স্বচ্ছতার বিভ্রান্তি বা কার্স অব নলেজ

অনলাইন তর্ক বিতর্ক বা এই ধারার বুদ্ধিভিত্তিক চর্চার এক বড় সমস্যা হলো সমস্ত ব্যাপারটাই লিখিত। একজন লিখে তার মত প্রকাশ করেন ও অন্যজন লিখেই তার উত্তর দেন বা মত খন্ডান। এই লেখালেখি আলোচনার বড় একটি সীমাবদ্বতা আছে। আমরা যদি গভীরে যাই, দেরিদায় তাহলে পুরা লেখা এবং লেখা যে কী অর্থ তৈরী করে তার সমস্তটাই ধোয়াশা তৈরী করে। তবে সেভাবে দেরিদায় না গিয়েও আমরা লেখা নিয়ে সমস্যায় পড়তে পারি, যেমন কোন লেখা যখন কেউ লিখেন তখন তিনি কী প্রকাশ করতে চান বা যাচ্ছেন তা তিনি পুরাটাই জানেন ধরা যাক। তিনি তার এই ধারনার কারনে ভাবেন যে তার মনে যা আছে হুবহু তাই প্রকাশ করছে লেখাটি। ফলে যিনি লেখাটি পড়ছেন তিনিও হুবহু সেই একই মেসেজটি পাচ্ছেন।

কিন্তু এই ধারণা ভুল। লেখক যা বুঝাতে চান লেখা পড়ে পাঠক তা পুরোপুরি নাও বুঝতে পারেন।

রহিম বাশশা ও করিম সদাগর দুই বন্ধু। রহিম বাশশা বন্ধু করিম সদাগরকে এক নতুন রেস্টুরেন্টের কথা বলল। সে জানাল ঐ রেস্টুরেন্টে ভালো খাবার হয়। বন্ধুর কথায় করিম সদাগর রেস্টুরেন্টটিতে খেতে গেলে। খেতে গিয়ে সে দেখলঃ

(১) খাবার মাঝারি, সার্ভিস বাজে অথবা (২) খাবার খুবই ভালো, সার্ভিস ভালো।

সে বন্ধু রহিম বাশশাকে মেসেজ দিল, “তুই যে রেস্টুরেন্টের কথা বলেছিলি তাতে আজ খাইলাম! বলতেই হয়, অসাধারন! একেবারে অসাধারন!”

গবেষক কাইজার সম্ভবনা (১) এর কথা জানিয়ে লোকদের (সাবজেক্টদের, যারা তার পরীক্ষায় সাহায্য করছিলেন।) জিজ্ঞেস করলেন করিম সদাগর বন্ধু রহিম বাশশাকে যে মেসেজ দিল তাতে কী বুঝায়?

৫৯% জবাব দিলেন যে, করিম সদাগরের এই মেসেজ ব্যঙ্গার্থে, এবং রহিম বাশশা তা বুঝতে পারবে। অর্থাৎ, করিম অসাধারন বলে ব্যঙ্গ করেছে যেহেতু খাবার ভালো না, তা রহিম বুঝতে পারবে।

গবেষক এরপর আরেকদলকে সম্ভাবনা (২) এর কথা জানিয়ে বললেন, করিমের মেসেজটি সম্পর্কে। মাত্র ৩% জানাল রহিম বাশশা করিমের এই মেসেজকে ব্যঙ্গাত্মক ধরে নিতে পারে।

দুই দলই তাদের জানার উপর ভিত্তি করে ধরে নিচ্ছে রহিম বাশশা কীভাবে লিখিত বক্তব্যটির অর্থ করবে। কিন্তু রহিম বাশশা সম্ভাবনা (১) বা (২) কোনটাই জানে না।

কগনিটিভ কসাইকোলজিস্ট কাইজার দেখালেন যে, যেহেতু যাদের জিজ্ঞেস করা হচ্ছে তারা মূল ব্যাপারটি জানে তাই তারা ধরে নিচ্ছে লিখিত লেখাটিও সেইরকম বুঝাচ্ছে এবং রহিম বাশশা অর্থাৎ যিনি পাঠ করবেন তিনিও ঐভাবে বুঝবেন। এখানে রহিম বাশশা কীরকম লোক তা তাদের বিবেচনাতেই নেই। তারা ভাবছে ব্যাপারটা ট্র্যান্সপারেন্ট বা স্বচ্ছ, করিম যা বুঝাচ্ছে তাই বুঝবে রহিম।

একই ব্যাপার ঘটে, যখন কেউ লিখেন। তিনি ভাবেন তিনি যা বুঝাচ্ছেন তা ঠিকঠাক বুঝে নিচ্ছেন পাঠক। কিন্তু পাঠক তা ঐরকম না বুঝতে পারেন। একই লিখিত বক্তব্য বিভিন্ন রকম অর্থব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠতে পারে বিভিন্ন লোকের কাছে। তাদের অভিজ্ঞতা বা অন্য কোন কারণে।

ব্যাপারটা ট্র্যান্সপারেন্ট বা স্বচ্ছ নয়। তাই কোন লিখিত বক্তব্য ও মতামত কেউ না বুঝলে রাগান্বিত হবার আগে এটা মাথায় দরকার।

লিখিত বক্তব্যের এই সীমাবদ্ধতার কথা পড়ে কারো মনে হতে পারে প্রবন্ধ বা এই ধরনের লেখার ক্ষেত্রেও এই সমস্যা হতে পারে কি না। হ্যাঁ, হয় এটা। এটাকে কার্স অব নলেজ বা জ্ঞানের অভিশাপ হিসেবেও দেখা যায়। এই নামে সেন্স অব স্টাইলে একটি অধ্যায়ই লিখেছেন কগনিটিভ সাইকোলজিস্ট স্টিভেন পিংকার।

কার্স অব নলেজ হলো লেখক যা জানেন তিনি মনে করেন পাঠকও তা জানেন। এক্ষেত্রে তিনি যে লেখাটি উপস্থাপন করেন তা জটিল হয়ে পড়ে। কিছু স্যুডো ইন্টেলেকচুয়াল বা স্টান্টবাজ ব্যক্তি অবশ্য ইচ্ছে করেই লেখা জটিল করে থাকেন, এবং এদের ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই কী বলতে চান তা বুঝেন না। কিন্তু অনেক ভালো বুদ্ধিজীবি, সৎ একাডেমিশিয়ানও দুর্বোধ্য ভাবে লিখেন (বা তাদের লেখা দুর্বোধ্য হয়ে উঠে), এর অর্থ এই নয় যে যা বলতে চাচ্ছেন তা তার কাছে স্পষ্ট নয়। তার কাছে বিষয়টা স্পষ্ট আছে কিন্তু তিনি যা জানেন, তিনি ধরে নিচ্ছেন পাঠকও ঐরকম জানেন। ফলে কঠিন শব্দ ব্যবহার তিনি করে যাচ্ছেন ব্যাখ্যা ছাড়াই।

অনেক ক্ষেত্রে দেখবেন অথোরিটারিয়ান, টোটালিটারিয়ান, ওরিয়েন্টাল ভিউ, হেজিমনি, ডিস্কোর্স, সাব-অল্টার্ন ইত্যাদি আরো অনেক শব্দ অহরহ ব্যবহার করে যান লেখক, তার কাছে তখন (লেখার সময়) এটা মনে হয় না যে পাঠকের এই শব্দগুলির সাথে পরিচয় নাও থাকতে পারে। মানুষের এটা খুবই সাধারণ প্রবণতা যে সে যা জানে, তার মনে হয় হয়ত অন্যরাও সেগুলি জানে। এবং লেখায় ভাব প্রকাশ সহজ ব্যাপার নয়, ফলে এদিক দিয়ে সব সময় সচেতন থাকাও সহজ নয়। কিন্তু লেখাকে সহজবোধ্য করতে লেখককে ব্যাপারটি মাথায় রাখতে হবে। আবার লেখকের টার্গেট রিডার যদি থাকে কেবলমাত্র ঐসব টার্ম জানা পাঠক তবে তিনি এই শব্দগুলি ব্যবহার করে যেতেই পারেন। কিন্তু সাধারণ পাঠক তার লক্ষ্য হলে বড় শব্দ ব্যবহারের সময় তাকে ভাবতে হবে কার্স অব নলেজের ব্যাপারটি নিয়ে।

যেমন এই লেখার শুরুতে আমি দেরিদার কথা বলেছি, এবং এই বলায় আমি ধরে নিয়েছি পাঠক দেরিদা সম্পর্কে অল্প বিস্তর জানেন। এটি লেখকের কার্স অব নলেজ, এবং এর জন্য এই লেখাটি কিছুটা দুর্বোধ্য হয়ে উঠে। আমি বুঝিয়েছি দেরিদার অবস্থানঃ “কনটেক্সট” এর বাইরে লেখার কোন অর্থ নাই। অর্থাৎ, এর ব্যাখ্যায় বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের গান ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে। আগে এর অর্থ ছিল চাবি মানে তালাই বুঝিয়েছেন লেখক। কিন্তু এখন ইন্টারনেট প্রযুক্তির উন্নয়নের কালে কেউ বলতে পারেন এই চাবি অর্থ পাসওয়ার্ড। অর্থাৎ, কনটেক্সট বা প্রেক্ষিতই অর্থ তৈরী করে, লিখিত লেখাটি নয়। দেরিদার মত এমনই। এই মতকে কেন্দ্র করে তার তত্ত্বটির নাম ডিকনস্ট্রাকশন বা বিণির্মান। জ্যাক দেরিদা একজন ফ্রেঞ্চ দার্শনিক।