সুকুমার রায়ের অস্তিত্ববাদী কবিতা “জীবনের হিসাব”

সুকুমার রায়ের কবিতা “জীবনের হিসাব”এ দেখতে পাওয়া যায় একজন বিদ্যে বোঝাই বাবু মশাই নৌকায় চড়ে বসেন। সেখানে মাঝির সাথে তার কথোপকথন হয়। মূলত মাঝি এবং তার কথোপকথনকে কেন্দ্র করে এই কবিতা বা ছড়া।

বাবু মশাই একজন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদী মানুষ।  সূর্য কেন ওঠে, জোয়ার কেন আসে, সাগরের পানিতে লবন কেন, আকাশ নীল দেখায় কেন, সূর্য চাঁদে গ্রহণ লাগার কারণ ইত্যাদি কঠিন সব জ্ঞাণ তিনি আয়ত্ত্বে এনেছেন। মহাবিশ্বের সমগ্র জ্ঞাণরাজির মধ্যে যুক্তিবাদ বা র‍্যাশনালিজম অথবা বৈজ্ঞানিক জ্ঞাণ একটা অংশ।  জ্ঞাণের অসংখ্য শাখা প্রশাখার মধ্যে একটি শাখা মাত্র।

বাবু মশাই এই বিষয়টি মাথায় রাখতে পারেন নি। তিনি তার বৈজ্ঞানিক জ্ঞাণ বা যুক্তিবাদের জ্ঞাণকেই সর্ব উৎকৃষ্ট এবং সর্বজ্ঞাণের মধ্যে উত্তম জ্ঞাণ বলে মনে করেন। মাঝি একজন অশিক্ষিত লোক বলে বৈজ্ঞানিক জ্ঞাণ তার অল্প। এবং সেটা খুব স্বাভাবিক।

বাবু মশাই সেটা জেনেও মাঝিকে প্রশ্ন করে বিব্রত করেন। এখানে র‍্যাশনালিস্ট বা বৈজ্ঞানিক জ্ঞাণযুক্ত বাবু মশাইয়ের নিচু মানসিকতার পরিচয় পাওয়া। তিনি তার অর্জিত জ্ঞাণের অহংকারে অন্ধ হয়ে, মাঝির অন্য শ্রেণীর অর্জিত জ্ঞাণকে (যেমন নৌকা চালানো) তাচ্ছিল্য করে তাকে প্রশ্ন করে বিব্রত করতে থাকেন।

এক পর্যায়ে মাঝিকে মূর্খ বলেন। বলেন তার জীবনের বারো আনাই মিছে।

তারপর দেখা যায়, ঝড় আসে। নৌকা দুলতে থাকে বাতাসে। বাবু মশাই তখন ভীত হন। মাঝি তখন জিজ্ঞেস করে তিনি সাঁতার জানেন কী না। তিনি না সূচক উত্তর দেন। তখন মাঝি প্রতিশোধমূলকভাবে বলে বাবু মশাইয়ের জীবন ষোল আনাই মিছে।

Jibanerhishab

মাঝির এই উক্তি বাবু মশাইয়ের প্রতি লেখকেরই উক্তি।

লেখক এর মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক জ্ঞাণের ভারে অহংকারী বাবু মশাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন বৈজ্ঞানিক জ্ঞাণ তার জীবনকে পূর্নতা দিতে পারে নি।

এখানে মাঝি সাতার জানে কী না পাঠকের জানার উপায় নেই। তবে বাস্তববুদ্ধি ব্যবহার করে বলা যায় যেহেতু সে মাঝি অতএব সে সাঁতার জানে। তবে মাঝির সাঁতার জানা এবং বাবু মশাইয়ের সাঁতার না জানা একটা রূপক বিষয়।

সুকুমার রায় এখানে বৈজ্ঞাণিক জ্ঞাণ, যুক্তিবাদই যে সকল জ্ঞাণের মূলমন্ত্র নয় সেদিকে ইঙ্গিত করেছেন।

ব্যক্তিকে ঘিরে আছে যে বাস্তব জীবন বা পরিবেশ সেটা হচ্ছে প্রকৃত অস্তিত্ব। প্রকৃত অস্তিত্বকে অনিত্য অস্তিত্বও বলা হয়। আর ব্যাক্তির ভেতরে যে সুপ্ত সম্ভাবনা রয়েছে তাকে বলে অপ্রকৃত বা নিত্য অস্তিত্ব। এই নিত্য অস্তিত্বের মূলে আছে কোন শক্তি যা ব্যাখ্যাতিত।

প্রতিনিয়ত ব্যক্তিরূপে আমাদের যে জীবন যাপন, তা বাস্তব পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত এবং অসার। এখানে নিজের শক্তির কোন প্রকাশ নেই। কিন্তু সংকটকালে হঠাৎ মানুষের মধ্যে এক অস্তিত্ব আকস্মিকভাবে উপস্থিত হয়। যা জ্ঞাণ বুদ্ধির বাইরে।

অস্তিত্ববাদের দর্শন এমনই বলে থাকে।

মাঝির শেষ জিজ্ঞাসা এবং বাবু মশাইয়ের উত্তরের সাপেক্ষে তার শ্লেষাত্মক উক্তির মধ্য দিয়ে আমরা মাঝির অস্তিত্বের স্ফুরণ দেখতে পাই। এবং সেখানে ম্রীয়মান হয়ে পড়ে বাবু মশাইয়ের জাগতিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞাণ। ভাববাদ, জড়বাদ ইত্যাদি দর্শনগুলোর যে সমালোচনা করে গেছেন অস্তিত্ববাদী দার্শনিকেরা, সুকুমার রায়ের এই কবিতা যেন সেসবেরই মত এক প্রয়াস।

ছবিঃ সুকুমার রায়

 

ষোল আনাই মিছে

– সুকুমার রায়

বিদ্যে বোঝাই বাবুমশাই চড়ি সখের বোটে,
মাঝিরে কন, বলতে পারিস সূর্যি কেন ওঠে?
চাঁদটা কেন বাড়ে কমে? জোয়ার কেন আসে?
বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফ্যালফ্যালিয়ে হাসে।
বাবু বলেন, সারা জীবন মরলিরে তুই খাটি,
জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি।
খানিক বাদে কহেন বাবু, ”বলতো দেখি ভেবে
নদীর ধারা কেমনে আসে পাহাড় থেকে নেবে?
বলতো কেন লবণ পোরা সাগর ভরা পানি?”
মাঝি সে কয়, ”আরে মশাই অত কি আর জানি?”
বাবু বলেন, ”এই বয়সে জানিসনেও তা কি
জীবনটা তোর নেহাৎ খেলো, অষ্ট আনাই ফাঁকি!”

আবার ভেবে কহেন বাবু, ” বলতো ওরে বুড়ো,
কেন এমন নীল দেখা যায় আকাশের ঐ চুড়ো?
বলতো দেখি সূর্য চাঁদে গ্রহণ লাগে কেন?”
বৃদ্ধ বলে, ”আমায় কেন লজ্জা দেছেন হেন?”
বাবু বলেন, ”বলব কি আর বলব তোরে কি তা,-
দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।”

খানিক বাদে ঝড় উঠেছে, ঢেউ উঠেছে ফুলে,
বাবু দেখেন, নৌকাখানি ডুবলো বুঝি দুলে!

মাঝিরে কন, ” একি আপদ! ওরে ও ভাই মাঝি,
ডুবলো নাকি নৌকা এবার? মরব নাকি আজি?”
মাঝি শুধায়, ”সাঁতার জানো?”- মাথা নাড়েন বাবু,
মূর্খ মাঝি বলে, ”মশাই, এখন কেন কাবু?
বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে,
তোমার দেখি জীবন খানা ষোল আনাই মিছে!”