প্রক্রাস্টেস এর বিছানা – নাসিম তালেব

নাসিম তালেব

প্রক্রাস্টেস এর বিছানা

 

গ্রীকপুরাণের চরিত্র প্রোক্রাস্টেস, এথেনস এবং ইলেউসিস এর মাঝামাঝি করিদেলাসের একটা ছোট ভূমির নিষ্ঠুর মালিক। সে একজন অদ্ভুত রকম অতিথি পরায়ণ লোক ছিল। রাস্তা থেকে ভ্রমনকারীদের ধরে নিয়ে যেত, তাদের ভালো খাবার দাবারের ব্যবস্থা করত এবং শোয়ার জন্য দিত তার এক বিশেষ বিছানা। সে চাইত বেড বা বিছানাটি যেন অতিথির জন্য পারফেক্ট বা নিঁখুত হয়। এজন্য অতিথির লম্বা পা দুটো বাইরে বের হয়ে থাকলে ধারালো চাপাতি দিয়ে পা দুটি কেটে বিছানার সাথে মিলিয়ে নিত। আর বিছানা ছোট হলে সে অতিথিকে টেনে লম্বা করে দিত।

তো প্রোক্রাস্টেসকে নিজের ফাঁদেই পড়তে হয়েছিল শেষপর্যন্ত। একজন ভ্রমণকারী ছিলেন থিসিয়াস। তিনি তখন তার বীরত্বপূর্ন কেরিয়ারের শেষে মিনতোরে অবস্থান করছিলেন। প্রথামত রাতের খাবারের পর থিসিয়াস প্রোক্রাস্টেসকে তার নিজের বিছানাতেই শুতে বাধ্য করেন। এবং তাকে বিছানার সাথে ফিট করতে শিরোচ্ছেদ করেন।

কোন কোন ভার্সনে এমন আছে যে প্রোক্রাস্টেসের বিছানা ছিল দুইটা। একটা ছোট এবং আরেকটা বড়। খাটো লোকদের সে শোয়াত বড় বিছানায় এবং লম্বা লোকদের খাটো বিছানায়।

এখানে যেসব এফোরিজম আছে তার সবই একরকম প্রোক্রাস্টেসের বিছানা। দার্শনিক, সংখ্যাতাত্ত্বিক ও সাবেক ট্রেডার নাসিম তালেবের এমনই মত তার এই এফোরিজমগুলি নিয়ে। এগুলি আমি অনুবাদ করেছি বাংলায় ইংরেজি থেকে। এমনিতেই কোন লেখা যে বিভিন্ন অর্থ তৈরী করতে স্বক্ষম, তা দেরিদা’র মারফতে জেনে যেকোন ধরনের লেখাকে এখন সতর্কতার সাথে দেখতে হচ্ছে, তথাপি এই ক্ষেত্রে অনুবাদের কাজটি হয়ে উঠেছে আরো কঠিন।

সেই কঠিনতাকে সাথে নিয়েই অনুবাদ করেছি, এবং মূল অর্থ আছে কোথায় এবং তা কী তা নিয়ে সন্দেহ দূর হয় নি। পাঠ, পুনঃপাঠ এবং ভিন্নপাঠ আমাদের কোন লেখার ভিন্ন ভিন্ন অর্থের মুখে দাড় করাতে পারে, সেসব মাথায় রেখেই আপনি এফোরিজমগুলি পড়বেন, আশা করি।

বইয়ে বিভিন্ন বিভাগে এফোরিজম ভাগ ভাগ করে দেয়া আছে। আমি বিভাগগুলির সব এফোরিজম নেই নি, বাছাই করেছি বা যেটা ইচ্ছে হয়েছে নিয়েছি। ফলে নতুন পাঠের বাইরেও, সেই এফোরিজমগুলি পড়ার জন্য আপনি মূল ইংরাজি বইটাও দেখতে পারেন।

এটি লেখার প্রথম পর্ব। আরো কয়েকটি পর্বে পুরো’টা বা অধিকাংশ বই বঙ্গানুবাদ ও প্রকাশের ইচ্ছা রাখছি।

 

 

 

প্রস্তাবনা

আপনি নিজের বিরুদ্ধাচরন করতেই সবচেয়ে বেশী ভয় পান।

একজন বোকা’কে দেউলিয়া করতে হলে তাকে তথ্য দিন।

 

জ্ঞানের কাছে একাডেমিয়া হচ্ছে পতিতাবৃত্তির কাছে ভালোবাসার মত। প্রায় কাছাকাছি কিন্তু গর্দভ না এমন মানুষের কাছে তা কখনোই এক জিনিস নয়।

শিক্ষা জ্ঞানীকে আর একটু জ্ঞানী করে তোলে আর বোকাকে করে তোলে বেশী বিপদজনক।

 

একজন পন্ডিত হচ্ছেন সে ব্যক্তি যিনি যত জানেন তার চেয়ে কম প্রদর্শন করেন। সাংবাদিক বা পরামর্শক এর বিপরীত।

সময়ের সাথে আপনার রাগ কমে গেলে, আপনি অন্যায় করেছিলেন। সময়ের সাথে যদি বাড়তে থাকে, তাহলে আপনি অন্যায়ের শিকার হয়েছিলেন।

খালি দীর্ঘজীবন, আরাম আয়েশ আর নিরাপত্তার হিসাবে যদি উন্নয়নের কথা বলেন তাহলে  চিড়িয়াখানার বন্দী প্রাণী আর বনের মুক্ত প্রাণীর মধ্যে তুলনা করতে ভুলবেন না।

কেউ পুরোপুরি স্বচ্ছ হতে চায় না অন্যের কাছে এবং নিজের কাছে তো নয়ই।

 

 

প্রতি বর্ননা

 

একজন মিথ্যাবাদীর উপর প্রকৃত প্রতিশোধ হচ্ছে তাকে বুঝানো আপনি তাকে বিশ্বাস করেছেন।

আমরা যখন কোন কিছু করতে যাই এবং অবচেতনে নিশ্চিত থাকি ব্যর্থ হতে যাচ্ছি তখন অন্যের উপদেশ খুজি যাতে ব্যর্থ হলে তাকে দোষ দেয়া যায়।

আপনার খ্যাতি রক্ষার জন্য আপনি যা বলেন তাতে আপনার খ্যাতি সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

তারা আপনার সফলতা, সম্পদ, বুদ্ধি, চেহারা, অবস্থানের জন্য হিংসা করবে, কিন্তু আপনার প্রজ্ঞার জন্য কদাচিত।

যতক্ষণ না পর্যন্ত তারা ব্যক্তি আক্রমণে না যাচ্ছে ততক্ষণ আপনি তর্কে জেতেন নি।

ভালোবাসার চাইতে ঘৃনা নকল করা কঠিন। আপনি নকল ভালোবাসার কথা শুনে থাকবেন, কখনো নকল ঘৃনার কথা শুনবেন না।

ঘৃনা হচ্ছে কম্পিউটার কোডে টাইপো যুক্ত এক ধরনের ভালোবাসা, যা ঠিক করা সম্ভব কিন্তু খুঁজে পাওয়াটাই কঠিন।

পুরুষত্বের বিপরীত কাপুরুষতা নয়, প্রযুক্তি।

যে বন্ধুত্ব শেষ হয়ে যায় ওটা কখনো বন্ধুত্ব ছিল না। অন্তত একজন “সাকার” ছিল তাতে।

যুবকের প্রজ্ঞা বৃদ্ধের মুর্খতার মত অনাকর্ষনীয়।

 

 

অন্তোলজিক্যাল বিষয়

 

বিজ্ঞানের কাছে জীবন এবং জীবনের মৌলিক বিষয়াবলীর ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া, একজন ব্যকরনবিদের কাছে কবিতার ব্যাখ্যা জানতে চাওয়ার মত। .

 

আপনার অস্তিত্ব আছে, যদি কোন দৃশ্যত উদ্দেশ্য ছাড়াই আপনি কিছু করতে পারেন, কোন বাছবিচার ছাড়াই, এবং মূলত অন্যের কোন ধরনের বর্ননার নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে।

 

সুযোগ, সফলতা, হ্যাপিনেস এবং স্টোয়িসিজম

 

সফলতার বিপরীত অসফলতা নয়, নেইম ড্রপিং।*

**নেইম ড্রপিং হচ্ছে আপনার সাথে কোন কোন বিখ্যাত লোকের পরিচয় আছে তা বলে বেড়ানো। বিখ্যাত লোকের সাথে ছবি তুলে ফেইসবুকে তা নিয়মিত পোস্ট করে বেড়ানোও এক প্রকার নেইম ড্রপিং যার নাম আমার মতে ফেইস ড্রপিং। কোন মানুষ কত অসফল বোধ করে তা তার নেইম ড্রপিং এবং ফেইস ড্রপিং থেকে বুঝা যায়।

 

শুধুমাত্র একজন দাস হওয়া এড়াতে পারলেই আপনি পুরোপুরি স্বাধীন হয়ে যান না, আপনাকে প্রভূ হওয়াও এড়াতে হবে এজন্য।

ভাগ্য লোভীকে গরীব বানিয়ে শাস্তি দেয় আর বেশী লোভিকে শাস্তি দেয় ধনী বানিয়ে।

গর্দভেরা যাকে বলে “সময় নষ্ট” তাই প্রায় সময় সেরা ইনভেস্টমেন্ট।

দ্রুততম সময়ে ধনী হবার উপায় গরীবদের সাথে মেশা আর দ্রুততম সময়ে গরীব হবার উপায় ধনীদের সাথে মেশা।

সেইদিনই আপনি সভ্য হবেন যেদিন  দীর্ঘ সময় কোন কিছু না করে, কিছু না শিখে, কোন উন্নতি না করে পুরো দিন কাটিয়ে দিতে পারবেন সামান্যতম অপরাধবোধ ছাড়া।

রোমান এবং অটোমান দাস  আর এখনকার চাকরীজীবিদের মধ্যে পার্থক্য হলো রোমান দাসদের বসকে তেল দিতে হত না।

কার্ল মার্ক্স, একজন ভিশনারী, যিনি বুঝতে পেরেছিলেন আপনি দাসকে আরো ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন যদি তাকে বুঝাতে পারেন সে একজন চাকরীজীবি।*

*এমপ্লয়ী অর্থে।

 

একজন মানুষ কতটুকু অনাকর্ষনীয় তা আপনি বুঝতে পারবেন তাকে জিজ্ঞেস করে কাকে তার আকর্ষনীয় মনে হয়।

মনযোগের জন্য ক্ষুধার্ত ব্যক্তির কাছে ওয়েব হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর।

মানুষেরা রোল মডেলের দিকে লক্ষ্য দেয়, কিন্তু তারা যদি এন্টিমডেল খুঁজে নিত তাহলে তা বেশী কার্যকরী হতো। এন্টিমডেল হচ্ছে এমন লোক বড় হয়ে আপনি যাদের মত হতে চান না।

সব সময় ক্ষমা চাওয়া একটি ভালো অভ্যাস, যদি না আসলেই আপনি বড় ভুল কিছু করে থাকেন।

আপনার প্রতি কৃত অন্যায় অবিচার নিয়ে বেশী জোরে চেঁচাবেন না, তাতে হয়ত আপনার অল্প বুদ্ধি শত্রুদের আপনি ক্ষতি করার উপায় শিখিয়ে দেবেন।

যারা চাকরীকে পদ্বতিগত দাসত্ব মনে করে না তারা হয় অন্ধ না হয় চাকরিজীবি।

 

জন্মের পর তাদের বাক্সে রাখা হয়, তারা বাড়িতে বাস করতে যায় বাক্সে, তারা পড়ালেখা করে বাক্সে বাক্সে টিক চিহ্ন দিয়ে, তারা যাকে বলে “কাজ” তা করতে বাক্সে করে যায়, সেখানে তারা তাদের কিউবিকল বাক্সে বসে, তারা বাক্সে চড়ে মুদি দোকানে যায় খাবার কিনতে বাক্সে করে, তারা জিমে যায় বাক্সে, একটা বাক্সে বসার জন্য; তারা বলে “বাক্সের বাইরে” চিন্তা করার কথা; এবং তারা যখন মারা যায় যখন তাদের বাক্সে রাখা হয়। সবকটাই বাক্স, ইউক্লিডিয়ান, জ্যামিতিকভাবে নিখুঁত বাক্স।

 

 

চার্মিং এন্ড লেস চার্মিং সাকার প্রবলেমস

 

গুজব যখন প্রত্যাখ্যাত হয় তখনই কেবল তা মূল্যবান।

দুই ধরনের লোক আছেঃ যারা তর্কে জিততে চায় ও যারা জিততে চায়। এরা কখনোই এক না।

মানুষ সাধারনত ক্ষমা চায় যাতে কাজটি তারা আবার করতে পারে।

যারা অন্যদের ব্যবহার করে তারাই কারো দ্বারা ব্যবহৃত হলে বেশী দুঃখিত হয়ে পড়ে।

কেউ যদি তাকে কেন চাকরিতে নেয়া হবে এজন্য একের চাইতে বেশী কারণ দেখায়, তাকে চাকরিতে নেবেন না।