শিল্প কী এটা এক গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নই, যখন আপনি শিল্প করতে চান। শিল্পের এক শাখা সাহিত্য। শিল্পের প্রথম রূপ কী? হয়ত সুর। প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষ গাছের পাতায় পাতায় ঘর্ষন বা অন্যান্য উপায়ে সুরের দেখা পেত। এরপরে নাচের কথা বলতে পারেন। বাদ্য বাজিয়ে জঙ্গলে থাকা মানুষেরা নাচত, যতক্ষণে তাদের শিকার করে আনা জন্তুটা পুড়তে থাকে। তবে এর আগে চিত্রশিল্পের কথাটাও আসতে পারে। প্রাচীন গুহাগুলিতে আঁকা হরিণ টরিন ইত্যাদি ছবি দেখা গেছে। শেষদিকে সাহিত্যও একটা শাখা।
তো শিল্প কী, এটা বুঝতে আর্নস্ট ফিশারের শিল্পের করনীয় অধ্যায় দেখা যেতে পারে। ফিশার প্রথমে লিখেছিলেন জীবনের প্রতিকল্প হিসেবে শিল্পের ধারনার কথা। এটি সম্ভবত প্লেটো থেকে আগত। প্লেটো বলেছিলেন জগত হচ্ছে একটি স্বর্গীয় মডেলের কপি, আর শিল্প হচ্ছে জগতের কপি। অর্থাৎ শিল্প তার মতে, কপির কপি।
চিত্রকর মন্ড্রিয়ান ভেবেছিলেন একসময় শিল্পের অন্তর্ধান হবে, শিল্পকে হটিয়ে দেবে বাস্তবতা। তিনি মনে করতেন শিল্পের ভাবকল্প এবং জগতের বাস্তবতা এই দুইয়ের ভারসাম্যব্যবস্থার প্রতিকল্পই শিল্প।
কিন্তু সমাজ যতই উন্নত হোক না কেন, পারিপার্শ্বিক জগত ও মানুষের মধ্যে স্থায়ী এবং পরিপূর্ন ভারসাম্য সম্ভব না কখনোই। তাই ফিশার বলেন শিল্পের প্রয়োজনীয়তা থাকবেই।
মানুষেরা বই পড়ে বা থিয়েটারে নাটক/ফিল্ম দেখে, গান শোনে…কিন্তু এগুলি তারা কেন করে? শুধুই কি বিনোদনের জন্য বা ভিন্ন স্বাদের জন্য অথবা বাস্তবতা থেকে পলায়নের জন্য?
শুধুমাত্র বিনোদনের কথা বললে তা ভুল হবে। মানুষ তার জীবনের অপূর্নতার বাইরে গিয়ে সমগ্র মানুষ হতে চায় শিল্প উপভোগের মাধ্যমে। বিচ্ছিন্ন মানুষ, স্বতন্ত্র মানুষ হিসেবে তার জীবনের সীমাবদ্ধতার বাইরে যাবার দরজা হলো শিল্প উপভোগ।
ফিশার বলেন সমগ্র মানবতা যা করতে পারে তা একজন ব্যক্তি মানুষ তার সম্ভাবনা হিসেবে দেখতে পারে। মানুষের বর্ধিত ও পরিপূর্ন হবার বাসনা প্রমাণ করে সে কেবলমাত্র ব্যক্তিস্বত্তার চাইতে বেশী কিছু।
তো একজন শিল্পী কীভাবে কাজ করবেন? ফিশার বলেন, প্রকৃত শিল্পী ভাবাবেগ দ্বারা আক্রান্ত হন না, বরং ভাবাবেগকে পোষ মানান।
শিল্পী হবার জন্য দরকারী অভিজ্ঞতা অর্জন এবং তা ধারণ এবং স্মৃতিতে রুপান্তরিত করা। শিল্পী তা অর্জন করেন এবং তার শিল্পে এর প্রকাশ ঘটান। শিল্পীকে জানতে হয়, উপভোগ করতে হয় তার পেশাকে। সকল নিয়ম কানুন, রীতি, প্রথা, কলা কৌশল আয়ত্ত্ব করতে হয়।
ফিশার এরপর গেছেন শিল্প কীভাবে হবে এমন কিছু তত্ত্বে। প্রথমত এরিস্টটল মনে করতেন নাটকের কাজ হলো আবেগকে বিশোধীত করা, ভীতি ও করুণাকে অতিক্রম করে যাওয়া…ফিশার মনে করেন এক্ষেত্রে এরিস্টটলকে ভুল বুঝা হয়। ব্রেখটের কথা তুলে ধরে ফিশার বলেন,
ব্রেখটের কথায়ঃ
১। থিয়েটার অবশ্যই উপলব্ধির রোমাঞ্চকে উৎসাহিত করে।
২। কিন্তু বাস্তবকে পরিবর্তনের জন্য জনগণকে শিক্ষিত করে তোলাও তার কাজ। দর্শক প্রমিথিউসের মুক্তি কাহিনীর মধ্য দিয়ে শুধু রোমাঞ্চই লাভ করবে না, নিজেদের শিক্ষিতও করবে।
অর্থাৎ এখানে শিল্পের কাজ কেবল আনন্দদান নয়। দর্শক শ্রোতার চিত্তাকর্ষন করবে ঠিক তবে তা নিষ্ক্রিয় একাত্মবোধ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে নয়, যুক্তিবুদ্ধির কাছে আবেদন পেশ করে, যে আবেদন কর্ম ও সিদ্ধান্ত দাবী করে। কিন্তু তা কখনোই এমন না যে কেবলমাত্র একটি বক্তব্য নিয়েই হাজির হবেন শিল্পী। দর্শককে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়ার জন্য আবেগ-অনুভূতি, ব্যঞ্জনার আশ্রয় নিতে হয়, যাতে দর্শক শিল্পটির ভেতরে প্রবেশ করতে পারে।
শিল্পের এই করনীয়টির দিকে লক্ষ্য রাখলেই আমরা একটি ভালো ফিল্ম (যেমন কুরোসাওয়ার সেভেন সামুরাই) এর সাথে একটি পর্নো ফিল্মের পার্থক্য করতে পারি। সেভেন সামুরাই শিল্প কারণ উত্তেজনা ও রোমাঞ্চের মাধ্যমে তা আমাদের চিত্তাকর্ষন করলেও আমাদের শিক্ষিত করে তোলে। কিন্তু একটি পর্নো ফিল্ম যে চিত্তাকর্ষন করে বা যে বিনোদন দেয় তা কেবলই একাত্মবোধ সৃষ্টির মাধ্যমে। তা কোন যুক্তিবোধের কাছে আবেদন পেশ করে না, যে আবেদন কর্ম ও সিদ্ধান্ত দাবী করে।
শিল্পের আরেকটি বিষয় হলো কালের ব্যবধান। অনেক আগের কোন একটি শিল্পকর্মের আবেদন আমাদের কাছে কেন থাকে যেখানে আমাদের জীবন যাত্রা ও প্রযুক্তি অনেক পরিবর্তিত হয়ে গেছে। সকল শিল্পই তার কালের শর্তাধীন। কিন্তু শিল্প আবার কালের সীমাবদ্বতা ছাড়িয়ে যায়। হোমার, সফোক্লিস এরা যখন তাদের সমাজের দাস শৃংখল ভিত্তিক সরল অবস্থা তুলে ধরেন তখন তারা সেই কালের ফাঁদে আটকা পড়েন। কিন্তু আবার তারাই যখন একই নাটকে মানুষের মহত্ত্ব, মানবিক দ্বন্দ্ব, আবেগের শিল্পরূপ ও অসীম সম্ভাবনা দেখিয়েছেন তখন তারা কালকে অতিক্রম করে গিয়ে সর্বকালের হয়ে উঠেন।
ফিশারের মতে শিল্পের কাজ মানুষের “আমি” টিকে ধরে নাড়া দেয়া। “আমি” টিকে অন্যের জীবনের সাথে অন্যের জীবনের একাত্মবোধে সম্পর্কিত করার ক্ষেত্রে একটা মাধ্যম হয়ে উঠা। ব্যক্তি নিজে যা নয় কিন্তু হতে স্বক্ষম তাকে সেভাবে তৈরী করে তোলার ক্ষেত্রে সমর্থ করে তোলাই শিল্পের কাজ।
আর্নস্ট ফিশার অস্ট্রিয়ান লেখক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ। তার নেসেসিটি অব আর্ট ইউরোপের শিল্প-সমালোচনা ও নন্দনতত্ত্বের বাইবেল বলে খ্যাত। এই বইটির শিল্পের করণীয় অধ্যায়টির উপর ভিত্তি করে উপরিউক্ত লেখাটি। আমি অনুসরন করেছি শফিকুল ইসলামের করা বাংলা অনুবাদটি। এটি এনা বোস্টককৃত ইংরাজি অনুবাদ থেকে বাংলায় অনূদিত।
It’s the greatest artists (rather than populist artists) who invoke a people, and find they “lack a people”: Mallarme, Rimbaud, Klee, Berg. The Straubs in cinema.
Artists can only invoke a people, their need for one goes to the very heart of what they’re doing, it’s not their job to create one, and they can’t.
Art is resistance: it resists death, slavery, infamy, shame.
Gilles Deleuze, Conversation with Toni Negri Futur Anterieur 1 (Spring 1990), translated by Martin Joughin.