ইসলামে বিপ্লব কইরা ক্ষমতা দখল ব্যাপারটাই নাই, এমন বলেন ইরানি দার্শনিক দারিউশ শায়েগান। কারণ এমন বিপ্লবের ধারনা আধুনিক, জন্ম নিল ১৮ শতকের ফ্রান্সে, আর ইসলাম ও তার টেক্সট তার চাইতে বহু আগের। তিনি বলেন ধর্ম যখন বিপ্লবের ধান্ধায় পড়ে তখন তা মতাদর্শ হইয়া উঠে। তখন তা অন্যসব মতাদর্শের মতই হইয়া উঠে এবং নিজের ট্র্যানসেনডেন্ট আকারটা হারাইয়া ফেলে। ট্র্যানসেনডেন্ট মানে বাস্তবতার উর্ধ্বের বিষয় বা যা বাস্তব মানব অভিজ্ঞতা দ্বারা বুঝা যায় না, যেমন ধর্মের ঈশ্বর ধারণা ইত্যাদি।
ইসলামে রাজতন্ত্রও নাই অতি অবশ্যই। ইরানে তথাকথিত ইসলামিক বিপ্লব হইল এবং শিয়া খোমেনি ক্ষমতা নিয়া নিলেন। বর্তমানে ডেমোক্রেসি ও থিওক্রেসির এক খিচুরী ব্যবস্থা সেথায় চালু আছে।
ইরানের এই বিপ্লব এবং ক্ষমতা নেয়ারে ভালো ভাবে দেখতে পারে নাই আরব রাজারা। কারণ এটা তাদের রাজতন্ত্র টিকায়া রাখার জন্য হুমকি স্বরূপ।
১৯৮১ সালে বাহরাইনের রাজারে সরানোর জন্য এক ক্যু করার চেষ্টা হইল, অভিযোগ আছে এর সাথে জড়িত ইসলামিক ফ্রন্ট ফর লিবারেশন অব বাহরাইনের পেছনে কলকাঠি নাড়ছিল ইরান। তাদের লক্ষ্য ছিল বাহরাইনে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র কায়েম। কিন্তু তা সফল হয় নাই। এই ক্যু ও পরে ইরাক-ইরান যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় গঠিত হয় জিসিসি বা গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল। সৌদি আরব, কুয়েত, বাহরাইন, কাতার, ওমান ও আরব আমিরাত নিয়া।
এই দেশগুলাতে রাজতন্ত্র, ট্রাইবের নেতাদের মধ্যে চুক্তি হইছে নিজেদের লাভের জন্য। জিসিসির কাজ বা প্রধান বিষয়ের মধ্যে আছেঃ
* একত্রিত বা যৌথ সেনাবাহিনী।
* ধর্ম, অর্থ বাণিজ্য, আইন, প্রশাসন ইত্যাদি ক্ষেত্রে একই ধরনের নিয়ম নীতি মেনে চলা।
তো, মূলত এটা তাদের রাজতন্ত্র টিকাইয়া রাখার জন্যে।
ইরান চায় শিয়া মিলিশিয়াদের মাধ্যমে ধর্মীয় প্রজাতন্ত্রের বিস্তার। এই জন্য ইয়ামনে হুথিদের, লেবাননে হেজবুল্লাহ ইত্যাদি মিলিশিয়ারে সাপোর্ট দিয়া যায় এবং পুতিনের সাথে মিলে সিরিয়ায় আল আসাদরে ক্ষমতায় রাখে।
আর কাতার কী করে?
কাতার হামাসের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখে। আবার ইজরায়েলের সাথে সুসম্পর্ক রাখে।
কাতার ইরানের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখে, যেই ইরানের বিপ্লব রাজতন্ত্রের জন্য প্রধান হুমকি হইয়া উঠে এবং যেই ইরানের বিরুদ্ধে সৌদি ও জিসিসি। ইরানের সাথে কাতারের সম্পর্ক কী কারণে? পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্যাসফিল্ড সাউথ পারস ইরান ও কাতারের যৌথ মালিকানায় এবং কাতারে আসা তেলের বড় একটা অংশ আসে ইরান নিয়ন্ত্রিত ফিল্ড হতে।
কাতার মুসলিম ব্রাদারহুডরে সমর্থন দেয়। যে ব্রাদারহুড আরব স্প্রিং এর পরে মিশরের ক্ষমতায় গেছিল ইলেকশনের মাধ্যমেই, পরে আল সিসির মাধ্যমে তাদের বিনাশ হয়। এই মুসলিম ব্রাদারহুড আরো অনেক আরব দেশে তার তৎপরতা চালাইছে রাজতন্ত্রের পতনে। সৌদির জন্য এরা বর্তমানে এক বড় ভবিষ্যত হুমকি। আরব স্প্রিং এর কালে যখন কাতার মুসলিম ব্রাদারহুডরে সাপোর্ট দেয়, তখনও সৌদি বাহরাইন ইত্যাদি কাতারের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছিল।
কাতারের আছে নিউজ চ্যানেল আল জাজিরা। আল জাজিরা সৌদি রাজতন্ত্রের সমালোচনা করে, আরব অন্য রাজতন্ত্রের সমালোচনা করে কিন্তু কাতারি রাজতন্ত্র নিয়া কিছু বলে না। সৌদির এই ভয় অমূলক নয় যে মুসলিম ব্রাদারহুডরে সৌদিতেও আল জাজিরা সমর্থন দিবে, এবং রাজতন্ত্র হটানোর কোন বিপ্লব হইলে তারা বিপ্লবীদের পক্ষ নিবে।
সিরিয়ায় সৌদি ও জিসিসি এবং আমেরিকা আল আসাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের সমর্থনে। ইরান ও পুতিন আল আসাদের পক্ষে। কাতার সবচাইতে বেশী অস্ত্র দিছে বিদ্রোহীদের, এবং তা সেই অঞ্চলের যুদ্ধের আগুনে ঘি ঢালছে তা বলাবাহুল্য।
কাতার যে পরস্পরবিরোধী ভাবে অবস্থান নেয় বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বা সিরিয়াতে যে এত এত অস্ত্র দেয় তা কি কারণ ছাড়াই? অবশ্যই নয়। রাশা ইউরোপে এলএনজি রপ্তানীতে মনোপলি ব্যবসা করে, কাতার এই ব্যবসায় ভাগ বসাইতে চায়। এইজন্য তাদের সিরিয়া দিয়ে এলএনজি পাইপলাইন দরকার। কাতারের মূল সম্পদ তেল নয়, এলএনজি। সিরিয়ার আল আসাদ যেহেতু পুতিনের মিত্র তাই আল আসাদের সিরিয়ায় সেই সুযোগ পাবে না কাতার। ফলে বিদ্রোহীদের সমর্থন দেয়, অকাতরে অস্ত্র দেয় যাতে আল আসাদরে ক্ষমতা থেকে ফেলে দিতে পারে। কিন্তু আসাদরে ফেলতে পারে নাই।
আসাদরে ফেলতে না পাইরা এখন আবার কাতার রাশা’র সাথে সম্পর্কে যাইতে চায়। গতবছর রাশার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত তেল কোম্পানি রসনেফটে ২.৭ বিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করতে সম্মত হইছে কাতার।
কাতাররে একঘরে করা সৌদি আরব ও তার মিত্রদের ভালো সিদ্ধান্ত। সৌদি রাজা নিজ বংশের রাজতন্ত্র টিকাইয়া রাখতে চান, তা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। সৌদি রাজা হইবার যুদ্ধ বা গেইম অব থ্রোনস যেকোন সময় প্রকাশ্যে শুরু হইয়া যাইতে পারে কারণ এর যোগ্য দাবীদার একাধিক। এমতাবস্থায় একটা অস্থিতিশীলতা তৈরী হইতে পারে। দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হইবে না, এমনও বলা যায় না কারণ সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব হেলাফেলার মত নয়। অন্যদিকে ইরানের তৎপরতা তো আছেই। এমতাবস্থায় কাতার ও আল জাজিরা যদি বিরুদ্ধ অবস্থান নেয় তাইলে সৌদি রাজতন্ত্র বড় হুমকির মুখে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এবং এই ধরনের বিদ্রোহ ও গেইম অব থ্রোনস দেশরে নিয়া যাবে গৃহযুদ্ধে।
এই অবরোধে কাতারের সাথে সাথে সৌদি জোটের নিজেদেরও ক্ষতি হবে যদি একঘরে করাটা দীর্ঘস্থায়ী হয়। কিন্তু এর আগেই যদি কাতার লাইনে আসে তাহলে ভালো সকলের জন্যই। কোন কোন টার্মসে গিয়া এই সমস্যার সুরাহা হয় তা দেখার বিষয়। আমেরিকা যেহেতু এদের সবারই বস এই অঞ্চলে তাই এই সমস্যা সমাধানে আমেরিকার ভূমিকাই মূখ্য হবে ধরা যায়। অন্যথায় সমাধান সহজ হবে না।
এমনিতে কাতার পড়বে বেশী খারাপ অবস্থায়। তাদের প্রায় ৪০ ভাগ খাদ্যপণ্য আসে সৌদি থেকে। প্রতিবেশীদের উপর খাদ্যপণ্যের আমদানীর ক্ষেত্রে কাতার অতি নির্ভরশীল। এছাড়া কাতারের বিমান পরিবহন কাতার এয়ারওয়েজ ক্ষতির মুখে পড়বে। ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানের জন্য এবং পর্যাপ্ত তেলউদ্ভূত অর্থের কারণে কাতার এয়ারওয়েজ এবং আরব আমিরাতের ইত্তিহাদ ও আমিরাত এয়ারওয়েজ ব্যাপকভাবে সফল হইছে। আকাশে তাদের এই প্রাধান্য আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান বিমান পরিবহনের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে উঠে এবং আমেরিকান বিমান পরিবহন কোম্পানিগুলি বার বার তাদের সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসতেছিল ওপেন স্কাই এগ্রিমেন্ট পুনঃপর্যালোচনা করে কিছু নিয়ম নীতি সংশোধনের জন্য। অন্যথায় তারা টিকে থাকতে পারতেছে না, এবং আমেরিকায় অনেক জব নষ্ট হইতেছে বলে তারা অভিযোগ জানায়। ট্রাম্প কাতারের এই একঘরে হওয়ার সুযোগ নিয়া নিজেদের বিমান পরিবহণ কোম্পানিগুলির জন্য সুবিধাজনক কোন নিয়ম করতে পারেন।