সম্প্রতি হুমায়ূন আহমেদের একটি নাটক দেখি ইউটিউবে। নাটকটির নাম লেখকের মৃত্যু। নাটকের গল্প এমন, একজন লেখক হতাশায় ভুগছেন। তার মনে হচ্ছে তিনি যা লিখেছেন সব বাজে হয়েছে। তাই তিনি ঠিক করলেন আত্মহত্যা করবেন। যেহেতু এটি হুমায়ূন আহমেদের নাটক তাই হুমায়ূনীয় ব্যাপার থাকবে। লেখক সিদ্ধান্ত নিলেন রাত বারোটা দশ মিনিটে তিনি মাথায় গুলি মেরে মরে যাবেন, কারণ সেদিনই ছিল তার জন্মদিন। তিনি কেক আনালেন, কালো পাঞ্জাবী পড়লেন। কেক কেটে বারোটা এক মিনিটে জন্মদিন পালন করবেন একা একাই, এরপর তিনি আত্মহত্যা করবেন।
লেখকের ঘরে আর কেউ নাই, একমাত্র চাকরকেও তিনি ছুটি দিয়ে দিলেন।
সব কিছু ঠিকঠাক, লেখক মরার আগে তার হতাশার কথা রেকর্ড করে যাচ্ছেন একটা রেকর্ডারে। এমন সময় তার ঘরে এসে প্রবেশ করলেন এক যুবতী। তিনি তার নাম বললেন রুমালী। রুমালী অদ্ভুত কর্মকান্ড করে লেখককে বিরক্ত ও বিভ্রান্ত করে তুললেন। অতঃপর হতাশ লেখক তার শেষ পান্ডুলিপিটি রুমালীকে পড়তে দেন।
শেষের দিকে, রুমালী নামের মহিলাটি লেখককে বলেন স্যার আমি আসলে আপনার ভক্ত। আপনার সব বই আমি পড়েছি। আপনার বই স্থলপদ্মে একটি চরিত্র ছিল রুমালী যে মধ্যরাতে আরেকজনের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে তার অদ্ভুত কার্যাবলী দ্বারা সেই লোককে চমকে দেয়। আমার ইচ্ছা ছিল একদিন আপনার জন্মদিনে এসে আপনাকে চমকে দিব। তাই আজ এসেছিলাম। স্যার, আপনারা আমাদের পথ দেখাবেন। আপনারা কেন হতাশ হয়ে আত্মহত্যার কথা ভাববেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
লেখক অবাক হয়ে যান।
রুমালী বলে স্যার আমার ইচ্ছা আপনার পায়ের কাছে বসে ছবি তুলব। আমার স্বামী আসছে। আপনি দয়া করে একটি ভালো পাঞ্জাবী পরে আসুন।
লেখক রুমালীর কথায় বেঁচে থাকার আশা ফিরে পেলেন। তিনি রুমালীকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার প্রিয় রঙ কি। যেহেতু এটা হুমায়ূন আহমেদের নাটক তাই জানা কথাই প্রিয় রঙ হবে নীল, লেখক নীল পাঞ্জাবী পড়ে এলেন। রুমালী লেখকের পায়ের কাছে বসলেন। রুমালী স্বামী এসে ছবি তুললেন। খেলা শেষ।
অর্থাৎ, নাটকের গল্পে লেখক মৃত্যুবরণ করেন নি। অর্থাৎ লেখকের মৃত্যু হয় নি।
কিন্তু আমার কথা, লেখকের মৃত্যু আসলে হয়েছে।
রুমালী’র লেখকের প্রতি “স্যার স্যার” শ্রদ্ধা এবং ভক্ত হিসেবে পায়ের কাছে বসা আসলে লেখকের মৃত্যু ঘটিয়েছে এবং জন্ম নিয়েছে পীর। ঐ লেখক আর লেখক নন, তিনি আবহমান বাঙলার এক পীরে পরিণত হয়েছেন।
বাঙালীদের মধ্যে পীরবাদী প্রবণতা আছে। রাজনীতি, সমাজ ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে এখানকার লোকেরা পীরের ভক্ত হতে পছন্দ করে। সব জায়গাতেই তারা পীর তৈরি করতে চায়।
এক পীর ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাঙালীর ভক্তি তার প্রতি পূজা পর্যায়ে চলে গিয়েছিল এবং এখনো হয়ত আছে। তাকে “কবিগুরু” “বিশ্বকবি” “গুরুদেব” ইত্যাদি নানা ডাকে ডাকা হয়। যদিও কবিগুরু উপাধীটা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের নিকটজন ক্ষিতিমোহন সেন, গুরুদেব দিয়েছেন মহাত্মা গান্ধী, বিশ্বকবি দিয়েছেন বহ্মবান্ধব উপাধ্যায়। এই প্রতিটি উপাধী জনপ্রিয়, এবং লক্ষ করলে দেখবেন এই তিনটা উপাধীই পীরবাদী।
তাকে আরো উপাধী দেয়া হয়েছিল যেমন ‘ভারত ভাস্কর’ দিয়েছিলেন ত্রিপুরার রাজা। চীনা কবি চি-সি লিজন বলেছিলেন ‘ভারতের মহাকবি’। কিন্তু এগুলি অত জনপ্রিয় হয় নি।
লেখকের জন্য এই পীরবাদী ভক্তি পাওয়া খুবই খারাপ। একমুখী সম্মান এবং শ্রদ্ধা ক্ষমতাতন্ত্রের একটি অংশ। তার একটি নগ্ন রূপ হচ্ছে পীরবাদী ভক্তি। রুমালী’র উদাহরনটা বিবেচনা করা যায়, ভক্ত বসে পীরের পায়ের কাছে। অর্থাৎ, আমি আপনার পদের কাছের মানুষ। ক্ষমতাতন্ত্রের নগ্ন প্রকাশ এর চাইতে আর কী হতে পারে!
নাটকের প্রথম থেকে লেখকের সাথে লেখকের চাকরের কথাবার্তা দেখানো হয়। সেখানে চাকর তাকে স্যার স্যার করে কথায় কথায়। লেখকের সাথে লেখকের চাকরের যে সম্পর্ক তাতে ক্ষমতার ভাগ বিভাজন আছে, ক্ষমতা এখানে গুরুত্বপূর্ন হয়ে কাজ করে। লেখকের চাকর লেখককে যে স্যার স্যার করে, সেই স্যার স্যারই ফিরে আসে ভক্তের মাঝে।
লেখক লেখেন এই ধরনের ভক্তি পাওয়ার জন্যে নয়। লেখকের লেখা সমাজের উপকার করতে পারে যখন তা বিশ্লেষন, আলোচনার পথ তৈরী করে, সমাজের বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামো ও অন্যায়কে নির্দেশ করে বা মানব মনের গহীনের মনস্ততাত্ত্বিক দিক উন্মোচন করে। বিশ্লেষন, আলোচনা ইত্যাদি পীর বাদী ভক্তি থেকে হওয়া অনুচিত। লেখক যখন স্বাধীনভাবে লিখেন তা পাঠকের জন্য অস্বস্থিকর হতে পারে, তা সমাজকে আঘাত করতে পারে। লেখক ও পাঠকের যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া তাতে পীর ও ভক্ত তৈরীর অবকাশ নাই।
সম্মান পীরবাদী ভক্ত না হয়েও করা যায়। এটা পারস্পারিক সম্মান বা শ্রদ্ধাবোধ (দ্বিমুখী) হতে পারে, তখন একজন তার পায়ের কাছে অন্যকে বসতে দিবেন না। লেখক তার লেখায় একটা অন্তর্দৃষ্টি দিতে পারেন, এটাকে পাঠক ভালো মনে করতে পারেন, তার উপকারেও লাগতে পারে, তিনি লেখককে পছন্দ করতে পারেন, ভালোও বাসতে পারেন কিন্তু তার যেন নিজেকে অতি তুচ্ছ এবং লেখককে অতি মহান পীর মনে না হয়।
লেখকদের স্যার স্যার বলার যে প্রবণতা আমাদের সমাজে তৈরী হয়েছে, এটি আবহমান বাঙলার পীরবাদের সেক্যুলার ভার্শন। তলস্তয় স্যার, দস্তয়ভস্কি স্যার বলতে দেখবেন না কিন্তু হুমায়ূন স্যার হয়ে উঠেন।
হুমায়ূন আহমেদের এই নাটকটা তার নিজের অবস্থানও স্পষ্ট দেখিয়ে দেয়। তার নাটকের লেখকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন না। কেবলই লেখক ছিলেন। ভক্ত তার পায়ের কাছে বসে ছবি তুলতে গেলেও তিনি বাঁধা দেন নি। বরং খুশি হয়েছেন এবং এটি তাকে বাঁচার প্রেরণা দিয়েছে। ভক্তের ভক্তিই তাকে বাঁচিয়ে দিল। হুমায়ূন আজাদের একটা কথা মনে পড়ে, ভক্ত শব্দের অর্থ খাদ্য। প্রতিটি ভক্ত হচ্ছে গুরুর খাদ্য। আজাদের কথা এই নাটকের লেখকের ক্ষেত্রে মিলে গেল, ভক্তের ভক্তি খেয়েই লেখকের হতাশা এবং আত্মহত্যার ইচ্ছা চলে যায়।
এই ধরনের চিত্র পপুলার মাধ্যমে উঠে এসেছে আরো অনেক, তাই বাঙালীর পীরবাদী চেতনা তীব্র হয়েছে লেখক-পাঠক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। হুট করে পাঠকেরা লেখকদের স্যার স্যার বলা ভক্তে পরিণত হয়ে যান। আর লেখকের মৃত্যু হয়, জন্ম হয় পীরের।