এই বিখ্যাত রোমান্টিক গান আছে তালাত মাহমুদের গাওয়া, কে জি মোস্তফার লেখা এবং রবিন ঘোষের সুর করা। এটি ব্যবহার করা হয়েছিল পরিচালক এহতেশাম পরিচালিত রাজধানীর বুকে ফিল্মে। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬০ সালের ২ সেপ্টেম্বর। এই ফিল্মটি ছিল এহতেশামের দ্বিতীয় ছবি এবং জনপ্রিয় হয়।
ফিল্মের যে গানের বিশ্লেষন করা হয়েছে এখানে, তা আপনি যদি ফিল্মের গল্পের আলোকে বুঝতে যান, তাহলে বুঝতে পারবেন না। যে গল্প বলা হয় সে গল্পের বাইরেও আরো গল্প থাকে। লেখা বিভিন্ন লাইন বা অক্ষর আমাদের নির্দিষ্ট কিছু বুঝায় না, আরো কিছু অক্ষর বা আইডিয়ার কাছে আমাদের নিয়ে যায়। লেখায় যা বুঝিয়েছেন লেখক, যা বুঝেছেন পাঠক তাই শেষ কথা নয়। লেখার অর্থ লেখকের কাছে থাকে না, পাঠকের কাছেও নয়; লেখাতেই থাকে।
——
গানের কথা আপনারা প্রায় সবাই হয়ত জানেন। এই গান শুনে যা আপনারা বুঝে থাকেন, গানটি প্রেমিকার সৌন্দর্য বুঝাতে আসলে কিন্তু তা নয়। এই গান একটি নার্সিসিস্ট গান। এখানে যিনি গাইছেন অর্থাৎ নায়ক নিজের রূপে-গুণে নিজে মুগ্ধ।
গানের প্রথম দুই লাইন- “তোমারে লেগেছে এতো যে ভালো/ চাঁদ বুঝি তা জানে”।
অর্থ গায়ক তথা প্রেমিক বলছেন, তার প্রেমিকাকে তার ভালো লেগেছে, এবং চাঁদ হয়ত তা জানে।
পরের দুই লাইন – “রাতের বাসরে দোসর হয়ে/ তাই সে আমায় টানে”।
এর অর্থ কী? রাতের বাসরে চাঁদ এসে কাকে টানছে? প্রেমিক বলছেন তাকে টানছে। তাকে কেন টানছে? কারণ চাঁদ ঈর্ষান্বিত। কেন ঈর্ষান্বিত? কারণ তিনি তার প্রেমিকাকে ভালোবাসছেন বেশী।
চাঁদ এখানে অন্য নারী। ঐ অবস্থার প্রেক্ষিতে সুন্দরী পরনারী। প্রেমিকরে এসে সে টানতেছে তার উহ্য অর্থ হলো, প্রেমিক এত ভালো, এত সুন্দর, এতোই তিনি প্রেমিকা ভক্ত যে অন্য সুন্দরী নারী এসে তাকে টানছে। এখানে প্রেমিকার রূপের বর্ননা কোথায়? নাই। প্রেমিকই এখানে মূল চরিত্র। তিনি গানের কথায় প্রেমিকার কাছে বুঝিয়েছেন তার গুরুত্ব।
পরের দুই লাইন – “রাতের আকাশে তারার মিতালী/ আমারে দিয়েছে সুরের গীতালী।”
রাতের আকাশে অনেক তারা, তারা কীভাবে ডাকে? হাতছানি দিয়ে। এইসব তারা’রা প্রেমিককে দিয়েছে সুর। গুরুত্বপূর্ন বিষয়, তার প্রেমিকা তাকে সুর দেন নি, তিনি সুরের অনুপ্রেরনা নিয়েছেন তারাদের কাছ থেকে। এই তারা’রা, এত দূরের তারা’রা তার মত নাদান প্রেমিককে কেন সুর দিতে যাবে? ভাবুন এই তারা’রা ফিল্মজগতের বড় সুন্দরী নায়িকারা, যেন তারা সবে মনিকা বেল্লুচ্চি। তো তারা কেন তাকে সুর দিবে? তার প্রেম দেখে? হয়ত, কিন্তু এখানে এইসব তারাদের কাছ থেকে সুর পাওয়ার কথা বলে প্রেমিক নিজের গুরুত্বই প্রকাশ করছেন। খুবই গুরুত্বপূর্ন কেউ না হলে স্টাররা কি সুর দিতে আসবে?
পরের দুই লাইন – “কত যে আশায় তোমারে আমি/ জ্বালিয়ে আমি রেখেছি দ্বীপালী।”
এই লাইন দুটি দেখেন, প্রায় অর্থহীন। “আমি”র অতি ব্যবহার। আর প্রেমিক বলছেন তিনি অনেক আশা করে প্রেমিকাকে জ্বালিয়ে রেখেছেন দ্বীপালির মত। তিনি প্রেমিকাকে এ কথা বলছেন। অর্থাৎ, তিনি না থাকলে প্রেমিকা জ্বলতে পারতেন না। এটা বুঝায় আমি অনেক আশা করে তোমাকে সৌন্দর্য দিয়েছি বা আরো স্পষ্টভাবে আমি অনেক আশা করে তোমার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছি।
পরের দুই লাইন – “আকুল ভ্রোমরা বলে সে কথা/ বকুলের কানে কানে।।”
এখানে প্রেমিক বলছেন, তিনি যে তার প্রেমিকাকে জ্বালিয়ে রেখেছেন, বা প্রেমিকার জন্য এত করেছেন, তা ভ্রমরাও জানে এবং তা বকুলকেও কানে কানে বলে দিয়েছে। এটা আসলে একটা থ্রেট। প্রেমিকাকে তিনি বলছেন, আমি তোমার জন্য যা করেছি তা অনেকে জানে এবং তা ছড়িয়ে পড়ছে। অতএব, আমার চাহিদা পুরন করা উচিত তোমার। কেউ আরো ভাবতে পারেন, প্রেমিক বলছে আমার কাছে কিন্তু ভিডিও আছে এবং কীভাবে ইন্টারনেটে আপলোড করতে হয় তা আমি জানি। খুবই সফটলি বলা হয়েছে, শব্দের মারপ্যাচে তাই এর অর্থ প্রথম পড়ায় বুঝা যায় না। নাহলে ভেবে দেখুন, এটা বলার কি দরকার ছিল!
উপরে লাইনগুলিতে একের পর এক বিভিন্নভাবে প্রেমিক তার গুরুত্ব উপস্থাপন করে গেছেন। শেষের দিকে এসে তিনি সুর নরম করেন। তিনি বলেনঃ
“এত যে কাছে চেয়েছি তোমারে
এত যে প্রীতি দিয়েছ আমারে।
এত যে পাওয়া কেমনে সহিব
একাকী আমি নীরব আঁধারে।
আকুল পাপিয়া ছড়ায়ে এ কথা
বাতাসের কানে কানে।।”
এখানেও তিনি শুরু করেছেন তার নিজের চাওয়া দিয়ে, কিন্তু কত গভীরভাবে প্রেমিকাকে চেয়েছেন, তা বলছেন। অপূর্ব! আগের দুই লাইনে পরোক্ষ থ্রেট দেবার পর এখানে এসেই ইমোশনে টাচ করেছেন। এর পরে তিনি বলছেন প্রেমিকা তাকে খুব ভালোবেসে যাচ্ছেন, এবং এগুলোও পাপিয়া ছড়াচ্ছে বাতাসে। অর্থাৎ, তাদের একটা ভালো সম্পর্ক চলছে, প্রেমিকা ভালোবাসছেন; এটাও সমাজ জানছে।
আমার ধারণা, এই প্রেমিক তার প্রেমিকাকে কোন কারণে সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন। তাই পরোক্ষভাবে রোমান্টিক সুরে তিনি কিছু কথা তাকে বলে গেলেন। এই নার্সিসিস্ট প্রেমিক ভয় পাচ্ছিলেন তার প্রেমিকা হয়ত তাকে ছেড়ে যাবেন। এরও কারণ আন্দাজ করা যায়। হয়ত তার অতি নার্সিসিজমে তার প্রেমিকা অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। যেহেতু প্রেমিকার বক্তব্য জানার উপায় নেই তাই আমরা জানতে পারব না তার মনোভাব কী ছিল।
৩১ মার্চ, ২০১৭