মধ্যরাত এবং আবছা অন্ধকার ঘিরে রেখেছে পরিত্যক্ত বাড়িটাকে। আকাশে অর্ধেক চাঁদ ঝুলে আছে। সেই কারণে অন্ধকারের তীব্রতা অনেক কম। কক্ষটিতে মাথা নিচু করে চেয়ারে বসে ছিল একটি লোক। তার বয়স কত হবে কে জানে। আন্দাজে বলা যায় চল্লিশ। তার সামনে চার পায়ার একটি টেবিল। লোকটি দু হাতে মাথা ধরে বসে ছিল। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না অন্ধকারের কারণে।
এর মধ্যে ধীরে ধীরে হেঁটে প্রবেশ করল আরেকটি লোক। সে লোকটিরও মুখ দেখা গেল না।
চেয়ারে বসা লোকটি ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করল, “নাম কী?”
অপর লোকটি শান্তভাবে বলল, “আব্দুর রহমান।”
“এসেছিস কবে?”
“আজ।”
“কয়টায়?”
“সন্ধ্যার পরে।”
“এতক্ষণ কোথায় ছিলি?”
“লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম।”
“কী করতি তুই?”
“শিক্ষকতা।”
“ভালো। এখানে কিছু নিয়ম কানুন আছে। ইনস্ট্রাক্টররা সব শিখিয়ে দেবে। মেনে চলবি। কোথাও কোন ঝামেলা করবি না। ঝামেলার ফল এখানে খুব ভালো হয় না।”
“জি।”
“কারো প্রতি প্রতিশোধ নেয়ার ইচ্ছা আছে?”
“জি।”
“সে কে?”
“লোকটি মিথ্যা বলে আমার কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়েছিল। ফিরিয়ে দেয় নি। তাই শেষপর্যন্ত আমাকে এখানে আসত হল।”
“ভুলে যা এসব। আর তোর এখানে আসার পিছনে ঐ লোকের টাকা দেয়া না দেয়ার কোন সম্পর্ক নেই। উপর থেকে নির্দেশ না এলে তুই এখানে আসার উপযুক্ত হতি না। যা হওয়ার হয়ে গেছে। ওসব ভুলে যাওয়াই ভালো।”
“কিন্তু…”
“আবার কিন্তু কী? সকল কিছুই খুবই তুচ্ছ তা কি এখনো তুই বুঝতে পারিস নি? আর কবে বুঝবি?”
“কিন্তু সে কী এভাবে আমার টাকা মেরে বেঁচে যাবে? আমার স্ত্রী আছে, ছেলেমেয়ে আছে।”
“বললাম তো এসব চিন্তা বাদ দে। সব ভুলে যা। মনে কর তোর কিছু নেই। কখনো ছিল না। তুই একা লোক। আগেও ছিলি একা, এখনো একা।”
“আমি একাই ছিলাম।”
“সেটা তো জানি আমি। তাই বলছি অন্যদের চিন্তা করা বাদ দে। হিংসা বিদ্বেষ ঘৃণা এসব খারাপ জিনিস। এসব ভুলে যা। প্রতিশোধ নেয়ার চিন্তাও ভুলে যা। ক্ষমা করে দে। এখন ক্ষমা করার সময়।”
“জি।”
“এখানে নতুন পরিবেশে তোর সামান্য অসুবিধা হতে পারে কয়েকদিন। সাহায্যকারীরা আছে, তাদের সাহায্য নিবি প্রয়োজন হলে। তবে কয়েকদিনের মধ্যে আশা করি সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“আমি কী বাইরে যেতে পারব?”
“বাইরে বলতে? তোর বাড়িতে?”
“হ্যা।”
“অসম্ভব। এটা কখনোই হবে না। ওখানে যতবার যাবি ততই তোর গৃহকাতরতা বাড়বে। তুই কিছুই ভুলতে পারবি না। এই ক’দিনই তো অপেক্ষা। পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেয়ার পরপরই তুই কাজে লেগে পড়বি। কাজে লাগার পর ওইসব আর মনে পড়বে না। এমনকী বছর দুয়েক পরে তোর স্ত্রী ছেলেমেয়েকেও চিনবি না তুই।”
“কিন্তু আমি ওদের ভুলে যেতে চাই না।”
“এটাই এখানে কাজ করার নিয়ম।”
চেয়ারে বসা লোকটা হাততালি দিল। দরজা দিয়ে প্রবেশ করল কালো পোষাক পরা আরো দুটি লোক।
চেয়ারে বসা লোকটি বলল, “আব্দুর রহমানকে নিয়ে যা।”
লোক দু’জন আব্দুর রহমানকে দু’দিকে ধরে বাইরে নিয়ে গেল।
চেয়ারে বসা লোকটি আবার হাততালি দিল। এবার প্রবেশ করল কালো পোষাক পরা আরেকটি লোক।
চেয়ারে বসা লোকটি ভাঙা গলায় বলল, “আব্দুর রহমানকে ভালো করে গার্ড দিয়ে রাখবি। ও হিংস্র হয়ে উঠতে পারে। তার জীবন যাপন ছিল নিরীহ। এসব মানুষ এখানে বেশি হিংস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।”
কালো পোষাক পরা লোকটি বলল, “আপনি কোন চিন্তা করবেন না।”
চেয়ারে বসা লোকটি বলল, “আজ কি আর কেউ আসবে?”
কালো পোষাকের লোকটি বলল, “জি স্যার। আরেকজন আসার কথা। হয়ত শেষরাতের দিকে আসবে।”
“মারা গেছে কবে?”
“কাল সকালে।”
“নাম কী তার?”
“মানিক।”
“চিনতে পেরেছি। ও আসলে ভিতরে পাঠিয়ে দিবি। এখন যা তুই।”
“জি স্যার।”
চেয়ারে বসা লোকটি দু হাতে মাথা চেপে বসে রইল। তার শারা শরীর কাঁপতে শুরু করল ধীরে ধীরে। শত শত মৃতদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজ কথা না। এর জন্য অসাধারণ মানসিক ক্ষমতার প্রয়োজন।