মোজাফফর হোসেনের পাঁচটি গল্পঃ ক্রিটিক্যাল পাঠ

মোজাফফর হোসেনের গল্পগ্রন্থ অতীত একটি ভীনদেশ এর পাঁচটি গল্প নিয়ে আলোচনা। গল্পগুলো হচ্ছেঃ বাঁশিওয়ালা মজ্জেল, একটা কুকুর এবং একজন কবির গল্প, ভ্যাদা কবির প্রস্থান ,  লাশটি জীবিত বাকিরা মৃত এবং ছুঁয়ে দেখা জীবন।

বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৬ একুশে বইমেলায়। প্রকাশক বেহুলা বাংলা। বইয়ের ভেতরের অলংকরন করেছেন রাজিব দত্ত।

otit ekti vindesh

                                                                   

বাঁশিওয়ালা মজ্জেল

মজ্জেল একজন শিল্পী মানুষ। ক্ষমতাহীন গরীব ক্ষৌরকার। তার রাতে বাঁশি বাজানো, অর্থের প্রতি নির্বিকার উদাসীনতার (এবং বউয়ের প্রতিও?) কারণ কী? ফযরের আযানের আগ পর্যন্ত কেন সে জাইগা বাঁশি বাজাত যখন তার বউয়ের বিছানায় আসন গাড়ত ভিন্ন লোক? এইটা তো অস্বাভাবিক একটা বিষয়। পৌরুষ স্বত্তাহীন মজ্জেলের কীসের প্রতিনিধি?

মজ্জেলের বউই বা তা মেনে নিত কেন তার কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। নারীবাদীরা এখানে সমালোচনা করতে পারেন মজ্জেলের বউয়ের এমন উপস্থাপনে।

গল্পের মূল বিষয়বস্তু একজন শিল্পীর প্রতি মৌলবাদের আঘাত। নিরীহ পরোপকারী মানুষের মৌলবাদের ছোঁয়ায় হিংস্র হয়ে উঠা। তথাকথিত ভালো মানুষের নিরবতা। ক্ষমতাহীনের প্রতি ক্ষমতাসীনদের অন্যায় এবং সেই অন্যায় ধামাচাপা দেয়া। চিরাচরিত উন্নত হইতে থাকা বাংলার এক গ্রামের ছবি। যেখানে পুঁজিবাদের সাথে সাথে তার বৈমাত্রেয় ভাই মৌলবাদও আসন বিস্তার করছে। স্যাটেলাইট টিভি প্রযুক্তির যুগে মধ্যপ্রাচ্যের বাতাস এসে লাগছে। সেখানে যাইহোক, সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসন কিংবা আরব বসন্ত; এর একটা প্রভাবে গ্রাম বাংলায় মৌলবাদ পেয়েছে ভিন্ন মাত্রা।

মজ্জেল প্রথম যে পরিবেশে বাঁশি বাজাত তা ছিল সহনশীল। কবি জসিমউদ্দিনের জীবন কথার চৈত্র পূজা প্রবন্ধে গ্রামীন ধর্মীয় উদারতার এক পরিচয় পাওয়া যায়। ধরা যাক মজ্জেলের গ্রামে সেই পরিবেশ ছিল।

এর পরে পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়। মজ্জেলকে বাঁশি বাজানোর জন্য খারাপ পরিণতি মেনে নিতে হয়। দেশে অনেক বাউল, লোকগানের শিল্পীরা মৌলবাদের কারণে নানাবিদ সমস্যায় পড়েছেন। মজ্জেল তাদের প্রতিনিধিত্ব করছে।

কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি কী? গল্পের মধ্য দিয়ে গ্রাম দেখলে তেমন আশাব্যঞ্জক সামাজিক উন্নতি দেখা যায় না। পুঁজিবাদের বিস্তার হয়েছে গ্রামে। আলাদা আলাদা বাড়ি, দালানকোঠা। পুঁজিবাদের ছোটভাই ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের বিস্তার, এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ির দূরত্ব আধুনিকতার কালে লোকের সাথে লোকের মানসিক দূরত্বের রূপক। সীমান্তে ছেলেদের মাদকের ব্যবসা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রিক সমাজে হতাশার বহিঃপ্রকাশ।

আবার পরক্ষণে লেখক এও বুঝিয়ে দিয়েছেন মৌলবাদের বিস্তারও হয়েছে সাথে সাথে। টিভিতে লোকে নাচ গান দেখে এখন, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু মৌলবাদ পেয়েছে ভিন্নমাত্রা। বর্তমানকে হতাশাময় করে উপস্থাপন করা হয়েছে। হয়ত বর্তমান বাস্তবতা এরকমই।

অতীত একটা ভিনদেশ

একটা কুকুর এবং একজন কবির গল্প

দ্বিতীয় গল্প অধ্যাপক রেজাউল করিমকে নিয়ে। তিনি ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি ভেরি মাচ ইন্টারেস্টেড হয়ে বিলাত গিয়েছিলেন। সাহিত্যিক তথা কবি হবার ইচ্ছা ছিল তার। রাজনারায়ণ দত্তের পুত্র মধুসূদনের মতোই কিছুটা। একসময় রেজাউল করিমও বুঝতে পারেন বিলাতে কবিগিরি করা সফল হবে না। তাই তিনি ফিরে আসেন নিজদেশে। এবং দেশে এসে খুঁজতে থাকেন কিছু এবং সেই কিছুটা কী তা গল্পে নাই। কিছু একটা, যা নাই নাই বলে মনে হয়। তার খোঁজা এবং খুঁজতে খুঁজতে দেশী কুত্তার মুখোমুখি হওয়া এক ইন্টারেস্টিং বিষয়।

কুত্তাটাকে তিনি ভুল বুঝেন। ভুল বুঝে বিদেশী হাচিকো এবং বাস্টোর সাথে তার তুলনা দিয়ে তারে তাচ্ছিল্য করেন। কিন্তু শেষে তিনি বুঝতে পারেন তার বুঝার ভুল। তখন তিনি লজ্জ্বিত হয়ে পড়েন।

হাচিকো, বাস্টো তাদের পরিবেশে তাদের মহত্ত্ব দেখিয়েছিল। তাদের সেই মহত্ত্ব বিখ্যাত। লোকমুখে তাদের গুণগান শোনা যায়। রেজাউল করিমের বন্ধু আফসার সাহেবের মতে পারফেক্ট কলোনিয়াল প্রোডাক্ট রেজাউল করিম সেই গুণগানে মুগ্ধ হয়ে দেশী কুত্তারে দেখেন নি কোনদিন। দেশী কুত্তার ভেতরেও সঙ্গীর প্রতি ভালোবাসা এবং সেই সঙ্গী বিয়োগের ব্যথার সাথে হঠাৎ করেই মুখোমুখি হয়ে পড়েন রেজাউল করিম। তিনি বিব্রত হন কুত্তার চোখের দিকে দেখে।

দেশী কুত্তার প্রতি রেজাউল করিমের দৃষ্টিভঙ্গীর মাধ্যমে দেশের (বা দেশীয় সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্পকলা) প্রতি রেজাউল করিমের দৃষ্টিভঙ্গীর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। পারফেক্ট কলোনিয়াল প্রোডাক্ট হইতে যাওয়া শিক্ষিত অনেক তথাকথিত ভদ্রজনের দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে রেজাউল করিমের দৃষ্টিভঙ্গির মিল আছে। রেজাউল করিম এখানে তাদেরই প্রতিনিধি।

তবে রেজাউল করিম কী খুঁজতে ছিলেন? তিনি কী তা পেয়েছেন? তার এই একটা জিনিস খোঁজা এবং সেই জিনিস না পাওয়ার দরুণ তার মনের অশান্তি বা অস্থিরতার সাথে দেশী কুত্তার অস্থিরতার মিল আছে কী?

রেজাউল করিমের মনে অস্থিরতা আছে তা বুঝা যায় তার একটা জিনিস খুঁজে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। এবং এই জিনিসটা মানে কী যেন নাই এই বোধের জন্যই তিনি বিলাত থেকে ফিরে এসেছিলেন। আর কুত্তার অস্থিরতা বুঝা যায় খাবার ছেড়ে গাড়ির পিছনে দৌড় দানের মধ্য দিয়ে।

এই দেশী কুত্তার অস্থিরতা প্রতিশোধ ভিত্তিক আর রেজাউল করিমের অস্থিরতার ভিত্তি কী? কী নাই তার? দেশী কুত্তার সঙ্গী নাই, তারও সঙ্গী নাই। রেজাউল করিম কী আসলে দেশী কুত্তাই। রাজনারায়ণের পোলা মধু সায়েব হইতে না পেরে দুঃখ করে আরশিতে মুখ দেখে বলছিলেন আমি যশোরে বাঙাল। রেজাউল করিম কী দেশী কুত্তার চোখের আরশিতে সেইরকমই কিছু দেখলেন নাকী!

ভ্যাদা কবির প্রস্থান

ভ্যাদা কবি একজন গ্রাম্য কবি। প্রকৃত কবি হিসেবে তাকে দেখানোর কী চেষ্টা করা হয়েছে? প্রকৃত কবি কি? যিনি বাতাস, জল কিংবা জলবায়ু মিশিয়ে কাব্য করেন, শুধু শব্দে তার কবিতা ধরে না। কাফকা কথায়, সব লেখাই এক ধরনের দূর্বল অনুবাদ। মনে অনুভূতির জন্ম হয়, তা ভাষায় প্রকাশ করতে হয়। পুরোপুরিভাবে প্রকাশ কী সম্ভব?

ভ্যাদা কবির অনুভূতির প্রখরতা বুঝতে তার জল কিংবা বাতাস দিয়ে কাব্য করাটাকে গুরুত্ব দিতে হবে। তার প্রস্থান এবং গল্পের কথককে ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয়াটাও কবিতাই। গল্পটা কাব্যিক।

লাশটি জীবিত বাকিরা মৃত

 

শ্রমজীবি এক পরিবারের গল্প মূলত। অথবা বর্তমান পুঁজিবাদী আধুনিক সমাজের গল্প। যেখানে গরীব শ্রমজীবি মানুষেরা নিদারুনভাবে নিষ্পেষিত হয় প্রতিনিয়ত। গল্পটি স্যাটায়ারের মত যেখানে তীক্ষ্ণভাবে বর্তমান সামাজিক ব্যবস্থা, উন্নয়ন, মানবাধিকার, ইন্টারনেট প্রযুক্তিকে ব্যঙ্গের দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে।

ছুঁয়ে দেখা জীবন

গল্পটি আমার আগে পড়া ছিল। তারসেম সিং এর দ্য ফল এর ধরণ দ্বারা অনুপ্রাণিত এ এই গল্পের মূল বিষয়বস্তু অতীত এবং আধুনিকতার দ্বন্দ্ব। আধুনিক ক্যারেক্টার গুলোকে নিয়ে স্যাটায়ার করা হয়েছে, যেন আধুনিকতাই করা হয়েছে স্যাটায়ার। অসুস্থ মৃত্যুপথযাত্রী রহমানের কল্পনার ভেতর দিয়ে গ্রাম এবং তার ফেলে আসা সেই জীবনের প্রতি ভালো লাগা, তার শেকড়ের প্রতি টান এর ভিন্নধর্মী উপস্থাপন হিসেবে এর গুরুত্ব আছে। লেখক এই গল্প বিষয়ে বলেন, “রহমানের পলায়নপর জীবনই তাকে টেনে নিয়ে গেছে শেকড়ে। অর্থাৎ আমরা চাইলেও সবসময় পালাতে পারি না।” এই গল্প নিয়ে লেখকের সাথে আমার কিছু কথা হয়েছিল, ফলে এর সম্পর্কে নির্দিষ্টভাবে আলোকপাত করা সহজ হবে। পাঠক অবশ্যই গল্প তার মতো করে বুঝবেন কিন্তু এই গল্প যেহেতু অন্যদের চাইতে ভিন্ন স্টাইলের তাই এর সম্পর্কিত আলোচনায় লেখকের মতও চিন্তার নয়া দরজা খুলে দিতে পারে।

রহমান নামের ভদ্রলোকের স্ত্রীর কথাবার্তায় বুঝা যায় ভদ্রলোক গ্রামকে এড়িয়ে চলতেন, গ্রাম সম্পর্কে কথা বলতেন না, তাচ্ছিল্য করতেন। আবার তিনি কানাডার নাগরিক জীবনের পরিবেশেও নিজেকে পুরোপুরি মানিয়ে নিয়েছেন তাও বলা যায় না। অফিস থেকে ফিরে নিজের রুমে লাইট বন্ধ করে বসে থাকতেন। রহমান সম্পর্কে লেখকের মত, “He was searching for something into his inside world. Just before the death he finds out his destiny.”

(ছবিগুলো লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।)