এক
বুনো হাতি দলে থাকে, তারা যখন বনে হাইটা যায় তখন পায়ের ছাপ দেইখা মনে হয় যে মাত্র একটা হাতি গেছে। বাচ্চারা এইভাবে এক পাড়ায় যাইতে পারত না। এই বাচ্চাদের পায়ের ছাপ আশে পাশে পড়ত, এইগুলা দেখে বা অন্যকোনভাবে হাতি ধরায় যারা অভিজ্ঞ থাকতেন প্রাচীনকালে, এরা বুঝতে পারতেন হাতি একটা নয়। দলই আছে ওদের।
সিলেটে একসময় হাতি ছিল অনেক। সিলেটের ইতিহাস বিষয়ক বই অচুতচরন তত্ত্বনিধির সিলেটের ইতিবৃত্ত (পূর্বাংশ) এর মধ্যে হাতি ধরার বিবরণ আছে। একদল হাতি যে প্রক্রিয়ায় ধরা হইত তার নাম ছিল খেদা, খেদাইয়া একটা খোঁয়াড়ের ভেতরে ঢুকাইয়া হাতি ধরা। খেদার মূল নিয়ন্ত্রণে যারা থাকতেন তাদের নাম ছিল পাঞ্জালী। একইরকম হাতি ধরার ঘটনা আছে ইংরাজ কোম্পানির রেসিডেন্ট রবার্ট লিন্ডসে’র আত্মজীবনী সিলেটে আমার বারো বছর বইতেও। হাতি ধরতে গিয়া খোঁয়াড়ে বন্দি করতে হইত তাদের, একবার রবার্ট লিন্ডসে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখেন যা তারে অবাক কইরা দেয়। একবার হাতি ধরার কালে যখন গড় বন্ধ করা হইল দেখা গেল একটা হাতি বাইরে রইছে কিন্তু সে পালাইয়া যাইতেছে না। সে গড়ের সাথেই দাঁড়াইয়া আছে। লিন্ডসে পরে বুঝলেন এই হাতিটি মা হাতি, তার বাচ্চা খেদায় আটকা পড়ছে। তাই মা হাতি ছাড়া পাইয়াও পালাইয়া যাইতেছে না। সন্তানের জন্য বন্দি হইতেও তার আপত্তি নাই। প্রানীকূলের মাতৃহৃদয়ে কী প্রগাঢ় মমতা!
হাতির দলে যেসব হাতি থাকত প্রাচীন সিলেটে এর বৃহৎ দাতাল দলপতিকে ডাকা হইত গুন্ডা। কখনো কখনো কোন একটি দলের অন্য কোন হাতি গুন্ডার প্রতিদ্বন্ধী হইয়া উঠলে তাদের মধ্যে যুদ্ধ হইত। নতুন হাতি পরাজিত হইলে পালাইয়া যাইত। এইরকম বিভিন্ন দল থেকে বের হয়ে আসা হাতিদের দলকে বলা হইত গুন্ডার দল। এরা বলশালী ও নির্ভীক বলে এদের ধরা সহজ ছিল না।
হাতি ধরার বিষয়টি জাইনা কয়েকবছর আগে একটা অনুগল্প লিখেছিলাম। এই পোস্টের শেষের দিকে তা সংযুক্ত আছে।
ভারত থেকে যে বুনো হাতি আইল বাংলাদেশে, যাকে নিয়ে এত নিউজ হলো এইখানে, তার সম্পর্কে একটু ভাবা যাইতে পারে। সে কেন আসল এইদিকে? এইরকমভাবে তার সমাজ ও সঙ্গীদের ছাইড়া?
তার কী এমন অভিমান? কিংবা সে কী কোন প্রতিবাদে আসল এইদিকে? রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের নাকী? হাতির ভাষা তো আমরা জানি না। তাই হাতির সাথে যোগাযোগের উপায় নাই। কিন্তু প্রতিবাদের জন্য যদি হয়ে থাকে তাইলে সে প্রাণ দিয়াই প্রতিবাদ কইরা গেল।
সত্যমিথ্যা জানিনা, কোথাও পড়েছি হাতিরা তাদের আসন্ন মৃত্যুর সময় বুঝতে পারে। যখন কোন হাতি বুঝতে পারে তার মৃত্যুর কাল নিকঠবর্তী তখন সে নিজেই দূরে চলে যায়। হাতিরা বুদ্ধিমান প্রাণী। তারা কখনো অন্য কোন মৃত হাতির অস্থি কঙ্কাল কিংবা মৃতদেহের সামনে আসলে, দুঃখপ্রকাশ করে। এই বোধ তাদের মধ্যে আছে।
তাহলে এই হাতির বাংলাদেশে আসা কেন? সে কী বাংলাদেশকে হাতিদের শশ্মান মনে করল? সে কী দেখতে পারল ভবিষ্যত চিত্র, যে অচিরেই রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রভাবে সুন্দরবন অঞ্চলের প্রাণীদের জন্য শশ্মানে পরিণত হবে এই দেশ?
দুই
অথবা এই হাতি কি এক বিদ্রোহী হাতি, যে স্বাধীনতার স্বাদ পাইতে চাইছিল। বাধা বন্ধনহীন স্বাধীনতা। তার কি ইচ্ছা ছিল মানুষের ঘরের পাশে প্রতিবেশী হইয়া থাকার? তাদের বাজারে বিকালে গিয়া ঘুইরা বেড়ানোর এবং দিনশেষে তাদের সাথে ফিইরা আসার? সে কী হাতি এবং মানুষদের মধ্যে ভিন্ন ধরনের কোন সম্পর্ক তৈরীর চেষ্টায় ছিল?
এমন হইতে পারে যে সে ছিল হাতি সমাজের এক চিন্তক। হাতিদের ইতিহাস ও প্রচলিত তত্ত্বগুলো মতে মানুষেরা তাদের শত্রু। হাতিদের লোককথায় আছে মানুষেরা তাদের কত পূর্বপুরুষরে ধইরা নিছে। খুন করছে এবং তাদের দাঁত দিয়া বিলাশী পন্য বানাইছে। সেই বিলাশী পন্য, মাথার মুকুট ব্যবহার করছেন রানীরা, বিলাশ করছেন ধনীদের বউ ও পোলা মাইয়ারা। তাদের পূর্বপুরুষদের ধইরা ধইরা নিয়া মানুষেরা সার্কাসে নাচাইছে, চিড়িয়াখানায় ভইরা রাখছে বিনোদনের জন্য। এইসব ইতিহাসই তাদের প্রচলিত ইতিহাস। কিন্তু এই বুনো হাতি, যে হাতি সমাজের প্রথাবিরোধী চিন্তক, সে তার তত্ত্ব দিল আসলে মানুষেরা ভালো। পৃথিবীতে যত প্রানী আছে তন্মধ্যে মানুষেরা বুদ্ধিমান। তারা জ্ঞান, বিজ্ঞান, চিন্তাশক্তিতে আগাইয়া গেছে নিজেদের বুদ্ধিমত্তার জন্য। অতএব, হাতিদের উচিত পুরানা ইতিহাস ভুইলা মানুষের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা। যদি তারা মানুষের লগে ঠিকমত যোগাযোগ করতে পারে, তাহলে মানুষেরা নিশ্চয়ই তাদের বুঝতে পারবে।
এই তত্ত্ব হাতিসমাজ নিল না। তারা বলল, তুমি এইসব বুঝবা না। মানুষের ইতিহাস আমাদের নির্যাতন করার ইতিহাস।
তখন এই বুনো চিন্তক হাতি এরিস্টটল থেকে উদাহরন দিয়া বলল, দেখেন এই মানুষদের একজন শ্রেষ্ট চিন্তক আমাদের বুদ্ধিমত্তার কথা স্বীকার কইরা গেছেন। আধুনিক মানুষদের সাথে যদি আমরা যোগাযোগ করতে পারি তাইলে তারা আমাদের বুকে টাইনা নিব।
হাতিসমাজ তবুও এই প্রথাবিরোধী চিন্তক হাতির কথা মানল না।
তখন প্রথাবিরোধী হাতি ঘোষনা দিল, ঠিক আছে। আমি মানুষের সাথে যোগাযোগের নয়া পদ্বতি বাইর করব। তারপর মানুষের দুনিয়ায় গিয়া তাদের লগে যোগাযোগ কইরা আমি দেখাইয়া দিব। মানুষের সাহায্য নিয়া আমি হাতি সমাজে উন্নতির বিপ্লব আনব। তখন হাতিরাও স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পারবে।
হাতিসমাজ বিরক্ত হইল প্রথাবিরোধী চিন্তক হাতির কথায়। তার শুভানুধ্যায়ীরা তারে অনেক মানা করলো, ভাই মাইনষের দুনিয়ায় যাইছ না। সব কিছু তত্ত্বমতে চলে না। তুই যেভাবে ভাবছ মানুষেরা ঐরকম না। থিওরী হিশাবে তোর চিন্তা ঠিক আছে, কিন্তু এইটা একটা ইউটোপিয়া।
এতে চিন্তক হাতির জেদ আরো চাইপা গেল। সে তার তত্ত্ব প্রমাণ করতে, চোখভরা স্বপ্ন নিয়া চইলা আসল মানুষের জগতে। যেখানে তার নসিবে জুটল ট্রাংকুলাইজার, অবশ হইয়া পইড়া থাকা, চেইনে বান্ধা থাকা, চেইন ছাইড়া পালানো আর সবশেষে অবশ মৃত্যু। হাতিদের সমাজের কোন ভালো লেখক তার জীবনকাহীনি নিয়া একটা এডভেঞ্চার উপন্যাস লেইখা ফেলতে পারবেন।
তিন
২০১১’তে টেকপাড়ায় আলোচনায় আসে হাতি। সবচেয়ে বড় ডোমেইন রেজিস্টারার এবং ওয়েব হোস্টিং কোম্পানি গোড্যাডি’র ফাউন্ডার-তৎকালীন সিইও বব পারসন্স আফ্রিকায় গিয়া একটা হাতি শিকার করেন। এবং তার ভিডিও কইরা পোস্ট দেন, বীরত্বের চিহ্ন স্বরূপ। আগের কালে যেমন খানদানী লোকেরা তাদের ঘরে শিকার করা পশুর মাথার কঙ্কাল ঝুলাইয়া রাখতেন। বর্তমানে এইটা হইছে সোশ্যাল সাইটে ভিড্যু পোস্ট কইরা দিয়া মাইনষেরে দেখানি যে, এই দেখো আমি কত বড় বীর পুঙ্গব। উল্লেখ্য, বব পারসন্স একজন বড় ফিলানথ্রোপিস্ট হিশাবে পরিচিত, নিয়মিত নন-প্রফিট অনেক চ্যারিটি ইত্যাদিরে বিরাট অংকের টাকা দিয়া হেল্প কইরা থাকেন তার ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে।
গোড্যাডি’র সিইও’র এই কর্মের পরে প্রতিবাদ শুরু হইল। তাদের প্রতিদ্বন্ধী নেইমচীপ একটা অফার দিয়া বসল। কেউ যদি গোড্যাডি থেকে নেইমচিপে ডোমেইন নেইম ট্রান্সফার করেন তাহলে এর ফী’র বিশভাগ যাবে সেইভ দ্য এলিফ্যান্টস নামক চ্যারিটি প্রতিষ্ঠানের ফান্ডে।
গোড্যাডি’র সিইও’র হাতিমারায় যারা ক্ষুন্ন হইছিলেন তারা নেইমচিপের এই অফার লুইফা নিলেন। হাজার হাজার ডোমেইন নাম ট্রান্সফার হইতে লাগল নেইমচিপে। অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান এতে সামিল হইলেন। মিডিয়া এইটারে ফোকাস করল। কয়দিনের মাঝেই নেইমচীপের অর্জন হইল প্রায় আশি হাজার ডলার এবং তারা প্রায় বিশ হাজার ডলার সেইভ দ্য এলিফ্যান্টস এর ফান্ডের জন্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হইল।
নেইমচীপের এইটা ছিল বিজনেস কৌশল। বিরাট প্রতিদ্বন্ধীর এই ভুলরে ঠিকভাবে ব্যবহার কইরা তারা ব্যবসাও করেছিল এবং আলোচনাতেও আসতে স্বক্ষম হয়।
চার
এই পর্যায়ে অনুগল্পটা থাকল।
খেদা
আমরা হাতি ধরতে ব্যর্থ হব ভাবাই যায় না। এতক্ষণ আমি সবাইকে বলছিলাম, জঙ্গলে হাতি আছে, অবশ্যই আছে।
তাই এই মৃদু আনন্দ ধ্বনিতে আমার তেমন খারাপ লাগল না। জঙ্গলে হাতির পায়ের ছাঁপ পাওয়া গেছে। আমরা এতক্ষন ঘুরতে ঘুরতে প্রায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। এই অবস্থায় হাতির পায়ের ছাপের দেখা পাওয়া সত্যি আনন্দের।
পায়ের ছাপ একটা দেখা গেছে। আমরা লোক এসেছি সাড়ে চারশ জন। কিন্তু নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। পায়ের ছাপ একটা হলেও এটি একটি বিরাট হাতির দল। হাতিরা তাদের দলপতির পায়ের ছাঁপের উপর পা রেখে চলে। তাই একদল হাতি চলে গেলেও ছাঁপ পড়ে একটার। হাতি ধরায় অভিজ্ঞ বলে আমরা এসব জানি।
সামনেই পাওয়া যাবে হাতিদের।
আমরা এগুতে লাগলাম। এবং সত্যি সত্যি একটু যাওয়ার পর পনেরো ষোলটি হাতির ছোট দল দেখা গেল। আমার ধারণা ছিল আরো বড় দল হবে। তবে যাইহোক এটাকেই কব্জা করতে হবে। আমি লোকজনকে বললাম দলটিকে ঘেরাও দিতে। যারা ঘেরাও দেয় তারা গড়ওয়া। তিনশ চৌত্রিশ জন গড়ওয়া ঘেরাও দিতে লেগে গেল।
বাকী থাকলাম আমরা। আমরা মানে আমরা ষোলজন অভিজ্ঞ পাঞ্জালী।
কয়েকজন নির্দেশ মত গাছের ডালপালা কেটে জড়ো করতে লাগল। এরা হাতিদের সামনে নির্মাণ করবে গড়। হাতির দলের পিছনে আগুন জ্বালিয়ে এদের তাড়িয়ে নিয়ে গড়ে বন্দি করা হবে। সব নিখুঁত পরিকল্পনা করা। আমাদের সবারই মুখস্ত। সবার হাতই অভিজ্ঞ। চোখ ক্ষীপ্র।
সব কাজ শেষ হল দ্রুতগতিতে। আমার নির্দেশ পাওয়া মাত্র তুমুল চিৎকার, বন্দুক ও ঢাকের একটানা ঝাঁঝাঁলো শব্দ জঙ্গলকে কাঁপিয়ে দিতে লাগল। হাতিরা ভয় পেয়ে সামনে এগিয়ে যেতেই পূর্বে জড়ো করা গাছের ডালপালায় দেয়া হল আগুন। হাতিদের ভয় দ্বিগুণ হল। তারা দ্রুত সামনে এগিয়ে গিয়ে প্রবেশ করল গড়ে।
তারা প্রবেশ করা মাত্র আমরা কয়েকজন বন্ধ করলাম গড়ের দুয়ার। পলায়নপর হাতিরা একসময় পিছনের দেয়ালকে ঠেলতে শুরু করল।
তখন শুরু হল আমাদের কাজ, যাকে বলে গড়দাখিল। সুতীক্ষ্ণ বল্লম হাতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমরা। অভিজ্ঞ পাঞ্জালীরা। বল্লমের খোঁচায় খোঁচায় আহত করতে থাকলাম হাতিদের। একপর্যায়ে আহত হাতিরা আস্তে আস্তে শান্ত হল। আমরাও শান্ত হলাম। কাজ প্রায় শেষ। এবার কেবল আমাদের পোষা হাতি গড়ে ঢুকিয়ে এদের বশ করার সহজ কাজটা বাকী।
এমন সময় আমাদের দলের একজন এসে বলল আমাদের পিছনে নাকী আগুন জ্বলছে। বনে কি আগুন ছড়িয়ে পড়ল? আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যাচ্ছে! এমন কখনো হয় নি।
পিছনে আগুন দেখে আমরা কিছুটা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সামনে এগুতে লাগলাম। এগুতে এগুতে একসময় আমাদের থামতে হল। সামনে কঠিন দেয়াল, আমরা পিছনে ফিরতে চাইলাম। কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে অনেক।
আমরা অনুভব করতে লাগলাম আটকে গেছি এক লৌহ কঠিন গড়ে।
পাঁচ
গল্পের শেষে আবার এই হাতির কথায় আসা যাক, যে ভারত থেকে চলে এসেছিল বাংলাদেশে, কোন প্রকার পাসপোর্ট ছাড়াই। সে আজ ১৬ আগস্ট ২০১৬, ভোরের দিকে মারা গেছে। বাংলাদেশের সীমানায় ঢুইকা যাবার ৪৯ দিন পরে সে মারা গেল। এই হাতিকে বঙ্গ বাহাদুর নামে ডাকা হইল, মিডিয়ার জন্য এই হাতিসংস্লিষ্ট বিষয় দারুণ কিছু হিট নিউজ জন্ম দিয়া গেল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী উদ্ধারে নিয়জিত যারা ছিলেন তারা ব্যর্থ হইলেন। এইখানে মুগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনীতে পড়া একটা বিষয় মনে পড়ে। সম্রাট আকবরের এক অসাধারন ক্ষমতা নাকী ছিল, তিনি অবাধ্য, দুরন্ত হাতিদের বশে আনতে পারতেন। যেইসব হাতিরা অনেক মাহুত মাইরা ফেলছে এমন ভয়ংকর হাতিদের পিঠের উপরে তিনি গাছের ডাল থেকে লাফাইয়া পইড়া তাদের বশে নিয়া আসতেন। এই ক্ষমতা আকবরের ছিল, এইরকম ক্ষমতাধর কোন ব্যক্তি থাকলে হয়ত ভারত থেকে আসা এই হাতিকে বাঁচানো যাইত।
১৫৯০ থেকে ১৫৯৫ এর মধ্যে উপরের ছবিটি আঁকা হয়। আঁকছেন দুইজন শিল্পী যাদের নাম, বাসাওয়ান এবং মুন্তী। এই ছবিটা বিখ্যাত আকবরনামার জন্য আঁকা হইছিল। এইখানে আকবরের জীবনের একটা কাহিনী তুইলা ধইরা হইছে। আবুল ফজলের বর্ননা মতে হাওয়াই নামে এক ভয়ংকর হাতি ছিল, তারে কেউ বাগে আনতে পারত না। আকবর তার পিঠে চইড়া বসলেন এবং রান বাঘা নামে সম শক্তির আরেক হাতির লগে এর ফাইট লাগাইয়া সেইটারেও বশে আনলেন। এই হইল কাহিনী।
প্রাচীন মুগল ভারতীয় চিত্রকলার এক অপূর্ব নিদর্শন এই ছবি।
প্রাচীনকালে রাজা বাদশাদের ব্যাপারে এইরকম গল্প আছে তাদের নাকী পশুপাখিরাও চিনতে পারত। এমন কাহিনী শোনা যায় দুরাবস্থায় পইড়া রাজার পোলা, যিনি ভবিষ্যতে সম্রাট হইবেন, তিনি পইড়া গেছেন হাতির সামনে বা বাঘের মুখে। কিন্তু এই প্রানীগুলা তাদের কিছু করে নাই।
এইরকম অলৌকিকত্ব আরোপ কইরা এই রাজা বাদশাদের মহান করার একটা চেষ্টা থাকে। কিন্তু কেন এইরকম হয়? যাহা রটে, তাহা কিছু না কিছু ঘটে, এই কথার সূত্র ধইরা অনেকে বলবেন এর কিছু নিশ্চয়ই সত্যি ছিল। কিন্তু আসলে বিষয়টা বুঝতে হইলে বুঝতে হবে তখনকার দিনে রাজাদের কীভাবে দেখত লোকে। তখনকার দিনে লোকেরা মনে করত রাজা বা রাজার পোলাদের রজত্ব করার একটা ঐশ্বরীক অধিকার আছে। ডিভাইন রাইট থিওরী। এই ধারণা থেকে অলৌকীকত্ব আরোপের চেষ্টা করা হইত। হিংস্র প্রানী বাগে পাইয়া রাজারে মারল না, মানে ঈশ্বরের আশীর্বাদ আছে তার প্রতি। তাই দেখবেন তখনকার দিকে রাজারা ঐশ্বরীক কাজকর্ম, ঈশ্বরের সেবা উপাসনা, তিনি যে ধর্মে বিশ্বাস করেন তা ছড়াইয়া দেয়া ইত্যাদিরে অধিক গুরুত্ব দিয়া নিতেন। এইরকম যে বড় সম্রাট নেন নাই তিনি হইলেন চেঙ্গিস খান। চেঙ্গিস খান অনেক চড়াই উৎরাই পার হইয়াই সমগ্র মঙ্গোলিয়ার খান হইছিলেন। নিজে পর্বতের দেবতা তেংরি’রে মানলেও তা ছড়াইয়া দেয়ার তার কোন মিশন ছিল না। পরবর্তীতে চেঙ্গিস খান সফল হইবার পর তিনি এবং তার পর্বতের দেবতা তেংরি নিয়াও নানা কাহিনী বানাইছে লোকে। রাজারে ঐশ্বরীক অধিকার দেয়ার জন্যই। তাদের স্তরেরই একজন তাদের রাজা হইয়া যাবে এটা বোধহয় মানুষ মানতে চাইত না।
এই প্রবণতা এখনো এইদেশের মানুষের মাঝে আছে, কিছুটা অন্যভাবে। নিজেদের মধ্য থেকে কেউ একটা ভালো কিছু করলে তারে কৃতিত্ব দেয়ার বা গ্রহণ করার কালে এইদেশের মানুষ যত ভাবে, বিদেশী একজন হইলে অত ভাবে না। বিদেশী, শাদা চামড়া ইত্যাদি দেইখা ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভুইগা বিদেশীদের গ্রহণ করে সহজে, যেমন পশ্চিম পকিস্তানের নেতাদের সামনে গিয়া কথা বলতে পারত না এইদেশের নেতারা (সবাই না)। এইটা প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের স্বাক্ষাতকার মূলক বই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ-এ পাওয়া যায়; স্বাক্ষাতকার নিছেন সরদার ফজলুল করিম। তার একটা অংশ এইরকমঃ
অধ্যাপক রাজ্জাক বললেন, আরে আমি একদিন আমার চোখের সামনেই দেখলাম আমাদের এক লিডার আমজাদ আলীকে বলছে, স্যার আপনিই প্রথম ফাইন্যান্স মিনিস্টার যে আমাদের সঙ্গে ভালো করে কথা কইছেন! এই কথা শুনে একদিন মিটিং এর পরে তাঁকে ধরলামঃ ব্যাপার কি? আমজাদ আলী এসেম্বলী মেম্বার, আপনিও এসেম্বলী মেম্বার। আর আপনি তার লগে এইভাবে কথা কইবার লাগছেন। আপনাদের এডভাইস দিতে আসে কোন পাগল!
দেশের বা নিজেদের কোন একজনের কাজরে স্বীকৃতি বা তারে গ্রহন করার ক্ষেত্রে মানুষের মাঝে কাজ করে পরশ্রীকাতরতা। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লেইখা গেছেন নিজেকে না চিনলে এই জাতির মুক্তি নাই, এইটা চরম সত্য একটা কথা।
আমাদের বাঙালীর মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল ‘আমরা মুসলমান’ আর একটা হল ‘আমরা বাঙালী’। পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, ‘পরশ্রীকাতরতা’। পরের ‘শ্রী’ দেখে যে কাতর হয় তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালীদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই এই জাতির সকল রকম গুন থাকা স্বত্তেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ার খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরীব। কারণ যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজেকে এরা চিনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।
– জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
চেঙ্গিস খানে আবার ফিইরা যাওয়া যাক। চেঙ্গিস খান অন্যান্য সম্রাটদের মত ঐশ্বরীক আদেশ, দৈব বানী বা প্রাচীন সভ্যতা থেকে কোন আইন নেন নাই। তিনি যখন মঙ্গোলিয়ার বিভিন্ন ট্রাইভরে একত্র করে সংঘটিত করলেন, তখন আইন বানাইছেন যুগ যুগ ধরে চলে আসা তাদের বিভিন্ন ট্রাইভের প্রথার উপরে ভিত্তি করে। তিনি তার আইনে দাস প্রথা উচ্ছেদ করেন, আমেরিকাতেই যা হইল অনেক অনেক পরে, আব্রাহাম লিংকনের মত লোকদের চেষ্টায়। চেঙ্গিস ঘোষনা দেন অবৈধ সন্তান বলে কিছু নাই, অধিকার সব সন্তানের সমান হবে। পশু চুরিরে মারাত্মক শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিশাবে রাখা হইছিল। এমনকী কোন পশু বা দ্রব্য কুড়িয়ে পাইলেও তা নিতে পারত না কেউ, নিলে সোজা মৃত্যুদন্ড। আর আরেকটা আইন তিনি করছিলেন খুব গুরুত্ব দিয়া, কারো বউ অপহরন করা যাবে না। তার প্রথম বউরে অপহরন কইরা নিছিল আরেক গোত্র, যে গোত্র থেকে একসময় তার মারে অপহরণ কইরা আনছিলেন তার বাবা। চেঙ্গিস খান তখন মনে হয় খুব ছোট এক দলের নেতা ছিলেন, যখন তার বউ অপহরণ হয়। এর কিছুদিন পর অন্য এক খানের সাহায্য নিয়া তিনি তার বউরে উদ্ধার করেন। তখন তার বউরে তিনি পান প্রেগন্যান্ট অবস্থায়। এই সন্তান তার কী না এই নিয়া লোকমুখে কিছু সংশয় ছিল। কিন্তু চেঙ্গিস বউ ও সন্তানরে গ্রহণ করতে দ্বিধাও করেন নাই।