠিক নিচে দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞাপন। এর দ্বারা বুঝা যায় সাম্প্রতিককালে এই অঞ্চলের মানুষের ধর্ম বিশ্বাস এবং সংস্কৃতির উপরে পুঁজিবাদী সংস্কৃতি আসন করে নিচ্ছে।

আরেকটি কথা খুব বেশি দেখা যায়, সেটা হল – বিবেক মানুষের সর্বোচ্চ আদালত। এই কথাটা গুরুত্বপূর্ন কারণ মানুষ তার অপরাধবোধে আক্রান্ত বিবেক নিয়ে কীভাবে জীবন যাপন করে যায় তা এক জটিল এবং ইন্টারেস্টিং বিষয়।

এই বানীর মেসেজ টা হল, তুমি সবাইকে ফাঁকি দিতে পারলেও নিজেকে (নিজের বিবেককে) ফাঁকি দিতে পারবে না। যা আল পাচিনো থেকে হারুকী মুরাকামি ইত্যাদি অনেক জ্ঞাণী গুনিরাই বলে থাকেন।

আরো দারুণ সব কথাবার্তা পাছায় নিয়ে দেখা যায় সিএনজিরা চলে যাচ্ছে স্বগর্বে। সেসব বানীদের মধ্যে আছে, যে মুখে মা, সে মুখে মাদক কেন?

এই বানী থেকে বুঝা যায় মাদকাসক্তি এই অঞ্চলের এক নিরব সমস্যা।

অসৎ আনন্দের চেয়ে সৎ বেদনা ভালো। যার হাতে মানবতার উপকার হয়, তিনিই উত্তম পুরুষ। একটি দূর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না। মিথ্যা বলা মহাপাপ। যে ক্ষমা করে সেই মহৎ। সুষ্ঠু পরিকল্পণার উপর কাজের সফলতা নির্ভর করে। সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। অন্যের উপকার করতে না পারলে তার ক্ষতি করো না। লজ্জার মৃত্যু থেকে অপরাধের জন্ম। মানুষ মানুষের জন্য।

কিছু বানীর কাউন্টার বানীও দেখা যায়। যেমন-

শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। ইসলামি শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড।

আপনার শিশুকে স্কুলে পাঠান। আপনার শিশুকে মাদ্রাসায়/মক্তবে পাঠান।

এই বানীগুলোর মধ্যেও এই অঞ্চলের লোকদের ধর্ম প্রিয়তার পরিচয় পাওয়া যায়। শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড বানীটি যদি সেক্যুলার বানী হয় তাহলে এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে উদ্ভুত বানীটি তার বিপরীত ধ্যান ধারণা পোষণ করে। সরাসরি সেক্যুলারিজম বিরোধী একটা বড় অংশ আছে আমাদের দেশে। তারা এ নিয়ে বিভিন্ন সময় বক্তৃতা দেন, আন্দোলন করেন। সেক্যুলারিজমের সমর্থকেরা আছেন। তারা তাদের মত করে লিখেন বা আন্দোলন করেন। এইসব ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কিন্তু সিএনজির পাছাতেও যে এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যেকার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তা ভালোভাবে লক্ষ্য না করলে বুঝা সম্ভব না।

যাই হোক, বিভিন্ন ধরনের বানীর মধ্যে উপদেশ বানীই প্রধান। তবে ইদানীংকালের সিএনজি গুলোর পাছাতে বানী টানী থাকে না। পাছার উপরে সিলের মত লেখা থাকে এফআইভিডিবি। বানীহীন এসব সিএনজিগুলোকে খালি খালি মনে হয়।

বানীর পরিবর্তে বিজ্ঞাপনের স্টিকারও দেখা গেছে অনেক সিএনজিতে। সেটা আরো খারাপ। পাছায় বিজ্ঞাপন লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো অশোভন ব্যাপার।

প্রায় ঘন্টা দুয়েক সিএনজি পাছা পর্যবেক্ষণ কর্মে সবচেয়ে দারুণ যে বানীটি দেখা গেল সেটি হচ্ছে-

ও চাঁদ তোমার মত আমিও একা।

এই কথাটার মধ্যে এক ধরণের বিষাদ বিষাদ গন্ধ আছে। জীবনানন্দ দাস টাইপের। সেই সিএনজি কী চাঁদের মত একা একা রাত জাগে? কিংবা পাবলো নেরুদার ট্রেন যেমন বৃষ্টিতে ভিজত সেইরকম ভিজে একা? নেরুদা নির্জন ভেড়ার দুঃখকে কী বলে সেই প্রশ্ন করেছিলেন। সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গিয়েছিল কী না জানি না। কিন্তু তবুও প্রশ্ন চলে আসছে এই নিঃসঙ্গ এবং নিজেকে চাঁদের মত একা মনে করা সিএনজির দুঃখকে কী বলা হবে?

এইসব বিভিন্ন প্রশ্ন চলে আসতে থাকে সিএনজির পিছনের বানীটির পাঠ পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায়। প্রতিটি মানুষের ভেতরেই একাকীত্বের অনুভব আছে। একাকীত্ব ছাড়া মানবজীবন অর্থহীন। একা না থাকলে মানুষ যে জীবন যাপন করে সেটা অন্য এক জীবন, যার সাথে সম্পূর্ণ একা জীবন অনুভবের ভিন্নতা আছে। অবশ্য একাকীত্ব এবং মানুষ-পশুপাখির সঙ্গ দুইটাই মানুষের প্রয়োজন। সিএনজির ক্ষেত্রেও তাই হবে হয়ত। অথবা যিনি লেখিয়েছেন তার।

ব্রুস লি এই একাকীত্ব নিয়েই বলেছেন –

“Loneliness is only an opportunity to cut adrift and find yourself. In solitude you are least alone.”