আধুনিকতার একটা ব্যাপার হল মানুষদের মনে নিত্য নতুন চাহিদা উসকে দেয়। মিডিয়া এবং আরো নানা মাধ্যমে এই উসকানোর কাজ চলে। এবং আধুনিক মানুষেরা অনুভব করতে থাকে তাদের ভেতরে জন্ম নিচ্ছে নতুন চাহিদা, ভোগ বিলাশ কিংবা খ্যাতির আকাঙ্খা। মানুষের ভোগের আকাঙ্খাও যেন অন্যের দ্বারা নির্দেশিত। মিডিবাজির যুগে বলা হচ্ছে অমুক জিনিস তোমার দরকার, অমুক জিনিস ভোগ করার জন্য তোমার লালায়িত হওয়া উচিত কিংবা ঐ ঘটনায় তোমার দুঃখ পেয়ে রাঙানো উচিত ফেসবুকের ছবি। মানুষ এগুলো বিশ্বাস করছে, মনে স্থান দিচ্ছে। তাদের যেভাবে বুঝানো হচ্ছে সেভাবে তারা ভোগাকাঙ্খায় তাড়িত হচ্ছে কিংবা দুঃখে হচ্ছে দুঃখিত।
এই চাহিদা, ভোগাকাঙ্খা কিংবা দুঃখবোধ অন্যের চাপিয়ে দেয়া। মানুষ হিসেবে একজন মানুষের আলাদা অস্তিত্ব আছে এবং সে তার নিজেকে সম্মান করে অন্যের চাপিয়ে দেয়া বিষয়গুলো দ্বারা পরিচালিত হবে না, এমনটা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মানুষের ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদ বা তার নিজের অন্তঃস্থ ইচ্ছা অথবা চাওয়া সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়ার সময় কোথায়?
খ্যাতি এবং বিশেষ হবার বাসনার চাইতে নিজেকে বুঝতে পারাটাই মানুষের শান্তির জন্য বেশী দরকারী।
এ নিয়ে দুজন মানুষের গল্প করা যাক। যাদের বিশেষত্ব হল তারা খ্যাতি বা অর্থের চাইতে নিজেদের শান্তিকে বেশী প্রাধান্য দিয়েছেন। প্রথম জন দক্ষিণ কোরিয়ার কিম উং-ইয়ং।
কিম উং-ইয়ং জন্মের ছয়মাস পরেই কথা বলা শুরু করেছিলেন। তিনি স্পঞ্জের মত বিভিন্ন ভাষা শোষন করে নিতে পারতেন। একেবারে গ্রামার ট্রামার সহ। গিনেস বুকের হাইয়েস্ট আইকিউ লিস্টে জায়গা তার, ২১০!
তিন বছর বয়সে হানইয়াং ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্সের ক্লাসে যেতে শুরু করেন। চার বছরের মধ্যে শিখে ফেলেন কোরিয়ান, জাপানিজ, জার্মান, ইংরেজি ভাষা। বয়স চার থাকাকালীন সময়েই জাপানিজ এক টিভির লাইভ শো’তে জটিল সব গাণিতিক সমীকরণের সমাধান করে দর্শকদের তাক লাগিয়ে দেন।
আট বছর বয়সে নাসা থেকে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় আমেরিকায়। সেখানে তিনি কলোরাডো স্টেটে মাস্টার্স ও পিএইচডি করেন।
তারপর হয়ে যান নাসার একজন নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী ও রিসার্চার। ৫ বছর কাজ করেন। তখন তার বয়স মাত্র ষোল বছর! তখনই তিনি জীবনের এক অন্য অর্থ খুঁজে পান এবং আমেরিকা ছেড়ে দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন।
ষোল বছর বয়সে কোরিয়ায় ফিরে এসে অখ্যাত একটা ইউনিভার্সিটিতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ভর্তি হন। তার হাইস্কুল ডিগ্রী ছিল না। তাই মোটামোটি নামহীন একটা ইউনিভার্সিটিতে জিইডি টেস্ট দিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি কিছুদিন খুব সাধারন অফিসে চাকরি করতেন। তাই ধীরে ধীরে কোরিয়ার মানুষ তার কথা ভুলে যায়। মিডিয়া তাকে অভিষিক্ত করে ফেইল্ড জিনিয়াস নামে!
একটা ইন্টারভিউ এ তিনি বলেছিলেন- “আমি কোন জিনিয়াস না। আমি শুধু কিছু জিনিস খুব দ্রুত শিখতে পারতাম। আমেরিকা থেকে ফিরে এসে আমি যে কাজ আমার পছন্দ তাই করতে শুরু করি। আগে আমি ধ্বংসাত্বক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছিলাম। এখন আমার নতুন মেজর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং হচ্ছে উপকারী কিছু তৈরী করা। আমি তা উপভোগ করি। এটা ঠিক অনেকে বলে তুমি ইয়েল কিংবা হার্ভাডের প্রফেসর হতে…কিন্তু আমি আবার বলবো আমি এখন যে পর্যায়ে আছি তা নিয়ে আমি সর্বোচ্চ সুখী।”
ইন্টারভিউয়ের প্রশ্নকর্তা আবার জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু আসলে আপনি ছেড়ে এসেছিলেন কেন?
কিম উং ইয়ং – “সুখী হওয়ার জন্য। যখন আমি আমেরিকায় ছিলাম তখন আমি শুনেছিলাম আমি খুব প্রতিভাবান। কিন্তু আমি বুঝতে পারতাম না ঠিক কি কারণে আমি প্রতিভাবান। এক বিভাগে বিশটা ভিন্ন ভিন্ন রিসার্চ ল্যাব ছিল। কিন্তু আপনি বুঝতে পারবেন না আপনার পাশের রুমটিতে কি হচ্ছে। সেখানে গোপনীয়তা ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের। সম্ভবত সবচেয়ে যে গভীর যে সমস্যাটি ছিল তা হল একজন ছোট বালকের কথা শোনার মত সেখানে কেউ ছিল না। আমি পালানোর কোন পথ দেখতাম না। আমার মনে হয় আমার তখনকার অবস্থা এবং এই যে কিছুদিন আগে কেআইএসটি এর ছাত্ররা যে আত্মহত্যা করল তাদের মতই ছিল।”
[Korea Advanced Institute of Science and Technology (KAIST) তে ২০১০ সালে কিছু ছাত্র আত্মহত্যা করেছিল।]
এখন কিম ইয়ং এর বয়স ৫২। তিনি সম্প্রতি ফুলটাইম প্রফেসর হয়ে তার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছেন। তিনি এখন নিভৃতে মিডিয়ার আড়ালে থাকেন এবং তার তরুণ ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে কাজ করেন।
তিনি বলেন, “যখন আমি মাঠে আমার ছেলের সাথে ফুটবলে কিক নেই কিংবা কাজ শেষে কলিগদের সাথে ড্রিংক করতে বসি… তখনি আমি হয়ে যাই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।”
পরের গল্প একজন রাশিয়ান গণিতবিদের। তার নাম গ্রেগরি পেরেলম্যান। গণিতে পোয়েনকেয়ার কঞ্জেকচার নামে এক জটিল সমস্যা ছিল ১৯০৪ সাল থেকে। পেরেলম্যান একশো বছরের পুরনো এই জটিল সমস্যার সমাধান করে ফেললেন। গণিতের এই সমস্যাটি ছিল সাতটি অন্যতম জটিল সমস্যাদের একটি যার সমাধানের জন্য আমেরিকার ক্লে ফাউন্ডেশন এক মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষনা করে বসে আছে।
২০০৬ সালে তাকে গণিতের সর্বোচ্চ পুরস্কার ফিল্ডস মেডেল দেয়া হল।
কিন্তু তিনি তা নিলেন না। আন্তর্জাতিক গণিত ইউনিয়নের সভাপতি গেলেন তার সাথে দেখা করতে। দুইদিনে দশ ঘন্টা বুঝালেন। কিন্তু পেরেলম্যান পুরস্কার নিলেন না। তার কথায়;
“আমাকে তিনি তিনটি উপায় বলেছিলেন, এক- আসো এবং গ্রহণ করো , দুই- এসো না কিন্তু গ্রহণ করো, আমরা মেডেল পরে পাঠিয়ে দেব, তিন- গ্রহন না করা। প্রথম থেকেই আমি বলে আসছি আমি তৃতীয়টা বেছে নিয়েছি। পুরস্কার আমার জন্য পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক। সবাই এটা বুঝতে পেরেছে যে সমাধান যদি ঠিক হয় তাহলে আলাদা স্বীকৃতির কোন দরকার নেই।”
তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি এই সম্মানজনক পুরস্কার নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
তিনি বললেন, “আমি টাকা কিংবা খ্যাতির ব্যাপারে আগ্রহী নই। আমি চিড়িয়াখানার প্রাণির মত প্রদর্শিত হতে চাই না। আমি গণিতের কোন মহানায়ক নই, আমি তেমন সফলও নই। এই কারনে আমি চাই না সবাই আমার দিকে তাকিয়ে থাকুক।”
পেরেলম্যানের সমাধানের জন্য ক্লে ফাউন্ডেশন প্রথম ক্লে মিলিনিয়াম পুরস্কার দিতে চাইল। অর্থমূল্য এক মিলিয়ন ডলার।
পেরেলম্যান দরজা পুরোপুরি না খুলে ভেতর থেকেই জানিয়ে দিলেন, “আমার যা দরকার তার সবই আমার আছে।”
প্রতিবেশীদের বয়ানে তার ঘর নোংরা এবং তেলাপোকাদের নির্ভয় আবাসস্থল। সেখানে জিনিসত্রের সংখ্যাও নগন্য।
এরকম লোক খুঁজলে আরো হয়ত পাওয়া যাবে। এদের মধ্যে হয়ত সিনিক গন্ধ আছে। ডায়োজিনিসের মত।
ডায়োজিনিসের টবের পাশে একবার এসে দাড়ালেন আলেকজান্ডার। তিনি বললেন, “ডায়োজিনিস, আপনার জন্য আমি কী করতে পারি?”
ডায়োজিনিস বললেন, “আমার সামনে থেকে সরে দাঁড়াও। তোমার জন্য সূর্যের আলো আমার গায়ে লাগছে না।”
প্রচলিত এক রাজার গল্প আছে। যার ভয়ানক অসুখ হয়েছিল। সে অসুখের একমাত্র চিকিৎসা ছিল সুখী মানুষের জামা গায়ে দেয়া। তবেই কেবলমাত্র রোগ সারবে।
সেই রাজা শেষপর্যন্ত একজন সুখী মানুষ খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু তার জামা পান নি। সেই সুখী মানুষের জামা ছিল না।
রাজা নিশ্চয়ই এখনো অসুস্থই আছেন। কারণ গল্পে জামা না পেয়ে তার কী হল সেটা বলা ছিল না। রাজা এইবার উপরে বর্নিত দুইজন মানুষের জামা সংগ্রহ করে দেখতে পারেন।
তথ্যসূত্রঃ
কোরিয়া হেরাল্ড, উকিপিডিয়া, বিজনেস ইনসাইডার, নোটিলাস ম্যাগাজিন, ডেইলী মেইল।