পাকিস্তান হবার পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কিছু লেখক উপন্যাস লিখেছিলেন সাম্প্রদায়িক ভেদ বুদ্ধি দ্বারা তাড়িত হয়ে। হিন্দুদের মুসলমান বিদ্বেষ, জিন্নাহ’র প্রতি আস্থা ইত্যাদি ছিল এইসব উপন্যাসের মূল বিষয়। অনেকে বঙ্কিমের ধারা অনুসরন করে ইসলামের ইতিহাস থেকে, পুঁথি থেকে চরিত্র নিয়ে ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছিলেন। শৈল্পিক বিচারে অগুরুত্বপূর্ন এইসব উপন্যাস ছিল লেখকদের অতি আবেগের ফল।
বাঙালী মুসলিম পুঁথি লেখকেরা আমির হামযা, কারবালা ইত্যাদি পুঁথি একসময় লিখেছিলেন, যেগুলিতে সম্ভব অসম্ভব সব কাজ করে বেড়াতেন মুসলমান নায়কেরা। যেমন হযরত আলী’র কাল্পনিক পুত্র মুহম্মদ হানিফা, তিনি মহাবীর। যুদ্ধ জয় করে বেড়ান, সামনে যে রাজ্য পড়ে। সেসব রাজ্য আবার সুন্দরী কাফের নারীদের। হানিফা এদের রাজ্য জয় করেন, এদের বিয়ে করেন। বিছানা এবং যুদ্ধ ময়দান দুই জায়গাতেই তিনি মহাযোদ্ধা। সেই সব রাজ্যের রানীদের আবার পন ছিল যে তাদের পরাজিত করতে পারবে তাকেই বিয়ে করবেন তারা, আর ঐ ব্যক্তি পরাজিত হলে তাকে দাস হয়ে থাকতে হবে। হানিফা একসময় বিপদে পড়েন এক রাজ্যে, তিনি আটকা পড়ে যান। তাকে উদ্ধারের জন্য রণ হুংকার ছেড়ে আসেন হযরত আলী।
আহমদ ছফা’র বাঙালী মুসলমানের মন প্রবন্ধে এইসব পুঁথি সাহিত্য নিয়ে আলোচনা আছে। পুঁথি লেখকেরা ছিলেন অশিক্ষিত, তারা যেভাবে পেরেছেন তাদের আবেগকে, কল্পনাকে উপস্থাপন করেছেন। মহভারত রামায়নের মিথের অনুকরণে তারা গল্প তৈরী করেছেন আর চরিত্র এনেছেন ইসলামের ইতিহাস থেকে।
এইসব পুঁথি অনেক অনেক জনপ্রিয় ছিল, মানুষ এদের অনেক গল্প সত্যিও মনে করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব পুঁথি ইসলামী সাহিত্য নয়। ইসলামি সাহিত্য বলে কিছু হয় কি না আমি জানি না।
তবে আমি একটা ধারার কথা বলব, যা পশ্চিমা ভালো ও মন্দ বিচারের বাইরে। এক্ষেত্রে কমলকুমার মজুমদারের অন্তর্জলী যাত্রা উপন্যাসের কথা বলছি। এই ধরনের উপন্যাস হচ্ছে পশ্চিম যেভাবে ভালো মন্দ বিচার করে দিয়েছে, তার বাইরে গিয়ে দেখা। কমলকুমার উপন্যাসটিতে সতীদাহ দেখিয়েছেন। তিনি পশ্চিমারা যেভাবে উপস্থাপন করে তার ভেতরে নিজের দৃষ্টিভঙ্গীকে আটকে রাখেন নি। অন্তর্জলী যাত্রা সাম্প্রদায়িক উপন্যাস নয়, অতি ভাব কল্পনা প্রবন পুঁথি এবং এই ধারার কোন উপন্যাস নয়। উপন্যাসটিতে হিন্দু ধর্মের সতীদাহ বিষয়টি নিয়ে ভিন্ন এক গল্প লেখক তুলে ধরেছেন, তা গুরুত্বপূর্ন। কোন মুসলমান বাঙালী লেখকের এই প্রতিভা, জ্ঞান ও সাহস হয় নি সম্ভবত।
কাসেম যে উপন্যাস লিখেছেন, আমি না পড়লেও যা বুঝেছি, তা এই পুঁথি এবং এই ধারারই উপন্যাসগুলির ভিন্ন রূপ। এগুলিতে তিনি ইসলামের ভেতরে থেকেও পশ্চিমায়ন দেখিয়েছেন। তিনি পশ্চিম বিরোধী এবং গণমানুষের পক্ষে এমন যারা বলেন, তারা চিন্তার দিক থেকে এখনো বাচ্চা আছেন। লাইনে লাইনে পশ্চিম খারাপ পশ্চিম খারাপ বললেই পশ্চিমা জ্ঞান ও নৈতিকতার বাইরে কেউ যেতে পারেন না। এটা দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তনের ব্যাপার। জ্ঞান যে ক্ষমতা ও শোষনের অস্ত্র তা বুঝার সক্ষমতার দরকার। কাসেম প্রেম দেখান, বিসমিল্লা বলে কিস দেখান, হাদিস উল্লেখ করেন। এজন্যই বিদেশী’রা তারে ভালো মনে করে, কারণ তিনি শেষতক তাদেরই দলে। ইন্ডিয়ায় একটা ফিল্ম হয়েছিল, লিপস্টিক আন্ডার মাই বোরখা। ফিল্মটি দেখি নাই, তাই কন্টেন্ট কী জানি না। কিন্তু বাংলাদেশী কাসেম ও অন্যান্য তথাকথিত ‘ইসলামি’ লেখকদের প্রবণতা এই ফিল্মের নাম দিয়ে বুঝানো যায়। এরা বোরখার আন্ডারের লিপস্টিক নিয়ে কাজ করেন। অর্থাৎ, ইসলামি বাতাবরনের নিচে তারা পশ্চিম, তারা সেক্যুলারই। এবং এই পশ্চিম মিশেছে দুইশ বছরের ব্রিটিশ শাসনে, এবং তৎপরবর্তী মনোজগতে উপনিবেশের রাজত্বে। একে বুঝা এবং এর থেকে বের হয়ে আসা সহজ কথা নয়।
সুতরাং কথা হলো, আপনি সেক্যুলার বা ইসলামি যাই হোন না কেন, এইসব অগুরুত্বপূর্ন উপন্যাসদের ভুল বুঝবেন না।