ফকির তালুকদার ও তাহার কিছু বিভ্রান্তি
প্রারম্ভিকঃ
তর্ক আমাদের জন্য একটি স্বাভাবিক ঘটনা। প্রায় প্রতিদিনই আমরা এর সম্মুখীন হই। ফলে এর সম্পর্কে অল্প বিস্তর জানা থাকা দরকার। তর্ক সব সময় এমন সরাসরি কথায় হয় না যে একজন একটি যুক্তি দিচ্ছেন, অন্যজন উত্তেজিত হয়ে তার পালটা যুক্তি দিচ্ছেন। অনেক সময় কোন ব্যক্তি তার ফেইসবুক পোস্টে কোন বিষয় নিয়ে তার মত উপস্থাপন করেন। সেই মতের ভিত্তি হিসেবে থাকে এক বা একাধিক যুক্তি। অনেকে এর বিরোধীতা করে পালটা মত দেন বা তার মত খন্ডন করেন। সেখানেও থাকে কিছু যুক্তি। অথবা কেউ যদি মনে করেন তিনি ফেইসবুক মন্তব্যে যাবেন না, তাহলে তার নিজের মনেই তিনি ঐ ফেইসবুক পোস্টের বিরুদ্ধে পালটা মত বা যুক্তি তৈরী করে বসে থাকেন।
এইসব যুক্তির অনেকগুলাই ফ্যালাসি মানে বিভ্রান্তি। বিভ্রান্তিকর ভাবে তা যৌক্তিক বলে মনে হয় কিন্তু আসলে তা অযৌক্তিক। যুক্তির এই বিভ্রান্তিগুলি মাথায় থাকলে যে কেউ এগুলি দ্বারা বিচার করার মাধ্যমে কোন যুক্তি বা বক্তব্যের যৌক্তিকতা পরীক্ষা করে নিতে পারবেন।
এবং নিজে বিভ্রান্তিকর চিন্তায় বিভ্রান্ত হবেন না। অন্যের বিভ্রান্তিকর চিন্তাও তাকে প্রভাবিত করতে পারবে না।
এগুলি জানা সবচেয়ে বেশী দরকার যাতে ফ্যালাসির মাধ্যমে নিজে বিভ্রান্তিতে না পড়েন, এজন্য।
বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান বলেছিলেন স্মরণ রাখার মত একটি কথা, প্রথম নীতি হচ্ছে আপনি নিজেকে বোকা বানাবেন না। আপনি সবচেয়ে সহজে আপনাকেই বোকা বানাতে পারেন।
এই মূলনীতিটা মনে রেখে মানুষের তর্কের বিভ্রান্তিগুলি দেখা যাক, যাতে এর বিভ্রান্তিময় ফাঁদ থেকে বাঁচা যায়।
ফকির তালুকদার কে?
ফকির তালুকদার একজন সাহিত্যিক এবং ধূর্ত লোক। তিনি বিভিন্ন ভাবে লোকদের বিভ্রান্ত করেন এবং নিজেও বিভ্রান্ত হন। নানা সময়ে এ নিয়ে তিনি ঝামেলায়ও পড়েছেন। আবার এসব করে তার লাভও হয়েছে প্রচুর। নগদ অর্থের সাথে এসেছে রাজনৈতিক ক্ষমতা। আমরা আর্গুমেন্ট তথা তর্কের বিভ্রান্তিগুলি বুঝতে বুঝতে ফকির তালুকদারের গল্পটিও পড়ে যাব। ফকির তালুকদারের বক্তব্য বিশ্লেষণ করেই আমরা বিভ্রান্তিগুলিকে আরো ভালোভাবে বুঝতে পারব, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
১। আর্গুমেন্ট ফ্রম কনসিকুয়েন্সেস
বলা হল, নারীদের স্বাধীনতা দেয়া উচিত।
এর বিপরীতে ফকির তালুকদার যুক্তি দিলেন, যদি নারীদের স্বাধীনতা দেয়া হয় তাহলে ডিভোর্সের সংখ্যা বেড়ে যাবে, শিশুদের জীবনে নেমে আসবে দূর্যোগ। আমাদের সমাজে নেমে আসবে নৈরাজ্য।
এই যুক্তি আর্গুমেন্ট ফ্রম কনসিকুয়েন্সেস। এখানে ফল কী হবে তা আলোচনায় নিয়ে এসে মূল সত্য বা অবস্থান থেকে সরে যাওয়া হচ্ছে। ফল ভবিষ্যতের, তা হতেও পারে নাও হতে পারে। এর হওয়া কিংবা না হওয়ার সাথে উপস্থাপিত যুক্তি বা সত্যের কোন সম্পর্ক নেই।
এই ধরনের বিভ্রান্তি বা ফ্যালসির মাধ্যমে দর্শকদের ভয় বা আশা’র জায়গায় স্পর্শ করে তাদের বিভ্রান্ত করা হয়।
আরেকটি উদাহরণ সাহিত্যিক ফকির তালুকদারের বক্তব্য থেকে “তরুণেরা যেভাবে অপ্রমিত ভাষায় লিখছে তাতে বিশৃঙ্খলা চলে আসবে। বাংলা ভাষা বলে কিছু থাকবে না।”
ফকির সাহেব অপ্রমিত ভাষার (তথা প্রকৃত বাংলা) বিরোধীতা করতে গিয়ে এই উক্তি করলেন। তিনি চান প্রমিত তথা তথাকথিত মান ভাষা দিয়ে ভাষা শাসন। কিন্তু তিনি বাংলা ভাষার ইতিহাস, অন্যান্য ভাষার ইতিহাস এবং ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেকেও ভাষাকে দেখতে যান নি। তিনি সরাসরি ভয় দেখিয়েছেন ভবিষ্যতে কী হবে তা উল্লেখ করে।
বি দ্রঃ এখন প্রশ্ন হতে পারে, ফকির সাহেব কী জ্যোতিষি? না। তো ফকির সাহেবের সাথে আপনি তর্ক করবেন কীভাবে? আপনি তাকে শহীদুল জহিরের উক্তি শোনাতে পারেন, “বাংলা ভাষার এই নদী কোন ঘাট থেকে কোন ঘাটে এসেছে, তা আমাদেরও জানা আছে। ” আপনি তাকে জানাতে পারেন সেই প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার ট্যাবলেটে পর্যন্ত ভাষা ফ্যাসিবাদী ফকির সাহেবেরা বলত তরুণেরা ভাষা নষ্ট করে ফেলবে, ইত্যাদি।
২। স্ট্র ম্যান
কারো দেয়া যুক্তিকে হাস্যকর ভাবে উপস্থাপন করা যাতে পরবর্তীতে তা নিয়ে হাসাহাসি করা যায়। এক্ষেত্রে মূল যুক্তির বাইরে হাসাহাসি বা মকিং করা হয় এবং এর মাধ্যমে তার যুক্তির অসত্যতা প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়।
স্ট্র ম্যান ফ্যালাসির উদাহরনঃ
সাহিত্যিক ফকির তালুকদার বললেন, “জনাব কামাল বলছেন তিনি ডারউইনের বিবর্তনবাদ মানেন। অতএব, তার পূর্বপুরুষেরা বান্দর ছিল এবং গাছে গাছে ঝুলে কলা খেত। এটা খুবই হাস্যকর, কারন আমরা জানি যে তার পূর্বপুরুষেরা বান্দর ছিলেন না।”
বিবর্তনবাদ অনুযায়ী শিম্পাঞ্জি এবং মানুষের কমন এন্সেস্টর বা পূর্বপুরুষ ছিল। তাও মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পূর্বে। তার অর্থ এই নয় যে বান্দর থেকে মানুষ এসেছে। এখানে বিবর্তনবাদের যুক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বান্দরের প্রসঙ্গ আনা হয়েছে, ভুল উপস্থাপনের জন্য। যাতে কামাল সাহেবকে নিয়ে ফান করে তার অবস্থান উড়িয়ে দেয়া যায় হেসে। স্ট্র ম্যান ফ্যালাসি আরো নানা ক্ষেত্রে নিত্য ব্যবহার হয়, লক্ষ করলেই দেখতে পাবেন।
৩। আপিল টু ইররেলেভ্যান্ট অথরিটি
কোন যুক্তির পক্ষে সে বিষয়ের সাথে সম্পর্কহীন বিশেষজ্ঞের মতকে এর সমর্থনে ব্যবহার করা। এছাড়া আরেকটা কমন ব্যবহার হল, “গবেষনায় দেখা গেছে”। গবেষনায় দেখা গেছে বলে বানোয়াট কথাও কেউ বলতে পারে। এভাবে কেউ বললে দেখতে হবে ঐ গবেষকেরা আসলেই ঐ বিষয়ের বিশেষজ্ঞ কি না। অথবা আদৌ গবেষণা হয়েছে কি না।
একবার সাহিত্যিক ফকির সাহেব হেটে যাচ্ছেন এক সাহিত্য সম্মেলনে। ওখানে তাকে সভাপতি হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাই তিনি খুশিতে ডগমগ। রাস্তায় এক ভক্তের সাথে তার দেখা। ভক্ত তখন তাকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি তো অনেকদিন সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতি হওয়ার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তাছাড়া আপনি নিজে বামপন্থী ভাবাদর্শের। তাহলে পুঁজিবাদী একটি সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতি হতে যাচ্ছেন কেন, ফকির ভাই?”
ফকির তালুকদার বিরক্ত হলেন। তিনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, “দেখো, আমি এই লাইনে চল্লিশ বছর ধরে আছি। কত বড় বড় সাহিত্যিককে দেখেছি। আমি তাদের সাথে বসেছি, শুয়েছি, চা খেয়েছি। তুমি সেদিনেরর ছেলে, কী বুঝবে এসবের। যাও যাও, খেলো গিয়ে!”
এখানে ভক্তের যুক্তির বা প্রশ্নের বিপরীতে ফকির সাহেব বড় বড় সাহিত্যিকের অথরিটি হাজির করেছেন। তাদের সাথে তার উঠাবসার কথা জানিয়েছেন। কিন্তু কীভাবে উনাদের সাথে তার উঠাবসা এই কাজ সমর্থন করার যুক্তি দেয়, তা তিনি বুঝান নি। তিনি অপ্রাসঙ্গিক অথরিটির দোহাই দিয়ে তার ভক্তের যুক্তিকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন।
৪। ইকুইভোকেশন
শব্দের অর্থ পরিবর্তন করে ভ্রান্ত সমাধানে পৌছানো।
উদাহরনঃ ফকির তালুকদার বাম রাজনীতির একজন ধারক ও বাহক হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতেন। সাহিত্যিক জনপ্রিয়তা পাবার পর হঠাৎ তিনি রাজনীতির পথ বদলালেন সংসদ ইলেকশনে নমিনেশন পাওয়ার জন্য। নিজের স্বার্থে বিপরীত আদর্শের এক দলের সাথে তিনি হাত মেলালেন। এটা তার ভক্তরা পছন্দ করলেন না। তখন একদিন ভাষনে ফকির সাহেব ভক্তদের উদ্দেশ্যে বললেনঃ
“রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নাই। কীভাবে থাকবে, পৃথিবীতে কোন কিছু কি নিশ্চিত? এই যে মানুষে মানুষে সম্পর্ক, আজ একরকম কাল একরকম বা বদলে যায়। এসবে কোন শেষ কথা আছে কি?”
এখানে রাজনৈতিক আদর্শের সাথে মানুষের নিত্য সামাজিক সম্পর্ক দুই জিনিসকে এক করে দেখাচ্ছেন ফকির সাহেব, কিন্তু দুইটা এক জিনিস নয়। শব্দের অর্থ কারসাজি করে তিনি বিভ্রান্তি তৈরী করছেন।
৫। ফলস ডিলেমা
ফলস ডিলেমায় দুইটা পক্ষ তৈরী করা হয়। এবং বলা হয় আপনি যদি এক পক্ষে না থাকেন, তাহলে আপনি অন্য পক্ষে অবস্থান করেন।
উদাহরনঃ
সাহিত্যিক ফকির তালুকদার পল্টিবাজি করে দল বদলে সংসদ নির্বাচনে নমিনেশন পেয়ে গেছেন তার পূর্বের আদর্শের সম্পূর্ন বিপরীত আদর্শযুক্ত একটি দল থেকে। এতে তার বন্ধু ও পূর্বের কমরেড করিম সাহেব তীব্র সমালোচনা করলেন। ফকির সাহেব এতে ক্ষেপে গেলেন। তিনি তার ভাষনে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বললেন, “ করিম সাহেব একটা দুর্নীতিবাজ। দুর্নীতিবাজ করিম সাহেবের বিপক্ষে আমার এই অনন্ত যুদ্ধে আপনি হয় আমাদের পক্ষে, অথবা দুর্নীতির পক্ষে। এখানে অন্য কোন পক্ষ নাই।”
এখানে চালাক ফকির সাহেব একটি ফলস ডিলেমা উপস্থাপন করে লোকদের বিভ্রান্ত করছেন। আসলে এখানে আরো পক্ষ থাকে। যেমন,
পক্ষ তিন- কেউ কোন পক্ষ না। তারা জানে না করিম সাহেব আসলে দুর্নীতিবাজ কি না।
পক্ষ চার – কেউ দুই পক্ষের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ, এরা করিম সাহেবকে পছন্দ করে না তার দুর্নীতির জন্য এবং ফকির সাহেবকেও পছন্দ করে না তার স্বার্থান্বেষী চাতুরী ও দুর্নীতির জন্য।
পক্ষ পাঁচ – কেউ দুই পক্ষেরই কিছু কিছু নিতে পারে। অর্থাৎ, এরা ফকির সাহেবকে একটু পছন্দ করে কারন ফকির সাহেব ভালো উপন্যাস লেখেন। আবার করিম সাহেবকে পছন্দ করেন কারন করিম সাহেব ভালো কবিতা লেখেন।
নিরপেক্ষতা বিষয়ে নোটঃ
তবে এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার আছে। দান্তে’র একটি কথা, মোরাল ক্রাইসিসের সময় যারা নিরপেক্ষ থাকে তাদের জন্য রয়েছে সবচেয়ে গভীর নরক। এই রূপক কথায় বুঝানো হচ্ছে এরা সবচেয়ে ঘৃণিত। কারন অধিকাংশক্ষেত্রে নিরপেক্ষরা সুবিধাবাদী হয়ে থাকে। দুই পক্ষের সুবিধা নিয়ে যারা নিরপেক্ষ বা এই উদ্দেশ্যে নিরপেক্ষ থাকে এরা সবচেয়ে খারাপ। কারণ তার কোন নৈতিক অবস্থানই নাই। সে ভয়ানক স্বার্থপর।
কিন্তু এই ধরনের নিরপেক্ষ বা সুবিধাবাদীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়েও ফলস ডিলেমা তৈরী করা যাবে না। অন্য যেসব পক্ষ হবার সম্ভাবনা আছে, সেগুলিও মাথায় রাখতে হবে।
৬। নট এ কজ ফর এ কজ
কোন একটি ঘটনার কারণ হিসেবে এমন একটি বিষয়কে ধরে নেয়া যার নিজেরই অস্তিত্ব নাই।
যেমনঃ
ফকির তালুকদার একবার মাতাল হয়ে বলছিলেন,
“সূর্য উঠে প্রতিদিন কারণ সকালে ঘুম থেকে উঠে জিউস অলিম্পাসের চূড়া থেকে বর্জ্রদন্ড দিয়ে আকাশে আঘাত করেন।”
এখানে সূর্য উঠার কারণ হিসেবে জিউসকে আনা হয়েছে। কিন্তু জিউস নিজেই তো কাল্পনিক।
কোন দুটি অসম্পর্কিত ঘটনা একটার পরে আরেকটি ঘটার ফলে একটার কারণ হিসেবে অন্যটাকে সাব্যস্ত করা।
উদাহরণঃ
ফকির সাহেব তখন পুঁজিবাদী ক্ষমতাসীন দলটির চাটুকার। তিনি ওদের নেতা নেত্রীদের নিয়মিত গুণগান করে গল্প কবিতা লিখতে শুরু করলেন। ফলস্বরূপ কিছু পুরস্কারও তার ভাগ্যে জুটল। এসময় ক্ষমতাসীন দলটির প্রতি জনমনে বিরূপ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। হঠাৎ একদিন মৃদু ভূ কম্পন অনুভূত হল। প্রাকৃতিক নিয়মে এটা হতেই পারে। কিন্তু ফকির তালুকদার বিবৃতি দিয়ে বসলেন, “আমরা সরকারের অহেতুক বিরোধীতা করেছি, তাই ভূমিকম্প হয়েছে।”
৭। আপিল টু ফিয়ার
যুক্তির স্বপক্ষে শ্রোতাদের মনে ভয় জাগিয়ে যুক্তিকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করানো।
যেমনঃ
ফকির সাহেবের রাজনৈতিক বয়ানঃ
“আমাকে ভোট দিন। সানোয়ার সাহেবকে ভোট দিলে তিনি দেশ ইন্ডিয়ার কাছে বিক্রি করে দেবে।”
ফকির সাহেবের সাহিত্যিক বয়ানঃ
“নতুন যারা লিখছে এদের বর্জন করুন। এরা কিছু করতে পারবে না। কোথাও ওদের নাম উচ্চারিত হতে দেখেছেন? এরা বিশৃঙ্খলা ডেকে আনবে। আমার লেখা পড়ুন, ওদের পড়বেন না।”
উপরোক্ত দুটি ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, বক্তা ফকির সাহেব শ্রোতাদের মনে ভয় উসকে দিয়ে তার উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাচ্ছেন। তিনি যে ক্লেইম করেছেন এর পক্ষে কোন প্রমাণ দেন নি। প্রথম বক্তব্যে ফকির সাহেবের উচিত ছিল কীভাবে সানোয়ার সাহেব দেশ ইন্ডিয়ার কাছে বিক্রি করে দেবেন তা তার শ্রোতাদের প্রমানসহ বুঝানো। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তার উচিত ছিল নতুন লেখকদের লেখা কেন লোকে পড়বে না তা নতুনদের লেখার মেরিট দিয়ে বিচার করা বা ক্রিটিকদের হাতেই তা ছেড়ে দেয়া। এখানে লেখকটি বলেছেন, ওরা কিছু করতে পারবে না। এটি ভবিষ্যত নির্দেশ করে। ভবিষ্যতে কী হবে তা লেখকটি নিশ্চিত জানেন না। এখানে তিনি আর্গুমেন্ট অব কনসিকুয়েন্সেস, অর্থাৎ ফল হবে মারাত্মক এই ভয় দেখিয়ে শ্রোতাদের কাছে তার মত প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। আবার তিনি বলেছেন ওদের নাম কোথাও উচ্চারিত হতে দেখেছেন? এই কথাটি হাস্যকর। কারণ ফকির সাহিত্য করছেন প্রায় ত্রিশ বছরেরও অধিক, আর তরুণেরা সবে শুরু করল। পাঁচ দশ বছর। এর মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় নাম উচ্চারণের আশা করা যায় না। সাহিত্য এবং চিন্তামূলক কাজের প্রকৃত বিচারক সময়। এবং এই ধরনের কাজে ভালো প্রতিভাবানরাও অনেক সময় ইতিহাসে স্থান পান না, হারিয়ে যান। কিন্তু ফকির সাহেব এসব বিবেচনায় নেন নি। তিনি আপেক্ষিক এইসব বিভ্রান্তি তৈরী করে নিজের আখের গুছাতেই ব্যস্ত।
৮। হ্যাস্টি জেনারালাইজেশন
খুবই অল্প কিছু মত নিয়ে একটা সিদ্ধান্তে পৌছানো। বা খুব অপ্রাসঙ্গিকভাবে কোন ব্যাপারকে জেনারালাইজ (সরলীকরণ) করে ফেলা।
যেমনঃ
একবার ফকির তালুকদারের শখ হল তিনি হবেন ভূমিকম্প বিশারদ। তিনি তার ফেইসবুকে লিখলেন, আমাদের দেশে কোন ভূমিকম্পবিদ নেই। সবাই বাজে কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তাই আমি আজ থেকে গবেষণায় নামলাম। এবার এসপার নয় ওসপার। দ্রুতই আমি আপনাদের সামনে হাজির করব ভূমিকম্পের প্রকৃত কারণ।
ফকিরের স্ট্যাটাসের লাখে লাখে লাইক পড়ল। শয়ে শয়ে শেয়ার।
ফকির কাজে লেগে গেলেন। তিনি রাস্তায় দশজন লোককে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কেন দেশে ভূমিকম্প বেশী হচ্ছে। তাদের উত্তরের মাধ্যমে তিনি সিদ্ধান্তে আসলেন সারা দেশের মানুষ মনে করেন ইন্ডিয়া সীমান্ত পিলার তুলে নিয়েছে এজন্য ভূমিকম্প হচ্ছে।
ফকির সাহেবের এই সিদ্ধান্তে আসা হ্যাস্টি জেনারালাইজেশন।
ভূমিকম্প নিয়ে গবেষনার পর ফকির তালুকদার সাহিত্য নিয়ে তার বক্তৃতা ঝাড়লেন।
তিনি বললেন, “এসব আমি দেখেছি। চল্লিশ বছর ধরে বাংলা সাহিত্য দেখছি। এখানে বিভিন্ন সময়ে যারা বলেছেন সাহিত্যের পরিবর্তন করে ফেলবেন তারা কিছুই করতে পারেন নি। হুম…তাই এখনও যদি কেউ বলে এসব তাহলে তা ভুয়া।”
উপরোক্ত বক্তব্যে তিনি যা বলেছেন, তাও হ্যাস্টি জেনারালাইজেশনের ফ্যালাসি। তিনি যে জেনারালাইজেশন করেছেন সেগুলিতে সময়ের পার্থক্য বিরাজমান। এগুলির মধ্যে মিল নেই। মানুষের পার্থক্য, সমাজের পার্থক্য, প্রযুক্তিগত পার্থক্য বিদ্যমান।
দ্বিতীয়ত তিনি সর্বৈব মিথ্যা কথা বলেছেন। বাংলা সাহিত্যে যারা পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন, তারা তাদের অনেকেই প্রভাব ফেলে গেছেন। এবং শিল্পের ইতিহাসে ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে এমন। শিল্পের ইতিহাস মানে পরিবর্তনের ইতিহাস, বিভিন্ন শিল্প আন্দোলন, ঘোষনা দিয়ে পরিবর্তন।
লেখক ফকির এসব সত্য থেকে দূরে গিয়ে তার আপন বিভ্রান্তিতে মশগুল অথবা তার পাঠক বা শ্রোতাদের বিভ্রান্ত করছেন নিজ গুঢ় কোন স্বার্থে।
৯। আপিল টু ইগনোরেন্স
কোন কিছু জানা নেই, এবং এই জানা না থাকাকে ভিত্তি করে কোন যুক্তিকে ঠিক মনে করে।
উদাহরণঃ
একটি বাড়িতে রাতে গুড় গুড় শব্দ হয়। কীসের শব্দ হয় কেউ জানে না। এ বিষয়ে জানতে পেরে রহস্য সমাধানে এগিয়ে এলেন ফকির সাহেব। তিনি নিজেকে তখন মনে করতেন দেশ সেরা অতিপ্রাকৃতিক বিষয় বিশেষজ্ঞ। ভুতুরে বাড়িটি কয়েকদিন পর্যবেক্ষণ করে তিনি তার মত জানালেন, “যেহেতু জানা যাচ্ছে না কীসে শব্দ করছে, অতএব নিশ্চয়ই ওখানে ভূত আছে।”
১০। নো ট্রু স্কটম্যান
এই ফ্যালাসিতে একজন লোক কোন একটি গ্রুপ নিয়ে সাধারণ একটা ক্লেইম করেন। উত্তরে তাকে তার যুক্তির বিপরীতে কিছু প্রমাণ দেখানো হয়। তিনি তখন তার পূর্ব অবস্থান বদলানোর পরিবর্তে তার গ্রুপটাকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করে ফেলেন।
উদাহরনের মাধ্যমে ভালো বুঝা যাবেঃ
বাংলাদেশী সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ ফকির তালুকদার সাহেব একদিন পত্রিকা খুলে দেখলেন, ভারতে একটি রেইপ হয়েছে।
তিনি বলে উঠলেন, কোন বাংলাদেশী এই কাজ করবে না।
পরদিন ফকির সাহেব পত্রিকায় দেখতে পেলেন বাংলাদেশে দুইটি রেপ হয়েছে।
তিনি তখন বললেন, কোন সত্যিকার বাংলাদেশী এই কাজ করতে পারে না।
আরেকটি উদাহরণ-
ফকির সাহেব একবার চা খেতে খেতে বললেন, একজন শিল্প প্রেমী ও পড়ুয়া ব্যক্তি কখনো খুনি হতে পারে না।
তাকে বলা হল, হিটলার শিল্প প্রেমী ছিলেন। হাসান সাব্বাহ পড়ুয়া ছিলেন। শিল্প প্রেম এবং পড়া এই নিশ্চয়তা দেয় না তিনি খুনি হবেন না।
ফকির সাহেব তখন চায়ের কাপ নামিয়ে বললেন, একজন সত্যিকার শিল্প প্রেমী ও পড়ুয়া কখনো খুনি হতে পারে না।
১১। জেনেটিক ফ্যালাসি
কোন যুক্তিকে তার উৎপত্তির উপর ভিত্তি করে বিচার করা এবং তাকে ভুল বা ঠিক সাব্যস্ত করা।
যেমনঃ
উদাহরণ এক –
ফকির সাহেবের প্রতিপক্ষ ইন্ডিয়ান আর্মির কাশ্মীরে আগ্রাসন নিয়ে বিরোধীতা করে লিখেছিলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় ফকির সাহেব বললেন, জামিল সাহেব কাশ্মীরে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরোধীতা করছেন, কারণ তিনি পাকিস্তানি।
এখানে ফকির সাহেব ব্যক্তির যুক্তি আলোচনাতেই নেন, উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি পাকিস্তানি বলে। কিন্তু এভাবে তার অবস্থান উড়িয়ে দেয়া যায় না। তার যুক্তিকে খন্ডন করতে হবে।
উদাহরণ দুই –
একবার দেখা গেল মাথায় টুপি পরে এসেছেন ফকির সাহেবের কবি বন্ধু আশরাফ সাহেব। এর প্রতিক্রিয়ায় ফকির সাহেব বললেন, আমরা এই আধুনিক যুগে বাস করছি। মধ্যযুগীয় এই সব কাজ কেন করা হবে?
তখন আশরাফ সাহেব ফকির সাহেবকে জিজ্ঞেস করল, মধ্যযুগীয় বলেই কি তা করা যাবে না? এমন অনেক আইডিয়া তো সমাজে গৃহীত আছে যাদের উৎপত্তি মধ্যযুগে।
এখানে ফকির সাহেব মধ্যযুগীয় বলে একটি কাজকে ভুল বলতে পারেন না বা কেন করা হবে সে প্রশ্ন তুলতে পারেন না। কাজটি তার কাছে অযৌক্তিক মনে হলে তিনি কাজের উপর ভিত্তি করে তার যুক্তি উপস্থাপন করবেন। মধ্যযুগে উৎপত্তি কাজটিকে ভুল বা ঠিক কিছুই প্রমাণ করে না।
উদাহরণ তিন –
ফকির সাহেব একবার এক সাহিত্যিক তর্কে বললেন, আমি চল্লিশ বছর ধরে বাংলা সাহিত্যের সাথে যুক্ত আছি। তাই আমার এই মত ঠিক।
এখানে ফকির সাহেবের মতের ঠিক বা বেঠিকতা তার যুক্তির উপরে নির্ভর করবে, চল্লিশ বছর না চল্লিশ হাজার বছর তিনি সাহিত্যের সাথে যুক্ত আছেন; তার উপরে নয়।
ফকির সাহেবের এইসব বিভ্রান্ত্রি একেকটা জেনেটিক ফ্যালাসি।
১২। গিল্ট বাই এসোসিয়েশন
অন্য কোন সামাজিকভাবে দোষী হিসেবে পরিচিত ব্যক্তি বা গ্রুপের সাথে মিল দেখিয়ে কোন যুক্তিকে নস্যাৎ করে দেয়ার বিভ্রান্তি।
উদাহরণ এক –
মেয়েদের বাইরে, অফিস আদালতে কাজ করতে দেয়া হবে কি না এ নিয়ে আলোচনা চলছিল। ফকির সাহেব এক্ষেত্রে আবার উলটা, এখানে তিনি নারীদের বাইরে কাজের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। অনেকে বলতে পারেন “একটু আগে না তিনি টুপির বিরোধীতা করলেন, আমি তো ভেবেছিলাম ফকির সাহেব প্রগ্রতিশীল!”
কভি নেহী! ফকির সাহেব কোন শীলই নন। তিনি নিজে বিভ্রান্ত হন এবং অপরকে বিভ্রান্ত করে ছাড়েন।
নারীদের বাইরে কাজ করার বিষয়ে আলোচনায় ফকির সাহেব বলে উঠলেন, “আমরা আমাদের মেয়েদের বাইরে কাজ করতে দিতে পারি না। কারণ ইহুদি নাসারাদের দেশে মেয়েরা বাইরে কাজ করে। ওইসব দেশে খুন জখম রেইপ মারামারি লেগেই আছে।
ফকির সাহেবের এই উক্তি গিল্ট বাই এসোসিয়েশন। তিনি অন্যান্য দেশের খারাপ কিছু ঘটনার সাথে মিলিয়ে নারীদের মৌলিক একটি অধিকারের বিরোধীতা করতে চেয়েছেন।
১৩। এফার্মিং দ্য কনসিকুয়েন্ট
ফকির সাহেব বললেন, যে সাহিত্যে পরিশ্রম ও সাধনা করে না, সে ব্যর্থ হয়। তাকে নিয়ে আলোচনা হয় না। সে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পায় না। হামিদুর রহমানকে কেউ চিনে না, সে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পায় নি। অতএব, সে অবশ্যই পরিশ্রম করে সাহিত্য সাধনা করে নি।
এখানে ফকির সাহেব যে যুক্তি দিয়েছেন তা বিভ্রান্তি। কারণ হামিদুর রহমান বাংলা একাডেমী পুরস্কার না পেলেই বা সামাজিক সফলতা না পেলেই বলা যায় না তিনি পরিশ্রম করে সাহিত্য সাধনা করেন নি। কারণ পরিশ্রম করার পরেও মানুষ ব্যর্থ হন। আবার বহু শিল্পী ও সাহিত্যিক তার সময়ে সফলতা পান নি। অনেক অনেক পরে আলোচনায় এসেছেন।
এই ফ্যালাসির গঠনঃ
ক হইলে খ, তাহলে খ; হয় ক।
এই বিভ্রান্তি শুনতে ঠিক মনে হয়। কিন্তু এখানে দুইটি যুক্তির ভিত্তি ভিন্ন তাই তারা একই ফলাফলে যেতে পারে না।
ক হইলে খঃ
যে সাহিত্যে পরিশ্রম ও সাধনা করে না সে ব্যর্থ হয়। বাংলা একাডেমী পায় না।
তাই খ; হয় কঃ
হামিদুর রহমান বাংলা একাডেমি পান নি অতএব তিনি পরিশ্রম ও সাধনা করেন নি।
উদাহরণ দুই-
ফকির সাহেব একবার তার সঙ্গীতজ্ঞান দেখাতে বললেন, বড় গায়কের ছেলেরা ভালো গান গায়। বজলু ভাল গান গায়। অতএব, বজলু অবশ্যই কোন বড় গায়কের ছেলে।
১৪। আপিল টু হিপোক্রিসি
কারো পূর্ববর্তী অবস্থান তুলে ধরে তার বর্তমান যুক্তির সাথে এর অসামঞ্জস্যতা দেখিয়ে তার যুক্তিকে ভ্রান্ত প্রমানের বিভ্রান্তি।
কেউ তার অবস্থান নিয়ে স্থির না হলেই তার বর্তমান যুক্তি ভুল হয় না।
কেউ ক্যাপিটালিজম বা কর্পোরেটদের আগ্রাসনের বিরোধীতা করলে যদি বলা হয়, আপনি নিজেই তো দামি ঘড়ি পরেছেন, শার্ট পরেছেন। এগুলি ক্যাপিটালিজমের অবদান। অতএব, আপনার ক্যাপিটালিজম বা কর্পোরেট আগ্রাসনের বিরোধীতা করার যুক্তি ভুল। এটি আপিল টু হিপোক্রিসি হবে।
উদাহরনঃ
একবার ফকির সাহেবের পূর্বের বন্ধু ও কমরেড আমজাদ সাহেব এক বিবৃতিতে বললেন, “ঐ ফকির লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আমাদের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলির কারণে। আমরা ওকে নানা ভাবে হেল্প করেছি। তার সব লিখিত প্রমান আছে আমার কাছে। ও এখন ফ্যাসিবাদী দলের চাটুকার হয়ে গেল দুটা পুরস্কারের লোভে!”
একথা শুনে ফকির তালুকদার তার ভাষণে বললেন, “আমজাদ বামপন্থার কী বুঝে? ও যে পুঁজিবাদের বিরোধীতা করে কিন্তু নিজে বেনসন খায় তা কী আমরা জানি না! নিজে কত বড় বাড়ি বানিয়েছে। ওসব লোকের কথা পাত্তা দেবেন না।”
এখানে ফকির সাহেব তার উপর যে অভিযোগ করেছিলেন আমজাদ সাহেব তা নিয়ে কথা না বলে আমজাদ সাহবকে হিপোক্রেট প্রমাণ করে পার পেতে চেয়েছেন। এটাই আপিল টু হিপোক্রিসি।
১৫। স্লিপারি স্লপ
কোন যুক্তিকে ভুল বলা এই যুক্তিতে যে এটা মেনে নিলে মারাত্মক সব ফল ডেকে নিয়ে আসবে।
উদাহরনঃ
ফকির সাহেব একবার রাগত স্বরে বললেন, ইন্টারনেটে বাংলা লেখা বন্ধ করতে হবে। কারণ এসব লেখালেখি আমাদের সাহিত্যের জন্য হুমকি স্বরূপ। এগুলি ভাষা বদলে দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় আসবে যে আমরা বাংলা ভাষা চিনতে পারব না। বাংলা বলে কিছু থাকবে না।
ফকির সাহেবের স্লিপারি স্লপ একটি ভয় দেখাচ্ছে। ফকির সাহেব এই বিভ্রান্তিকর যুক্তি দিচ্ছেন কারণ তিনি হয়ত লেখালেখিতে নিজের বা নিজেদের কতৃত্ব চান অথবা তার অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে। ইন্টারনেটে স্বাধীনভাবে লেখালেখি হচ্ছে, সম্পাদকের লাঠি নেই, পত্রিকার কতৃত্ব নেই এসব তিনি পছন্দ করছেন না। তার ভাষাতত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞাণও অল্প অথবা ইচ্ছা করেই তিনি তার পাঠক বা শ্রোতাদের বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছেন।
১৬। আপিল টু ব্যান্ড ওয়াগন
এই বিভ্রান্তিতে বলা হয়, বেশীরভাগ লোকে কোন জিনিস বিশ্বাস করে। অতএব তা সত্য।
কিন্তু এটি ভুল। গ্যালিলিও’র সময়ে বেশীরভাগ লোকে বিশ্বাস করত পৃথিবী ঘুরে না, সূর্য ঘুরে।
কোন যুক্তির ঠিক বা বেঠিকতা বেশীরভাগ লোকের বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের উপরে নির্ভর করে না।
এটি বেশী ব্যবহৃত হয়। কারণ এর দ্বারা মানুষ বেশী প্রভাবিত হয়। বেশীরভাগ লোক কোন জিনিস বিশ্বাস করে, এটা মানুষের আস্থা জাগায়। ফকির সাহেব একবার বলেছিলেন, “বেশীরভাগ লোক বলে পৃথিবী গোলাকার নয়। অতএব পৃথিবী সমতল।”
১৭। এড হোমিনেম
ব্যক্তিগত আক্রমণ।
যুক্তির উত্তরে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে যুক্তিকে উড়িয়ে দেয়া, যা একটি কমন বিভ্রান্তি। আক্রমন যে সব সময় গালির মত হবে এমন নয়। নিম্নোক্ত উদাহরণগুলি দেখা যাক, এখানে দুই ধরনের এড হোমিনেম আছে।
উদাহরণ এক-
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ফকির সাহেবের ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু তাকে আটকে ফেলেছিল। তখন ফকির সাহেব এড হোমিনেম প্রয়োগ করেন এভাবেঃ
“তুমি কি ইতিহাসবিদ? ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের কী বুঝবে? নিজের চরকায় তেল দাও।”
এখানে ফকির সাহেবের বন্ধুর যুক্তিটাই বিবেচ্য, সে ইঞ্জিনিয়ার না ইতিহাসবিদ তা বিবেচয় নয়; কিন্তু ফকির সাহেব এই প্রসঙ্গ এনে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন।
উদাহরন দুই–
একবার রাজনীতিবিদ আফজাল সাহেব দুই কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন এমন অভিযোগ করলেন সচিব হামিদ সাহেব। তিনি বললেন তার কাছে প্রমান আছে। আর এদিকে আফজাল সাহেবের একনিষ্ঠ একজন চাটুকার আমাদের ফকির সাহেব। ফকির সাহেব এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে হামিদ সাহেবকে বললেন, “কী ব্যাপার? আপনি আফজাল সাহেবের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলছেন? কিন্তু আপনি নিজেই তো গতবছর ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন, সে কথা আমরা ভুলি নি। নিজের অতীত স্মরণ করুন।”
এখানে হামিদ সাহেবের গত বছর ঘুষ নেয়া বা নেয়ার সাথে আফজাল সাহেবের প্রতি তার করা অভিযোগের সত্য মিথ্যা নির্ভর করে না। ফকির সাহেব তাকে চুপ করিয়ে দেবার জন্য এ আক্রমণ করলেন।
এই ধরনের আক্রমণ মূল যুক্তিকে পাশ কাটিয়ে ব্যক্তিকে লক্ষ্য হিসেবে আঘাত করে।
১৮। সার্কুলার রিজনিং
সার্কুলার রিজনিং এ যা ফলাফল তাকেই ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
যেমন, তুমি ঈশ্বরে বিশ্বাস কর না তাই নরকে যাবে।
এখানে যে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না সে নরকেও বিশ্বাস করে না। অতএব তাকে এভাবে ভয় দেখানো যে যুক্তিতে, তা সার্কুলার রিজনিং। যেহেতু এক্স, তাই এক্স।
ফকির সাহেব একবার পত্রিকায় বিবৃতি দিলেন, “আমি বাংলা সাহিত্যের সেরা গল্পকার। আমি কারো দ্বারা প্রভাবিত নই।”
সাংবাদিকেরা পরদিন এসে তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার এমন মতের কারণ কী?
ফকির তালুকদার মুচকি হেসে বললেন, “আমি গল্প লেখি। আমি তাই বাংলা সাহিত্যের সেরা গল্পকার। আমি কারো দ্বারা প্রভাবিত নই।”
সাংবাদিকেরা আবার জিজ্ঞেস করেন, কিন্তু কীভাবে?
ফকির সাহেব বললেন, “কারন আমি কারো দ্বারা প্রভাবিত নই, আমি শ্রেষ্ট গল্পকার, কারণ আমি গল্প লেখি।”
ফকির সাহেবের এসব কথা বার্তা “এক্স” তাই “এক্স”।
বি দ্রঃ পরে জানা গেছে ঐ ক’দিন তিনি বিদেশী এক ধরনের মাদকের প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ ছিলেন।
১৯। কম্পোজিশন এবং ডিভিশন
কম্পোজিশনের বিভ্রান্তির ক্ষেত্রে, কোন গ্রুপের সদস্যদের বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে গ্রুপের সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সিদ্ধান্তে যাওয়া। যেমন ভেড়ার পালের সব ভেড়ার মা আছে। অতএব ভেড়ার পালের মা আছে।
ফকির তালুকদারের একবার শখ হয়েছিল টেক উদ্যোক্তা হওয়ার। তিনি একটি সফটওয়ার তৈরী করিয়েছিলেন। এই সফটওয়ার নিয়ে তার মন্তব্য ছিল এমন, “এই সফটওয়ার সিস্টেমের সব অংশ আলাদা আলাদাভাবে পরীক্ষিত। তারা দারুণ কাজ করে। তাই সফটওয়ারটির সব অংশ যোগ করে যখন চালু করা হবে তখন দারুণ কাজ করবে।”
এখানে আলাদা পার্ট একত্রিত হলে তাদের সামগ্রিক কাজ করার প্রক্রিয়া ভিন্ন হবে, জটিল হবে; এটাকে অগ্রাহ্য করা হচ্ছিল। ফকির সাহেবের কথা শুনে সফটওয়ারটি কিনে নেয় সরকারের একটি মন্ত্রণালয়। কিন্তু সফটওয়ারের আলাদা অংশ যুক্ত হবার পর দেখা যায়, কিছু এরর দেখাচ্ছে। অর্থাৎ, সফটওয়ারটি কাজ করে নি। এজন্য বেশ সমালোচনা হয় মিডিয়ায় এবং তাই ফকির সাহেবের টেক উদ্যোক্তা হওয়া আর হয় নি।
আবার ডিভোশনের বিভ্রান্তি হল, কোন দল ভালো কাজ করে, সেই হিসেবে গ্রুপের সদস্যরা আলাদাভাবে ভালো কাজ করবে তা ধরে নেয়া। যেমন,
ফকির সাহেব একবার একটি ফুটবল দল করেছিলেন। তিনি ওতে জলের মত টাকা ঢালেন। তাই ওটা লীগ পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায়। সেই ফুটবল দল নিয়ে ফকির সাহেব মন্তব্য করেন, “আমরা অপরাজেয় ফুটবল দল। তাই আমাদের প্রত্যেক প্লেয়ার নিজ নিজ জায়গায় অপরাজেয়।”
সহজেই বুঝা যাচ্ছে এমন সিদ্ধান্তে যাওয়া বিভ্রান্তি। কারণ দলগত পারফরমেন্স সেরা হলেই সবাই যার যার জায়গায় সেরা হবে এমন বলা যায় না।
শেষকথা
তর্কের ফ্যালাসি নিয়ে অনেক বই আছে। একটি বই লজিক্যালি ফ্যালাসিয়াস। এটা বেশ বড় এবং তাতে অনেক ফ্যালাসি উদাহরনসহ যুক্ত আছে। কিন্তু সব মনে রাখা বেশ কঠিন ব্যাপার। তাই সহজ একটি বই এন ইলাস্ট্রেটেড বুক অব ব্যাড আর্গুমেন্টস। এখানে সবচেয়ে কমন প্রায় সব ফ্যালাসি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, সাথে আছে ইলাস্ট্রেশন; এই উনিশটি আমিও উপরে আলোচনা করলাম। সামান্য চেষ্টার মাধ্যমে এগুলি আয়ত্ত্ব করা সম্ভব।
আমরা তর্কের বা আর্গুমেন্টের বিভ্রান্তি সম্পর্কে জানলাম। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়, বক্তব্যে ভালোমত খেয়াল করলে এর কয়েকটি বা সব ক’টি পাওয়া যেতে পারে। তর্কে এইসব বিভ্রান্তি এড়িয়ে চলা উচিত। অন্যথায় যুক্তির বা অবস্থানের যৌক্তিকতা থাকবে না। এবং ফকির তালুকদারের মত লোকেরা যখন এই বিভ্রান্তিদের ব্যবহার করে আমাদের বিভ্রান্ত করতে চায়, তখন যেন আমরা বিভ্রান্ত না হই।