আলী আবুর জুতাই আলী আবু

১৩ হিজরীতে আঁকা মোগল ছবি।

অলক্ষুণে জুতো নামে একটি গল্প আছে। যেখানে প্রধান চরিত্র বাগদাদ শহরের ধনী অথচ কৃপণ লোক আলী আবু এবং তার জুতা। আলী আবু অনেক অনেক বছর ধরে জুতা বদল করতেন না। তিনি সেলাই করিয়ে, বার বার সেলাই করিয়ে, তালি লাগিয়ে একই নাগরাই জুতা পরতেন। ফলে তার জুতা পরিচিত হয়ে উঠেছিল সবার কাছে।

একদিন আলী আবুর বন্ধু তার জুতা নিয়ে মজা করলেন তার সাথে। আবু তখন গোসলখানায়। বের হয়ে তিনি দেখলেন তার জুতার জায়গায় একটি কারুকাজময় নতুন জুতা রাখা আছে। তিনি ভাবলেন এই জুতা হয়ত তার বন্ধু তার জন্যই রেখে গেছে। তিনি জুতা পরে চলে আসলেন বাড়িতে।

১৩ হিজরীতে আঁকা মোগল ছবি।
ছবিঃ ১৩ হিজরীতে আঁকা মোগল ছবি।

কিন্তু আসলে সেই জুতাটি ছিল কাজির জুতা। কাজি বের হয়ে দেখলেন তার জুতা নেই। খুঁজে দেখা গেল আবুর জুতা রয়েছে শুধু। কাজি বুঝতে পারলেন আলী আবুই তার জুতা নিয়ে গেছেন।

এর জন্য জুতা চোর হিসেবে আবু আলির শাস্তি হয়।

রাগে দুঃখে আলী আবু জুতা নদীতে ফেলে দেন। সেখানে এক জেলে জুতাটি পায়। সে আবুর জুতাটি চিনতে পারে। সে ভাবে হয়ত আবুর জুতাটি হারিয়ে গেছে। কারণ সবাই জানত এই জুতা কখনো আবু পা ছাড়া করতে চান না। জুতাটি সে নিয়ে আসে আবুর বাসায়। আবু তখন বাড়িতে ছিলেন না। জেলে বাসার জানলা দিয়ে ছুঁড়ে দেয় জুতা জোড়া। যাতে পরবর্তীতে আলী আবুর কাছ থেকে জুতা খুঁজে দেবার জন্য বখশিশ আদায় করা যায়।

জুতা ভিতরে গিয়ে পড়ে কাচের বোতলে। বোতলগুলো মেঝেতে পড়ে ভেঙ্গে যায়। এই বোতলগুলো এবং এর ভেতরে দামী সুগন্ধী রেখেছিলেন আবু ব্যবসা করার জন্য। সব নষ্ট হয়।

বাসায় ফিরে এই অবস্থা দেখে ক্ষীপ্ত হন আলী আবু। তিনি সেই রাতেই জুতাকে মাটি চাপা দেয়ার জন্য গর্ত খুঁড়তে শুরু করেন এক জায়গায়, দেয়ালের ধারে। কিছু লোক তাঁকে সেই অবস্থায় দেখে। তাদের মনে হয় তিনি হয়ত চুরি করতে যাচ্ছেন। তাই তাঁকে ধরে নেয়া হয় কাজির কাছে। আলী বলেন তিনি জুতা মাটি চাপা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একথা কে বিশ্বাস করবে! যে জুতা এতদিন তিনি সেলাইয়ের পর সেলাই করে পরেছেন তা কেন গর্ত চাপা দিবেন, লোকেরা বিশ্বাস করতে পারল না। পুনরায় শাস্তি পেতে হয় তার।

এরপর আবু জুতা ছুঁড়ে ফেলে দেন। ঘটনাক্রমে তা গিয়ে পড়ে এক ছেলের ঘাড়ে। সে অজ্ঞান হয়ে যায়। লোকেরা আবুর নাগরাই জুতা চিনতে পারে। তারা বিচার নিয়ে যায় কাজির কাছে। আলী আবার শাস্তি পান।

এই হলো, অলক্ষুণে জুতা গল্পের এক সংক্ষিপ্ত সার। গল্পটি লিখেছেন মোহাম্মদ নাসির আলী। গল্পটি আমাদের পরিচিত। আমরা প্রায় সবাই বাংলা সহপাঠে গল্পটি পড়েছি। কিন্তু এই গল্পের মূল বিষয়টি কী?

সাধারনভাবে মনে হয়, নীতিশিক্ষা এই যে কৃপণতা করা ভালো নয়।

কিন্তু, আরো অনেক কৃপণ লোক আছেন, হয়ত আলী আবুর সমাজেই তারা ছিলেন। তারা আলীর মত খারাপ অবস্থায় পড়েন নি। অর্থাৎ, কৃপণতা আলী আবুর দুর্দশার মূল কারণ নয়।

গল্পে  আলী আবুর দুর্দশার কারণ তার জুতা। যে জুতা আসলে আর জুতা থাকে নি, তার মূল পরিচয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ হয়ে উঠেছিল। জুতা আলী আবুর অস্তিত্বের চাইতে শক্তিশালী অংশে পরিণত হয়, তার পরিচয়ের ক্ষেত্রে। আবু তার সেই অংশকে হঠাৎ করে বাদ দিতে চেয়েছিলেন জীবন থেকে। এ কারণেই তাঁকে দুর্দশায় পড়তে হয়েছিল।

প্রথম ক্ষেত্রে, গোসলখানা থেকে বের হয়ে তার উচিত ছিল নিজের জুতার খোঁজ করা। এত দামী জুতা বন্ধু রেখে যাবে এমন মনে করা আলী আবুর ভুল ছিল। কিন্তু এই ভুল তিনি করেছেন তার জুতা নিয়ে বন্ধুর করা মজা ও কৌতুকপূর্ন কথাগুলোকে আমলে নিয়ে। জুতা এই ভুলের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ন প্রভাবক। কাজি আবুর জুতা পড়ে আছে দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন জুতা নিয়ে গেছে আলী আবু। এরপর থেকে আবু যেসব দুর্দশায় পড়েছেন তাদের সাথে তার জুতা সরাসরি জড়িত। লোকেরা তার জুতাকে চিনতে পারত।

আবু ব্যক্তি হিসেবে সৎ বা অসৎ তা কেউই বিবেচনা করতে যান নি। জুতা দেখেই তারা সিদ্ধান্তে গিয়েছেন। এটা প্রমাণ করে আবুর পরিচয়ের ক্ষেত্রে তার ব্যক্তিস্বত্তার চাইতে জুতা বড় হয়ে উঠেছিল।

আবু প্রথমে যদি বুদ্ধিমান ও সচেতন হতেন তাহলে জুতাকে তার অংশ হয়ে উঠতে দিতেন না। স্বাভাবিকভাবে জুতা বদল করে পরলে জুতা তার পরিচয়ের অংশ হয়ে উঠত না। কিন্তু সেদিকে তিনি লক্ষ দেন নি। ফলে তাঁকে ছাপিয়ে জুতাই প্রধান হয়ে উঠে। তখন তার অস্তিত্বের অবস্থা হয় নিম্নরূপঃ

মানুষ আলী আবু  + আলী আবুর জুতা = আলী আবুর সামগ্রিক পরিচয়

আলী আবুর জুতা > মানুষ আলী আবু

ধরা যাক, জনাব সাত্তার একটি রাজনৈতিক দলের কর্মী। দলটির নাম ক দল। ক দলের কর্মী হিসেবে জনাব সাত্তার এমনভাবে তৎপরতা চালালেন যে সমস্ত এলাকায় তার পরিচয়ের সাথে ক দল যুক্ত হয়ে পড়ল। একসময় জনাব সাত্তারের পরিচয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ হয়ে উঠল তিনি ক দলের কর্মী। ফলে, ক দলের ভালো মন্দ কাজের দায়ভার বা ফলাফল জনাব সাত্তারকে ভোগ করতে হতে পারে। জনাব সাত্তারের পরিচিতির সাথে ক দলের এই যুক্ত হওয়া, তার ব্যক্তিস্বত্তা ছাপিয়ে সেই পরিচয়ের বড় হয়ে ওঠা, আলী আবুর পরিচয়ের সাথে তার জুতার যুক্ত হওয়ার মত ঘটনা।

একজন মানুষ সচেতনভাবে বা অবচেতনে কিছু জিনিসকে তার পরিচয়ের অংশ করে তোলে। আলী আবু যেমন তার জুতাকে করেছিলেন। লেবেল যত কম থাকবে তত মানুষ তার নিজের পরিচয়ে থাকতে পারবে। লেবেলের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে তার পরিচয়ের সাথে কিছু কিছু জিনিস যুক্ত হতে থাকে। সেইসব লেবেল যদি তার নিজ অস্তিত্বের চাইতে বড় হয়ে উঠে, পরিচয়ের সর্বাধিক শক্তিশালী অংশ হয়ে উঠে তাহলে, সেটি তার স্বাধীনতা হরণ করে নিতে পারে।

দেখা যায় রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বিষয় নিয়ে অনলাইনে বেশী বিতর্ক হয় এবং তা ব্যক্তি আক্রমণে চলে যায়। কম্পিউটার প্রোগ্রামারদের ফোরাম আছে, এঞ্জিনিয়ারদের আছে, আরো  এরকম পেশাজীবিদের কম্যুনিটি আছে। সেসব বিষয়ে বিতর্ক হলে তা ব্যক্তি আক্রমণে যায় না সাধারণত যেমন রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বিতর্কগুলো যায়।

এর কারণ রাজনৈতিক বা ধর্মীয় অবস্থানকে মানুষ তার পরিচয়ের অংশ হিসেবে নিয়ে নেয়। এবং এই লেবেলগুলো তার পরিচয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ হয়ে উঠে। এই কারণে এই বিষয়ে যেকোন মন্তব্য সে সরাসরি ব্যক্তিগতভাবে নেয়। তার বিবেচনাবোধ লোপ পায়। এর পক্ষে বা বিপক্ষে সরাসরি যুদ্ধে নামে। লেবেলই তখন তাঁকে পরিচালিত করে।

ধরা যাক, একজন লোক লেবেল নিলেন “লেখক”। তার এই লেবেল তার নিজস্ব ব্যক্তি অস্তিত্বের চাইতে শক্তিশালী হয়ে উঠলে তার মানবস্বত্তার স্বাধীনতা লোপ পাবে। তিনি হয়ে উঠবেন তার লেখক স্বত্তার ক্রীড়নক।

আলী আবুর দুর্দশার তার জুতার হাত থেকে মুক্তি পাবার যুদ্ধ আসলে তার লেবেলের হাত থেকে মুক্ত হবার যুদ্ধ, তার স্বাধীন হবার যুদ্ধ। গল্পের শেষে, দুর্দশার ভেতর দিয়ে গিয়ে তিনি তার লেবেল ছেড়ে মুক্ত হতে পারেন।

আলী আবুর জুতা বিষয়ক এই গল্পের শিক্ষাটা হলো এই যে, আলী আবুর জুতার মত আপনার জুতা অর্থাৎ লেবেল, যেন আপনার ব্যক্তি অস্তিত্ব ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠতে না পারে, সেদিকে লক্ষ রাখেন।

 

পড়তে পারেনঃ মিথ্যেবাদী রাখালের গল্প

এবং বাদশা আলমগীর, তাহার কুমার ও মৌলবী বিষয়ে