পিটার থিয়েলের জিরো টু ওয়ানঃ টেক উদ্যোক্তাবাজি

উন্নতি, পিটার য়য়েল ও বাংলাদেশে টেক উদ্যোক্তাবাজি নিয়ে চিন্তা

 

পেপালের কো ফাউন্ডার পিটার থিয়েল উন্নতি বা প্রোগ্রেসকে দেখেছেন দুইভাবে। একটা হল ০ থেকে ১। আরেকটা ১ থেকে “এন” পর্যন্ত। এই দুই উন্নতির মধ্যে তিনি পার্থক্য করেছেন।

টাইপ রাইটারের উদাহরণ দিয়ে পিটার তার বই জিরো টু ইনফিনিটিতে বলেন, আপনাকে একটি টাইপ রাইটার দেয়া হলো। আপনি আরো একশো টাইপ রাইটার বানালেন। এই উন্নতি হলো ১ থেকে “এন” ধরনের উন্নতি। আর আপনি যদি সেই টাইপ রাইটার থেকে নতুন কোন ওয়ার্ড প্রসেসর তৈরী করেন তাহলে সেটা হবে “০” থেকে “১” ধরনের উন্নয়ন।

রেখাচিত্রের মাধ্যমেও ব্যাপারটা বুঝা যায়।

Progress

০ থেকে ১ এর উন্নতি হচ্ছে উল্লম্ব বা খাড়া।

১ থেকে এন এর উন্নতি হচ্ছে সমতল বা অনুভূমিক।

progress2

০ থেকে ১ এর উন্নতির ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে আসে টেকনোলজির নাম। টেকনোলজিতে এমন অনেক নতুন বিষয় এসেছে যা আগে ছিল না।

১ থেকে এন এর যে উন্নয়ন এর উদাহরণ গ্লোবালাইজেশন। উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নত দেশের সব কিছু কপি করার চেষ্টা করে। তাই হাতে হাতে “ইস্মার্ট” ফোন থাকার অর্থ উন্নতি না গ্লোবালাইজেশনের এফেক্ট না ভাবার বিষয়। উন্নতি বলা যেতে পারতো যদি ঐ দেশ নতুন ধরনের “ইস্মার্ট” ফোন তৈরী করতে পারত।

এটা আমাদের শিল্পী এস এম সুলতানের উক্তি এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য।

“বলে, আপনি ঐ এক নারকেল, খেজুর গাছ আর খড়ের ঘরই আঁকেন, আপনার ছবিতে একটা টিনের ঘর নাই, দালান নাই। হ্যাঁ, আমি টিনের ঘর, দালান আঁকি না। ঐ রকম আধুনিক গ্রাম আমি আঁকি না। রিলিফের টিনে গ্রাম শাদা করে দিলেই গ্রাম মডার্ন হয়ে যায় না। ঐ টিন আমরা তৈরী করিনি। ঐ টিন, ঐ দালান আমার কৃষকের না। আমার কৃষক বহুযুগ ঐ নারকেল, খেজুর গাছের নিচে কুঁড়ে-ঘরেই থাকে, নেংটি পরে। বাকীগুলো সে অর্জন করে নাই, চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।”

400px-Peter_Thiel_TechCrunch50

ছবি -পিটার থিয়েল। পরিচিতি – জার্মান-আমেরিকান টেক উদ্যোক্তা, ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট, সোশ্যাল ক্রিটিক। পেপালের কো ফাউন্ডার, ফেসবুকের প্রথম বাইরের ইনভেস্টর।

 

পিটাল থিয়েলের বইটি উদ্যোক্তাদের জন্য উপকারী হবে (টেক উদ্যোক্তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য)। টেকনোলজিক্যাল দুনিয়ায় এক জিনিস একবারই ঘটে। প্রাচীন গ্রীসের দার্শনিক হিরাক্লিটাস বলেছিলেন আপনি একই নদীতে দুইবার পা ফেলতে পারবেন না। কারণ নদি বয়ে যায়। মানুষের হাতের কোষগুলোও মরে যায়, ঝরে যায়। এজন্য মাইন্ডওয়াক ফিল্মে এমন একটি কথা ছিল, আপনি সাধারনত একই হাতের কোষের হাতের সাথে দুইবার হাত মেলাতে পারবেন না। কারণ এই সময়ের মধ্যে ঐ স্তরের কোষগুলো হয়ত পড়ে যাবে। ব্যাপারটা সত্য কি না নিশ্চিত নই তবে পিটার থিয়েল একইভাবে ভেবেছেন টেক-প্রযুক্তি ব্যবসা নিয়ে। তার মতে পরবর্তী জুকারবার্গ ফেসবুক বানাবেন না বা বিল গেটস কোন অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে কাজ করবেন না। কপি করে ওয়ান টু এন এর মাধ্যমে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয় না।

ইন্টারভিউ কোশ্চেন দিয়ে তিনি আরেকটি চমৎকার বিষয় ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি কোন চাকরীর জন্য ইন্টারভিউ নিতে গেলে প্রশ্ন করেন, “আপনার জানা কি এমন গুরুত্বপুর্ন সত্য আছে যার সাথে অল্প লোকই একমত হবেন?”

অনেকে বলেন, “আমেরিকা মহান”

“আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বাজে।”

“ঈশ্বর বলতে কিছু নাই”

ইত্যাদি… কিন্তু পিটার মনে করেন এগুলো এই প্রশ্নের ঠিক উত্তর নয়। প্রথম দুইটি সত্যি হলেও অনেক লোক এর সাথে একমত হবে। আর তৃতীয়টি একটি বিখ্যাত বিতর্কে এক পক্ষের অবস্থান।

সঠিক উত্তর হলো “অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে “এক্স” কিন্তু সত্যিটা “এক্স” এর বিপরীত।”

এই ধরনের উত্তরে যেতে অনেক পড়াশোনা (বই পড়া) এবং ক্রিটিক্যাল থিংকিং এর প্রয়োজন। চিন্তাকে থিয়েল উদ্যোক্তাদের জন্য প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন শক্তি বলে উল্লেখ করেছেন।

এই ধরনের উত্তরে যেতে প্রথমে চিন্তা করতে হবে “বেশিরভাগ মানুষেরা কোন বিষয়ে একমত?”

এখানে স্মরণ করতে হবে ড্যানিশ দার্শনিক, আধুনিক অস্তিত্ববাদের জনক বলে খ্যাত সোরেন কীর্কেগার্ডকে। তিনি লিখেছেন –

” Truth always rests with the minority, and the minority is always stronger than the majority, because the minority is generally formed by those who really have an opinion, while the strength of a majority is illusory, formed by the gangs who have no opinion — and who, therefore, in the next instant (when it is evident that the minority is the stronger) assume its opinion… while truth again reverts to a new minority. ” (Søren Kierkegaard, The Diary of Søren Kierkegaard, pt. 5, section 3, no 128 (1850) )

একইভাবে পরবর্তীকালের জার্মান দার্শনিক নীচা বলেন –

“Madness is rare in individuals —but in groups, parties, nations and ages it is the rule.”

ম্যাস পিপল অচিন্তাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নেয় ফলে হুজুগের উৎপত্তি হয়। নানা ধ্বসাত্মক এবং উগ্রমতের কার্যসিদ্ধিও এভাবে হয়ে থাকে। গ্রুপে থাকা লোকেরা, একা থাকা লোকদের চাইতে যে অধিক উগ্র এবং বিতর্কিত মত ধারণ করে এর নাম দেয়া হয়েছে গ্রুপ পোলারাইজেশন। সবচেয়ে মর্মান্তিক ব্যাপার হলো, গ্রপে থাকার দরুণ ভালো লোকেরাও খারাপ কাজ করে এবং তারা মনে করে তারা ভালো কাজ করছে।

 

স্লোভানিয়ান দার্শনিক স্ল্যাভো জিজেকের কথা এখানে স্মরণ করা যায়। তিনি লিখেছেন –

“Because the horror of Communism, Stalinism, is not that bad people do bad things — they always do. It’s that good people do horrible things thinking they are doing something great.”

[Six Questions for Slavoj Žižek, Harper’s Magazine, November 11, 2011]”

 

পিটার থিয়েল ২০০০ এর সিলিকন ভ্যালিতে ডট কম ক্র্যাশের কথা বলেছেন। তখন টেক উদ্যোক্তাদের মধ্যে যেসব ধারনা ছিল সেগুলোর বিপরীত চিন্তাই এখন কার্যকরী। মার্কেট মনোপলি বিষয়ে পিটার থিয়েল মনে করেন, টেক উদ্যোক্তাদের সফলতার জন্য এটি অতীব দরকারী। প্রতিযোগীতামূলক ব্যবসার যে চিন্তা আগে করা হতো তা ভূল। নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং একচেটিয়া ব্যবসাই লাভের মূলমন্ত্র। কিছুদিন আগে নিউ ইয়র্কারে ওম মালিক সাইডকারের পতন নিয়ে লিখেছিলেন। সেই লেখাটার সাথে পিটার থিয়েলের একচেটিয়া ব্যবসার ধারণা মিলে যায় এবং তাকে সত্য প্রমাণ করে। সাইডকারে রিচার্ড ব্র্যানসন ইনভেস্ট করেছিলেন তবুও উবার ইত্যাদি বড় কোম্পানির সাথে প্রতিযোগীতা করে সাইডকার ঠিকে থাকতে পারে নি। যেমন, এখন কেউ ঠিক গুগলের মতো নতুন সার্চ ইঞ্জিন বানিয়ে ঠিকে থাকতে পারবে না। ঠিকতে হলে তাকে গুগলের চেয়ে আলাদা হতে হবে এবং সার্চের জগতে নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে হবে।

তবে থিয়েল এখানে সাবধানও করে দিয়েছেন, আপনি প্রথমে যদি শুরু করেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে ভাবনা না থাকে তাহলে প্রথমে শুরু করার সুফল বঞ্চিত হবেন। কারণ কেউ হয়ত আরো বড় ইনভেস্ট, লোকবল ও চিন্তা নিয়ে চলে এসে আপনাকে হটিয়ে দেবে। তাই প্রথমেই শেষটা পর্যন্ত ভেবে এগুতে হবে।

প্রতিযোগীতা নিয়ে থিয়েলের অভিমত হলো, প্রতিযোগীতা পুরনো সুযোগকে বড় করে দেখায় আর পূর্বের কাজের দাসসূলভ কপি করাকে প্রমোট করে। প্রতিযোগীতা বিষয়ে তিনি কার্ল মার্ক্স এবং শেকসপিয়রের তুলনামূলক আলোচনা করেছেন।

মার্ক্স মতে মানুষের ভিন্নতাই তাদের কনফ্লিক্টের কারণ। প্রলেতারিয়েত বুর্জোয়াদের থেকে ভিন্ন আইডিয়া এবং লক্ষ্যগত দিক থেকে। আর শেক্সপিয়রের মতে মানুষেরা ফাইট করে কারণ তারা একইরকম। রোমিও এন্ড জুলিয়েটের দুই পরিবার একইরকম। একইরকম হয়েও তারা পরস্পরকে ঘৃণা করে। তাদের দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকলে তারা আরো একইরকম হয় এবং একসময় ভুলেই যায় কেনো তারা ফাইট শুরু করেছিল।

থিয়েলের মতে, কর্পোরেট ব্যবসার দুনিয়ায় নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগীতার ব্যাখ্যায় শেকসপিয়র বেশী গ্রহনযোগ্য। তারা মার্কেটপ্লেসে প্রতিযোগীদের নিয়ে এত বেশী চিন্তিত হয়ে পড়ে যে যেসব বিষয়ে তাদের নজর দেয়া প্রয়োজন তা উপেক্ষা করে যায়। ফলশ্রুতিতে ঝামেলায় পড়ে।

বাংলাদেশে প্রযুক্তির মাঠ খালি আছে এখনো। আমেরিকায় অনেক প্রতিভাবান লোকেরা, অনেক পরিশ্রম করেও জায়ান্টদের সাথে প্রতিযোগীতায় ঠিকতে পারছে না। জিরো টু ওয়ান, অর্থাৎ নতুন কিছু যারা করছে, পর্যাপ্ত চিন্তা ও বাজেট নিয়ে তারাই সফল হচ্ছে। বাংলাদেশে এমন প্রতিযোগীতা অল্প।

জায়ান্টদের সাথে অত প্রতিযোগীতা সাধারণত আমাদের নেই। ফলে দারুণ সম্ভাবনা আছে টেকনোলজির ফিল্ডে জিরো টু ওয়ান এবং ওয়ান টু এন এরও। তবে আপনি নিশ্চয়ই স্বাভাবিক বুদ্ধিতে বুঝতে পারছেন ফেসবুকের মতো আরেকটি সোশ্যাল সাইটের বাংলা ভার্সন এখানে চলবে না (যেমন, বেশতো করা হয়েছিল এখানে বা বাঁধ ভাঙার আওয়াজের সোশ্যাল সাইট ছিল) কারণ ফেসবুক বাংলাদেশের ইন্টারনেটেও সর্বব্যাপী।

সেইসব ওয়ান টু এন প্রকল্প এখানে কাজ করবে যেগুলোর ব্যাপক বিস্তার এখানে নেই বা এখানকার মার্কেট বেইজড না।

বিদেশী অনেক কোম্পানি উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশকে টার্গেট করে ইতিমধ্যেও বিভিন্ন প্রকল্প চালু করছে ইন্টারনেট-প্রযুক্তির সেক্টরে। এদের বেশিরভাগই ওয়ান টু এন। প্রাথমিকভাবে দেশের অনেক লোক এতে কাজ টাজ পাবে, ফলে কর্মসংস্থান ইত্যাদি ভেবে একটা উন্নতি বলে ধরতে পারেন অনেকে। কিন্তু এগুলো যেহেতু ভবিষ্যতকে টার্গেট করে করা হচ্ছে, ফলে ভবিষ্যতে যখন এরা লাভ করবে, তখন লাভের টাকা বাইরেই যাবে। উন্নয়নশীল দেশের জন্য তাই এ ধরনের সরাসরি বিদেশী ইনভেস্টের চাইতে দেশীয় উদ্যোক্তাদের ইন্টারনেট-প্রযুক্তিতে ব্যবসা বেশী লাভজনক হবে।