‘আউটলায়ার’ কানাডিয়ান সাংবাদিক লেখক ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েলের লেখা বই। এই বইতে তিনি সফল মানুষের সফলতার গল্পে যে বুদ্ধিমত্তা, উচ্চাকাঙ্খা ইত্যাদিকে সামনে আনা হয় তার চাইতে সত্যিকার চিত্র ভিন্ন। তিনি বলতে চেয়েছেন সফল লোকদের পরিবার, জন্মস্থান, জন্মদিন ইত্যাদির প্রভাবের কথা। তিনি তার থিসিসের স্বপক্ষে যুক্তিও দিয়েছেন। বইয়ের ভূমিকায় রসেতো নিয়ে একটি লেখা আছে। এর মাধ্যমেই বুঝা সম্ভব তিনি সফলতাকে কীভাবে বুঝেছেন। বইয়ের এই অংশটি ভাষান্তরিত করলাম। পরবর্তীতে এই বই নিয়ে আরেকটি পোস্ট দেয়ার ইচ্ছা আছে যেখানে তার যুক্তি এবং উদাহরণ নিয়ে কথা বলা যেতে পারে।
Throughout the publication, he discusses how family, culture, and friendship each play a role in an individual’s success, and he constantly asks whether successful people deserve the praise that we give them. (Time, Bill Wadman; 2008-11-13)
আউটলায়ার – বিশেষ্য
– এমন বস্তু যা মূল ব্যবস্থা বা মূল গঠন থেকে আলাদাভাবে অবস্থান করে।
– একটি পরিসংখ্যানগত পর্যবেক্ষণ , স্যাম্পলের অন্য সব মান থেকে স্পষ্টভাবে আলাদা।
রোমের একশো মাইল দক্ষিণ-পূর্বে ইতালির ফজ্জা প্রদেশের এপনাইন পর্বতশ্রেণীর পাদদেশে অবস্থিত রসেতো ভালফরতরে। একটি বড় কেন্দ্রীয় বর্গকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগীয় গ্রাম ধাঁচের শহরটি। বর্গের দিকে মুখ করে আছে এই এলাকার একসময়ের বিরাট ভূস্বামী সাজ্ঞেস পরিবারের প্রাসাদ, পালাজ্জাও মারচেসালো। একপাশ দিয়ে ধনুকাকৃতির ছাদে ঢাকা পথ চলে গেছে ম্যাডোনা ডেল কারমাইন গীর্জায়। (যিশুর কুমারী মাতা ম্যারী’কে উপাধি দেয়া হয়েছিল আওয়ার লেডি অব মাউন্ট কারমেল। এই উপাধি অনুসারেই গীর্জাটির নাম।) অপ্রশস্ত পাথুরে রাস্তা চলে গেছে পাহাড়ের উপরে। দু’ধারে গুচ্ছ গুচ্ছ দো’চালা পাথর নির্মিত ঘর, এদের ছাদগুলো লাল লাল টালি দ্বারা ঢাকা।
শত শত বছর ধরে রসেতোর অধিবাসীরা পর্বতশ্রেণীর আশপাশের মার্বেল খনিতে কাজ করেছে বা নিচের উঁচুনিচু উপত্যকায় কৃষিকাজ করে আসছিল। তারা চার থেকে পাঁচ মাইল হেটে নিচে যেত এবং কাজ শেষে রাতে আবার দীর্ঘপথ অতিক্রম করে ফিরে আসত পাহাড়ের উপরে। জীবন সেখানে ছিল কঠিন। শহরের লোকেরা ছিল অশিক্ষিত। খুবই দরিদ্র। এবং তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির তেমন কোন আশাও ছিল না। সেই আশার জন্ম নিল যখন উনিশ শতকের শেষভাগে এসে তারা জানতে পারলো সম্ভাবনার ভূমি রয়েছে সমুদ্রের ওপারে।
১৮৮২ সালের জানুয়ারিতে এগারো জন রসেতান লোক এবং একজন বালকের একটি দল রওনা দিল নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্যে। আমেরিকায় পৌছে তারা প্রথম রাতটি কাটাল ম্যানহাটনের লিটল ইতালি বলে পরিচিত মালবেরী স্ট্রিটের এক পানশালার মেঝেতে।
এরপর তারা ঝুঁকি নিয়েই কাজ খুঁজতে চলে গেল পশ্চিমে। শহর থেকে নব্বই মাইল পশ্চিমে পেনিস্যালভেনিয়া অঙ্গরাজ্যের শহর ব্যাঙ্গরের পাশে এক স্লেট পাথরের খনিতে কাজ পেল তারা।
পরের বছর পনেরজন রসেতান ইতালি ছাড়ল আমেরিকার উদ্দেশ্যে। সেই দলের অনেকে শেষ পর্যন্ত গিয়ে ভীড়ল ব্যাঙ্গরের পাশের স্লেট খনিতে, তাদের নিজেদের দেশের লোকদের কাছে। এই অভিবাসীদের কাছ থেকে সম্ভাবনাময় নতুন এই পৃথিবীর খবর তাদের শহরে পৌছে গেল। তাই শীঘ্রই আরো আরো রসেতানরা তাদের ব্যাগ গুছিয়ে ছুটতে লাগল পেনস্যালভেনিয়ার উদ্দেশ্যে। শেষপর্যন্ত এই অভিবাসীদের স্রোত আক্ষরিক অর্থেই বন্যায় পরিণত হয়। ১৯৮৪ সালেই প্রায় বারো শত রসেতান আমেরিকান পাসপোর্টের জন্য আবেদন করে। তাদের পুরনো আবাসস্থল শূন্য করে তারা চলে আসল আমেরিকায়।
রসেতানরা পাথুরে পাহাড়ের পাশে জমি কিনতে শুরু করে। জমিগুলো একটি উপত্যকা এবং মালটানা গাড়ির রাস্তার মাধ্যমে মাধ্যমে ব্যাঙ্গর শহরের সাথে যুক্ত ছিল। তারা পাহাড়ের পাশের অপ্রশস্ত উঁচু নিচু রাস্তায় দো’চালা গুচ্ছ গুচ্ছ ঘর নির্মান শুরু করে। ঘরগুলোর ছাদ ছিল স্লেট নির্মিত। তারা একটি গীর্জাও নির্মান করে এবং এর নাম দেয় আওয়ার লেডি অব মাউন্ট কারমেল। এবং প্রধান রাস্তাটির নাম দেয় গ্যারিবল্ডি এভিনিউ। গ্যারিবল্ডির নামানুসারে, যিনি ইতালিকে একত্রিত করার মহানায়ক। শুরুর দিকে তারা শহরটিকে ডাকত “নতুন ইতালি” বলে। কিন্তু পরে এটি পরিবর্তন করে তারা ইতালির যে গ্রাম থেকে এসেছে তার নামানুসারে নাম দেয় “রসেতো।”
১৮৯৬ সালে আওয়ার লেডি অফ মাউন্ট কারমেলে পাদ্রী হয়ে এলেন এক দৃঢ়চেতা যুবক। তার নাম ফাদার পাসকুয়েল ডে নিস্কো। তিনি ধর্মীয় কিছু সংঘটন তৈরী করলেন। উৎসবের আয়োজন করলেন। শহরের লোকদের উৎসাহিত করলেন তাদের ঘরের পিছনের লম্বা জমি পরিষ্কার করে পেঁয়াজ, শিম, আলু, তরমুজ এবং বিভিন্ন ধরনের ফলের চাষ করতে। তিনি বীজ দিলেন।
শহরে প্রাণ ফিরে এল। রসেতানরা তাদের বাড়ির পিছনে শুকরের খামার করল এবং গৃহজাত মদ তৈরীর জন্য ফলাতে লাগল আঙ্গুর। স্কুল, পার্ক, মঠ, সমাধিস্থান ইত্যাদি নির্মিত হলো। গ্যারিবল্ডি এভিনিউর পাশে ছোট ছোট দোকান, বেকারি, রেস্টুরেন্ট, বার চালু হলো। প্রায় এক ডজনেরও বেশি ফ্যাক্টরি গড়ে উঠল ব্লাউজ তৈরীকে কেন্দ্র করে। ব্যাঙ্গরের প্রতিবেশীরা ছিল বিশেষত ওয়েলশ-ইংরেজ, পরের শহরে ছিল জার্মানদের আধিক্য। তার মানে যে একটা তিক্ত সম্পর্ক ছিল ইংরেজ, জার্মান এবং ইতালিয়ানদের, সেই সূত্রেই রসেতোতে রসেতানরা নিজেরা নিজেরাই রইল সেই সময়ে। অন্যদের সাথে তাদের মিশ্রণ হয় নি।
১৯০০ সালের পরের দশকে আপনি যদি রসেতো’তে হেটে বেড়াতেন তাহলে কানে আসত ইতালিয়ান কথাবার্তা, তাও সাধারণ ইতালিয়ান নয় একেবারে দক্ষিণী ফজ্জার ডায়ালেক্টের কথাবার্তা, ঠিক যেভাবে ইতালির রসেতোতে তারা কথা বলত। পেনিস্যালভেনিয়ার এই রসেতো ছিল ছোট আত্মনির্ভরশীল পৃথিবী, যা তার চারপাশের জগতের কাছে অজানা। হয়ত এমনিভাবেই থেকে যেতো রসেতো। কিন্তু বাঁধ সাধলেন একজন লোক, যার নাম স্টিওয়ার্ট উলফ।
উলফ ছিলেন একজন ডাক্তার। পরিপাক, পাকস্থলী ইত্যাদি নিয়ে পড়েছিলেন এবং পড়িয়েছিলেন অকলাহমা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল স্কুলে। তিনি তার গ্রীষ্মকালটা কাটাচ্ছিলেন পেনিস্যালভেনিয়ার এক ফার্মে। রসেতো থেকে খুব দূরে নয়। কিন্তু তাতেও কিছু যায় আসে না। কারণ যেহেতু রসেতোর লোকেরা নিজেরাই আত্মনির্ভরশীল এবং একা একাই চলে, ফলে এমনও হতে পারে তাদের পাশের শহরে থেকেও তাদের সম্পর্কে বেশি কিছু জানতে পারার উপায় নেই। অনেক বছর পরে উলফ এক স্বাক্ষাতকারে বলেন, “একসময়, ১৯৫০ এর শেষের দিকে হবে, যখন আমরা গ্রীষ্মকালে সেখানে ছিলাম তখন স্থানীয় মেডিক্যাল সোসাইটিতে আমি একটি লেকচার দিতে যাই। লেকচার শেষ হলে একজন স্থানীয় ডাক্তার আমাকে বিয়ারের আমন্ত্রণ জানান এবং পান করতে করতেই আমাকে বলেন, “আমি এখানে সতেরো বছর ধরে কাজ করছি। প্রায় সব জায়গা থেকেই রোগী পাই। পয়ষট্টি বছরের নিচে কোন হৃদরোগের রোগী রসেতো থেকে একেবারে কদাচিৎ পাওয়া যায়।”
উলফ অবাক হলেন। এটা ছিল ১৯৫০ সালের কথা, ক্লোরেস্টেরল কমানোর ওষুধ এবং হৃদরোগ প্রতিরোধের কার্যকর উপায় আবির্ভাবের কিছু বছর আগে। হৃদরোগ আমেরিকায় তখন মহামারীর মতো ছিল। পয়ষট্টি বছরের নিচের পুরুষের মৃত্যুর প্রধান কারণে পরিণত হয় হৃদরোগ। ডাক্তার হয়ে হৃদরোগের রোগী না দেখা ছিল অসম্ভবের মতো।
উলফ সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি বিষয়টা তদন্ত করে দেখবেন। তিনি সাহায্যের জন্য অকলাহমার কিছু ছাত্রছাত্রী এবং কলিগদের নিলেন। তারা শহরটির বাসিন্দাদের ডেথ সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে লাগলেন। ডাক্তারদের রেকর্ড বিশ্লেষণ করা হলো। তারা মেডিক্যাল হিস্টোরী এবং বংশতালিকাও নিলেন। উলফ বলেন, “আমরা দারুণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। শুরু করেছিলাম ১৯৬১ তে। মেয়র বললেন, “আমার সব বোনরা আপনাদের সাহায্য করবে।” তার চার বোন ছিল। তিনি বললেন, “আপনারা শহরের কাউন্সিল রুম ব্যবহার করতে পারেন।” আমি তাকে বললাম, “কিন্তু তাহলে আপনারা কাউন্সিল মিটিং করবেন কোথায়?” তিনি বললেন, “এগুলো কছুদিনের জন্য স্থগিত রাখা যাবে।” মহিলারা আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসতেন। আমাদের ছোট বুথ ছিল যেখানে রক্ত নেয়া হতো এবং ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম করা হত। আমরা সেখানে ছিলাম চার সপ্তাহ। তারপরে আমি অথরিটির সাথে কথা বলি। তারা আমাদের গ্রীষ্মের জন্য স্কুলটা দিয়ে দেয়। আমরা রসেতোর সব অধিবাসীদের আমন্ত্রণ জানালাম পরীক্ষা করার জন্য।
সব শেষে ফলাফল ছিল বিস্ময়কর। রসেতো’তে পঞ্চান্ন বছরের নিচে কেউ হৃদরোগে মারা যায় নি, এমনকী তাদের হৃদরোগের কোন লক্ষণও নেই। পয়ষট্টি বছরের উপরের পুরুষদের হৃদরোগে মৃত্যুর হার রসেতো’তে আমেরিকার চেয়ে অনেক অনেক কম, প্রায় অর্ধেক। অন্য কারণেও রসেতো’তে ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সের মধ্যে মৃত্যুর হার ধারনার চাইতে কম।
উলফ এরপর তার এক সমাজবিজ্ঞানী বন্ধু জন ব্রুনকে নিয়ে আসলেন তাকে সাহায্য করার জন্য। ব্রুন বলেন, “আমি কিছু মেডিক্যাল এবং সমাজবিদ্যার ছাত্রছাত্রীকে নিয়োগ দিলাম স্বাক্ষাতকার গ্রহণ করার জন্য। আমরা রসেতোর ঘর থেকে ঘরে গেলাম। ২১ বছর এবং তার উপরের সবার সাথে কথা বললাম।”
পঞ্চাশ বছর আগের কথা। কিন্তু তারা কি পেয়েছিলেন তা বলতে বলতে ব্রুনের চোখ চকচক করে উঠল, “কোন আত্মহত্যা ছিল না, মাদকাসক্তি নেই এবং খুব কম অপরাধ। তাদের কেউ ভাতার উপর নির্ভর করে নেই। তারপরে আমরা পেপটিক আলসারের দিকে দৃষ্টি দিলাম। তাদের সেটাও ছিল না। এই লোকগুলো কেবল বার্ধক্যজনিত কারণেই মারা যাচ্ছিল। এটাই হলো শেষ কথা।”
উলফের পেশায় রসেতো’র মতো জায়গার একটা নাম আছে – যে জায়গা প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার বাইরে অবস্থান করে, যেখানে স্বাভাবিক নিয়ামাবলী খাটে না। রসেতো ছিল একটি আউটলায়ার।
উলফ প্রথমে ভেবেছিলেন রসেতানদের মনে হয় এমন কোন খাদ্যাভাস আছে যা তারা প্রাচীনকাল থেকে ধরে রেখেছে। এজন্য তারা অন্য আমেরিকানদের চাইতে বেশি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি তার এই ভুল ভাঙ্গে। তিনি দেখতে পান রসেতোতে অধিবাসীরা চর্বি ব্যবহার করে রান্নাবান্না করে কিন্তু ইতালিতে তাদের ছিল স্বাস্থ্যকর জলপাই তেল। ইতালির পিৎজা ছিল পাতলা, লবন, তেল, কিছু টমেটো, মাছ বা পেঁয়াজ থাকত তাতে। কিন্তু পেনিস্যালভেনিয়ার পিৎজায় ব্রেড, সালামি, শুকর বা গরুর সসেজ, হ্যাম কখনো কখনো ডিম ইত্যাদি থাকে।
এখানে খ্রিস্টমাস এবং ইস্টারের জন্য বরাদ্দ মিস্টান্ন বিসকট্টি, তারাল্লি ইত্যাদি ইতালিতে থাকতে তারা সারা বছরই খেত। উলফ যখন রসেতানদের খাদ্যাভাস আরো পর্যবেক্ষণ করলে তখন দেখতে পেলেন রসেতানদের ৪১ ভাগ ক্যালরি আসে ফ্যাট থেকে। এবং এমনো নয় এই শহরের বাসিন্দারা নিয়মিত যোগ ব্যায়াম করে বা প্রতিদিন ছয়মাইল দৌড়ে। পেনিস্যালভেনিয়ার রসেতানরা প্রচুর ধুমপায়ী এবং অনেকেই মেদবহুলতার সমস্যায় ভুগছে।
তারপরে উলফের মাথায় এলো জেনেটিক বিষয়ের কথা। খাদ্যাভাস যেহেতু কোন উত্তর দিতে পারলো না তাহলে এমন কি হতে পারে এদের বংশগতির ধারায় এমন কিছু আছে যার কারণে এদের দেহে রোগ প্রতিরোধের শক্তি আছে? উলফ আমেরিকার অন্যান্য স্থানে বসবাসকারী রসেতানদের আত্মীয়দের খোঁজ খবর নিলেন। দেখলেন তারা এমন বিস্ময়কর সুস্বাস্থ্যের অধিকারী নয়। ফলে বংশগতির চিন্তাটাও বাদ দিতে হয়। এরপরে উলফ মনে করলেন এমন কি হতে পারে পেনিস্যালভেনিয়ার পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসের কারণে এরকম হচ্ছে? তিনি রসেতোর পাশের শহর ব্যাঙ্গর, ন্যাজারাথে খোঁজ নিলেন। দুটি শহরই রসেতোর কাছে এবং আকারে রসেতোর মতোই। দুইটি শহরেই অনেক পরিশ্রমি লোকের বাস।
উলফ এই দুই শহরের লোকদের মেডিক্যাল রেকর্ড ঘাটলেন। দেখতে পেলেন পয়ষট্টি বছরের উপরের লোকদের হৃদরোগে মৃত্যুর হার রসেতোর চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি। উলফ যেন দেখতে পেলেন আরেক কানাগলি।
উলফ এবং ব্রুণ বুঝতে পারলেন রসেতোর লোকদের সুস্থ্যতার রহস্য তাদের খাদ্যাভাস, জিন কিংবা আবাসস্থলের প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে নয়, রসেতোর নিজের মধ্যেই আছে। যখন তারা দুজন রসেতোতে কাজ করছিলেন তখন তারা চারিদিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে সক্ষম হন। তারা দেখলেন, রসেতানরা কীভাবে একে অন্যের বাড়িতে যাচ্ছে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ইতালিয়ান ভাষায় গল্প করছে, এক জন আরেকজনকে রেঁধে দিচ্ছে। তারা বুঝতে পেরেছিলেন বড় যুক্ত পরিবার রয়েছে শহরের সামাজিক গঠনের মূলে। তারা দেখতে পেয়েছিলেন একই ছাদের নিচে তিন প্রজন্ম বসবাস করছে এবং দাদা দাদীরা কীরকম সম্মান পেয়ে থাকেন। তারা আওয়ার লেডি মাউন্ট কারমেল গীর্জায় গিয়ে দেখেছিলেন কীভাবে রসেতোর লোকজন একত্রিত হয়। দুই হাজার বাসিন্দাদের জন্য তাদের ছিল বাইশটি সামাজিক সংঘটন।
তারা সাম্যবাদী তত্ত্বের সেই নীতি অনুসরন করে চলেছে যা সম্পদশালীদের তাদের সফলতা জমকালোভাবে প্রদর্শনে নিরোৎসাহিত করে এবং অসফলদের সাহায্য করে তাদের ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে। পূর্ব পেনিস্যালভেনিয়ায় ইতালিয়ান গ্রামের সেই সংস্কৃতি চালুর মাধ্যমে রসেতানরা একটি শক্তিশালী, রক্ষনাত্মক সামাজিক ব্যবস্থার তৈরী করেছে যা বাইরে আধুনিক বিশ্বের চাপ থেকে তাদের রেখেছে নিরাপদ। রসেতানরা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিল কারণ তারা রসেতিতে বাস করে, কারণ তারা দারুণ একটি স্বাস্থ্যকর আবাসস্থল তৈরী করেছিল তাদের পাহাড়ী ছোট শহরে।
“আমার মনে আছে যখন প্রথম রসেতিতে যাই, আপনি দেখতে পাবেন তিন প্রজন্ম একসাথে বসে খাচ্ছে, বেকারিগুলো, লোকেরা রাস্তায় এদিক ওদিক হাটছে, বারান্দায় বসে এঁকে অন্যের সাথে গল্প গুজবে মেতে আছে, মহিলারা দিনের বেলায় যাচ্ছে ব্লাউজ কারখানায় কাজ করতে, পুরুষেরা তখন কাজ করে স্লেট পাথরের খনিতে। ব্রুন বলেন, “সমস্ত ব্যাপারটা যেন জাদুময়।”
যখন ব্রুন এবং উলফ তাদের গবেষনা পেপার মেডিক্যাল কম্যুনিটিতে উপস্থাপন করলেন, তখন আপনারা কল্পনা করতে পারেন কি পরিমাণ সন্দেহের মুখে পড়েছিলেন তারা।
তারা এমন কনফারেন্সগুলোতে গিয়েছিলেন যেখানে অন্য সব গবেষকেরা বিভিন্ন ধরনের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষনের মাধ্যমে দেখাচ্ছিলেন নানা ধরনের ধরনের জিন, মানসিক পদ্বতি ইত্যাদি। সেখানে তারা ওসবের পরিবর্তে বলছিলেন রাস্তায় লোকদের সাথে কথা বলা এবং তিন প্রজন্ম এক ছাদের নিচে বাস করার রহস্যজনক এবং জাদুকরী উপকারের কথা।
সাধারণ প্রথাগত জ্ঞান বলে, দীর্ঘজীবন বেশিরভাগ নির্ভর করে আমাদের জিনের উপরে। এছাড়াও নির্ভর করে আমাদের সিদ্ধান্তেরর উপর- আমরা কি খাবো, কতটুকু ব্যায়াম করব, কত কার্যকর চিকিৎসা সেবা পাবো এদের উপর। কেউ কম্যুনিটি বা সমাজের উপর নির্ভর করে স্বাস্থ্যের ব্যাপারটা ভাবে নি। উলফ এবং ব্রুনকে মেডক্যাল ব্যবস্থাকে হৃদরোগ এবং স্বাস্থ্য নিয়ে সম্পূর্ন নতুনভাবে ভাবতে সম্মত করাতে হয়েছিল। তাদের বুঝাতে হয়েছিল কেন একজন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী তা যদি কেবল তাকে আলাদা করে দেখা হয় তাহলে কখনোই বুঝা যাবে না। বুঝতে হবে সামগ্রিকভাবে। বুঝতে হবে লোকটির সংস্কৃতি, বন্ধু, পরিবার সম্পর্কে, ভাবতে হবে কোন শহর থেকে এসেছে তার পরিবার। যে পৃথিবীতে আমরা বাস করি এর নিয়ম নীতি এবং আমাদের চারপাশের মানুষের সাথে সম্পর্কের প্রভাব আছে আমাদের স্বাস্থ্যের উপর।
আউটলায়ারস -এ আমি সফলতাকে একইভাবে বুঝতে চাই, যেভাবে সুস্বাস্থ্যকে বুঝেছেন স্টিওয়ার্ট উলফ।
–
পিটার থিলের বই “জিরো টু ওয়ান” নিয়ে একটি লেখা।