প্রজাপতি ও জংলি ফুলের উপাখ্যান

প্রজাপতি ও জংলি ফুলের উপাখ্যান - মাসুদ খান

কবি মাসুদ খানের বই প্রজাপতি ও জংলি ফুলের উপাখ্যান পড়লাম কিছুদিন আগে। এই বইটি ভালো লাগল। এর আকার ছোট, একশো পেইজ। এটি প্রকাশ করেছে চৈতন্য। ২০১৬ সালের একুশে বইমেলায় প্রথম প্রকাশিত হয়।

প্রথমে মনে হয় লেখক কাব্যিক গদ্যে তার আত্মজীবনী’র মত কিছু একটা লিখে যাচ্ছেন। গদ্য সুন্দর এবং কাহিনীগুলিও। বইয়ে একটু এগিয়ে গেলে “হকসেদ” নামে এক চরিত্র আসে। লেখকের কথায় “সময়, ইতিহাস ও ভূগোলের বাইরে থেকে উঠে-আসা এক রহস্যমানব।”

এই হকসেদ ইন্টারেস্টিং চরিত্র। সে ইতিহাস, ধর্ম, পুরাণ, দর্শন সব বিষয়েই শক্ত জ্ঞান রাখেন এবং এসব বিষয়ে আপডেটেড তথ্য তার কাছে চলে আসে। নো’ম চমস্কি এবং দেরিদা তাকে চিঠি লিখেন। বিস্ময়কর ব্যাপারই বটে কারন যেই চমস্কি,  দেরিদা এবং তাবত উত্তরআধুনিক ফিলোসফির বিরুদ্ধে নাখোশ তিনিও হকসেদকে গুরুত্ব দেন; দেরিদাও গুরুত্ব দেন। উভয় দিকেই হকসেদের  যোগাযোগ।

প্রজাপতি ও জংলি ফুলের উপাখ্যান - মাসুদ খান
ছবি- প্রজাপতি ও জংলি ফুলের উপাখ্যান – মাসুদ খান

হকসেদ যে এত কিছু জানে, তা কীভাবে জানে তাও বিস্ময়ের। তার ঘরে বিদ্যুতই নেই, ইন্টারনেট থাকা তো দূরের কথা। তাছাড়া তার পেশাও খুব ভালো কিছু না। লেখকের কথায়, “ভাঙাচোরা পোড়া-পোড়া মেছতাপড়া চেহারা, কোষ্টা পাটের দড়ির মতো পাকানো দীর্ঘ শরীর, তার ওপর সে খোঁড়া, আবার খোজাও, পেশায় ছিঁচকে চোর, খুচরা লুচ্চামি-লাম্পট্যে ওস্তাদ, কিন্তু মহাজ্ঞানী, মহাপণ্ডিত।”

এই বর্ননা থেকে এবং এই হকসেদের অন্যান্য কার্যাবলী থেকে মনে হয় যে, হকসেদের কর্মকান্ড কোন স্যাটায়ার আসলে। বইটি মাঝপথে এবং শেষের দিকে আসার আগ পর্যন্ত একরকম স্যাটায়ার হিসেবেই মনে হতে থাকে, যেখানে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে হকসেদ তার ঝাঁঝালো মন্তব্য করতে থাকে। যেমনঃ

“আইজকাল দেখি সাহিত্যিকগুলার পারফর্মিং আর্ট শালার হনুমানের কাইনেটিক আর্টরেও ছাড়াইয়া যাইতেছে-গা। আরে, বোঝস-না ক্যান ব্যাটারা- একজন রিয়াল কবি, রিয়াল সাহিত্যিক হইল “ভয়েস অব হিজ ট্রাইব’। তার তো এক বসন্ত বাঁচলে চলে না, তারে বাঁচতে হয় এক যুগ পার হয়া আরেক যুগ, অনেকগুলান শীত গ্রীষ্ম বসন্ত…কী কস মোমিন? ঠিক কিনা? আরে! কথা কস না যে! আজব!”

  • [ প্রজাপতি  জংলি ফুলের উপাখ্যান,  অধ্যায়ঃ ইরোটিকস অব আর্ট এন্ড কালচার]

একটি সাহিত্য আসরে গিয়ে হকসেদ যখন দেখে যে, ক্লোজ আপ ওয়ানের মত কবিতা প্রতিযোগীতা হচ্ছে তখন হকসেদ পিওর আর্ট আর পারফর্মিং আর্টের পার্থক্য করে উপরোক্ত উক্তি করে।

হকসেদের সাহিত্য, সমাজ ইত্যাদি বিষয়ে তীক্ষ্ণ মন্তব্যগুলি পড়তে পড়তে এবং তার অদ্ভুত কার্যাবলী পড়তে পড়তে মনে হয়, লেখক এই চরিত্র দিয়ে বুঝালেন কী। উপরে দেরিদার কথা এসেছে, দেরিদা ফরাসি ভাষায় চিঠি দেন হকসেদকে। দেরিদার তত্ত্ব হল বিনির্মান বা ডিকন্সট্রাকশন। দেরিদার ভাষাতত্ত্বের তত্ত্ব মতে, লেখার কোন অর্থ নাই কনটেক্সট এর বাইরে। অর্থাৎ, লেখার চিহ্ন এবং শব্দাবলী, আরো কিছু শব্দাবলীর কাছে নিয়ে যায়, বাইরের কোন কিছুরে বুঝায় না। সসোর যা বলেছিলেন, কোথাও “চেয়ার” (সিগনিফায়ার) লেখা থাকলে তা বাস্তব জগতের বস্তু চেয়ারকে (সিগনিফায়েড) বুঝায়, দেরিদা এই ধরনের ধারণার বিরুদ্ধে মত দেন।

এবং কোন টেক্সটের অর্থাৎ লেখার এক “ঠিক” অর্থ বলে কিছু নাই, বিভিন্ন অর্থ সম্ভব ও বিদ্যমান। এই বিনির্মানের সাহিত্য সমালোচনা ব্যবহার করে, কোন টেক্সট ভাইঙ্গা দেখানো যায় তার  অর্থ যা ধরা হয় তার চাইতে ব্যতিক্রম।

হকসেদরে পড়তে পড়তে আমার মনে হলো যে অর্থটা আসলে কোথায়। আমি যা পড়ছি, যেইভাবে বুঝছি, লেখক কি তা বুঝিয়েছেন? নাকী এই হকসেদ, এই স্যাটায়ার তিনি কিছু ইঙ্গিত করে করছেন যা আমি বুঝতে পারছি না। এইভাবে ভাবতে ভাবতে আমি একবার দেখলাম হকসেদ হকসেদ হকসেদ কয়েকবার এভাবে একটানা বললে তা সৈয়দ হক এর মত সাউন্ড হয়! যেমন, জাপানি লেখক এদোগাওয়া রানপো’র নাম কয়েকবার উচ্চারন করলে মনে হয় এডগার এলান পো এর মত। তারা হিরাই তথা এদোগাওয়া রানপো ছিলেন এডগার এলান পো এর দারুণ ভক্ত তাই ইচ্ছা করেই নিজের ছদ্মনাম রাখেন এদোগাওয়া রানপো। এই জংলি ফুলের আখ্যানে খোজা হকসেদের নাম যে সৈয়দ হকের মত সাউন্ড দেয়, তাও লেখকের ইচ্ছাকৃত কি না জানা যায় না। এটা জানা গেলে যে লেখাটি পড়লাম তার এক ভিন্ন অর্থ তৈরী হতো, এবং যদি দেখা যেত ইচ্ছা করেই রাখা হয়েছে এমন নাম, তখন হকসেদ খোজার কর্মকান্ড আরেক ধরনের অর্থের সন্ধান দিত।

এই বইয়ের কাহিনীগুলি যেভাবে আলাদা ভাবে উপস্থাপিত এবং একেবারে আলাদাও না, এরকম উপস্থাপন আছে সুইডিশ পরিচালক রয় এন্ডারসনের ফিল্মে। বিশেষত  প্রিয় একটি ফিল্ম সংগস ফ্রম সেকন্ড ফ্লোর বা দ্বিতীয় তলা হতে আগত গান এর কথা আমার বিশেষ মনে পড়ছে এক্ষণে। ফিল্মটিতেও এক ধরনের ডার্ক স্যাটায়ার আছে, পরাবাস্তবতার মোড়কে আছে নৈরাশ্য, মানুষের সম্পর্ক-সমস্যার সোজা উপস্থাপন। যেমন জংলি ফুলের আখ্যানের “মধু ও বিষাদের ঐকতান” অধ্যায়;  এক পিতা ও পূত্রের যোগাযোগের সমস্যার দিকে দৃষ্টিপাত। ছেলে বড় হয়ে ফিরে এসেছে বিদেশ থেকে, বৃদ্ধ বাবা। দারিদ্রপীড়িত মা ও বাবা অনেক আগে ছেলেটিকে তুলে দিয়েছিল এনজিও’র এক বিদেশীনির হাতে। ছেলে বড় হয়ে ফিরে এসেছে বাপকে দেখতে কিন্তু পিতা এবং পুত্র যেন যোগাযোগ করতে পারছে না, কোথাও সুতা ছিঁড়ে গেছে।