ময়নাতদন্তের ব্যাপারটা তো আপনারা জানেন। খবরে বা ফিল্মে প্রায়ই এই শব্দটি দেখা যায়। কোন রহস্যাবৃত মৃত্যু হলে মৃতদেহ পরীক্ষা করে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদঘাটনের যে চেষ্টা করা হয় তার নামই দেয়া হয়েছে ময়না তদন্ত। এই কাজের এমন নাম দেবার কারণ হিসেবে অনেকে বলেন ময়না পাখি গাছের পাতার আড়ালে থেকে বিভিন্ন স্বরে ডাকে, তা কেবল অভিজ্ঞ ব্যক্তিই ধরতে পারেন। এই ধরার জন্য মনযোগ এবং অভিজ্ঞতার দরকার হয়, তা মৃতদেহ পরীক্ষার জন্যও দরকার মৃত্যুর কারণ উদঘাটনের জন্য। সুতরাং, দুইয়ের মিল দেখেই এই নাম।
ময়না শব্দটির দুই বিশেষ্য অর্থ আছে বাংলা অভিধানে। এক, শালিক জাতীয় সুকন্ঠী পাখি বিশেষ। দুই, অষ্টম শতকের রাজা মানিকচন্দ্রের যাদুকরী স্ত্রী ময়নামতীর নাম। তিনি জ্যোতির্বিদ্যা, যোগসাধনায় পারদর্শী একজন রূপবতী ও গুণবতী মহিলা ছিলেন বলেই জনশ্রুতি। তার গণনা করে ভবিষ্যত জানার ক্ষমতা ছিল, এবং এর মাধ্যমেই তিনি জেনেছিলেন তার পুত্র ১৮ বছর বয়েসেই মারা যাবে।
রাজা মানিকচন্দ্রের যাদুকরী স্ত্রী’র নাম থেকেও ময়নাতদন্ত শব্দটি আসতে পারে।
যাইহোক, ময়না তদন্তের ইংরাজি শব্দ পোস্ট মর্টেম, যা করা হয় মৃত্যুর পরে। অর্থাৎ ঘটনা ঘটে যাবার পর।
এই লেখার বিষয় এমন এক ধরনের তদন্ত, যা কাজ ধরনে ময়নাতদন্তের মতোই, কিন্তু করা হবে ঘটনা ঘটার পূর্বে। তাই এর নাম, কোকিল তদন্ত। ইংরাজি প্রিমোর্টেম।
কোন কাজ শুরু করার আগে, আপনি ভেবে নিবেন যে সবচেয়ে খারাপ যা ঘটার তা ঘটে গেছে। ধরা যাক, আপনি একটি কোম্পানি শুরু করতে যাচ্ছেন যা একটি ফুড স্টার্টাপ। আপনার কোম্পানির মোবাইল এপ ব্যবহার করে যে কেউ অর্ডার দিতে পারবে তার পছন্দের রেস্টুরেন্ট থেকে। আর আপনার লোকেরা সে খাবার অর্ডারকারীর ঘরে পৌছে দেবে।
শুরু করার আগে আপনি ভাবলেন, আপনার কোম্পানি মুখ থুবড়ে পড়েছে। মাসে মাসে লস হচ্ছে। এবং কয়েক মাস চলার পরেই বন্ধ হতে বাধ্য হলো।
এটা ভেবে নিয়ে আপনাকে নামতে হবে তদন্তে। প্রশ্ন করবেন নিজেকে কেন এমন হলো? আপনার ম্যানেজমেন্টে কি সমস্যা ছিল? ফাউন্ডারদের মধ্যে কি সমস্যা ছিল? যেখানে শুরু করেছিলেন সেখানে পরিবেশ পরিস্থিতি কি প্রতিকূল ছিল? যাদের কাজে নিয়োগ দিয়েছিলেন তারা কি আপনাকে ডুবিয়েছে? টেক-সাপোর্ট কি আপনারা ভালোমত দিতে পারেন নি?
ইত্যাদি নানা প্রশ্নের মাধ্যমে আপনাকে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এবং শেষমেষ বের করতে হবে আসলে কী কারণে আপনার এই সম্ভাবনাময় কোম্পানির ভরাডুবি হলো?
তদন্তের পর কার্যকারণ যখন আপনি পেয়ে যাবেন তখন শুরু করার আগেই আপনি স্পষ্ট একটা ধারণা পেয়ে যাবেন কীভাবে আপনার নাকানি চুবানি খেতে হতে পারে।
কোন কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট সংস্লিষ্ট কর্মচারীদের নিয়ে গ্রুপ কোকিল তদন্ত করতে পারে। তাতে বিভিন্ন জন বিভিন্ন ভাবে দেখতে পারে, এবং নিজস্ব তদন্তে দেখতে পারে কেন তাদের কোম্পানিটি মারাত্মক ভাবে মুখ থুবড়ে পড়ল বা ভয়ানক ক্ষতির মুখে পড়ল। সাধারণ বা কমন ধারণার বিপরীতে কারো ধারনাতেই আসে নি এমন কিছু ব্যাপারও উঠে আসতে পারে।
যেমন, একটি অভিজাত রেস্টুরেন্ট তাদের গ্রুপ কোকিল তদন্ত শুরু করলো, কেন দুইজন বিদেশী নাগরিকের মৃত্যু হলো আকস্মিক ভাবে তাদের রেস্টুরেন্টে, এবং এর ফলশ্রুতিতে তাদের রেস্টুরেন্ট বন্ধ হলো?
সাধারণভাবেই অনেকে উত্তরে ভাববে, টেরোরিস্ট এট্যাক। যেহেতু এমনই বেশী পত্র পত্রিকায় আসে সাম্প্রতিক কালে।
এই কমন ধারণা যেহেতু সবারই জানা প্রায়, তাই এটা বের করা কোকিল তদন্তের উদ্দেশ্য নয়।
হয়ত একজন অন্য কোন একটা বিষয়ের কথা বললো, যেমন ইলেক্ট্রিক শর্ট সার্কিট দূর্ঘটনাজনিত আগুন লাগা, ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে ঐসব টেকনিক্যাল বিষয় ঠিক করে প্রতিষ্ঠানটি ভবিষ্যতের কোন খারাপ অবস্থা এড়াতে পারে।
কোকিল তদন্ত পদ্বতিটি সহজ এবং তা সহজেই আপনাকে আপনার শুরু করতে যাওয়া কাজটিকে আরো বেশী বুঝতে সাহায্য করবে। যদি সময় নিয়ে ও গুরুত্ব সহকারে এই তদন্ত আপনি চালিয়ে যান তাহলে অতি অবশ্যই নতুন কিছু বুঝতে পারবেন, যা আগে আপনার মাথায় আসে নি।
গবেষনায় দেখা গেছে, “কেন এটি ব্যর্থ হতে পারে এই প্রশ্নের চাইতে ‘কেন এটি ব্যর্থ হয়েছে’ প্রশ্ন করলে মানুষের ক্রিয়েটিভিটি বেশী কাজ করে।”
এজ ডট ওআরজি বিশেষজ্ঞদের জিজ্ঞেস করেছিল কোন বৈজ্ঞানিক বিষয়টি সবার জানা উচিত। ২০৬ জন বিশেষজ্ঞ উত্তর দিয়েছেন। সেখানে প্রিমর্টেম এর কথা বলেছেন বিহেভিওরাল ইকোনমিক্সের (মনস্তাত্ত্বিক অর্থনীতি) একজন ফাদার ফিগার রিচার্ড থ্যালার।
তিনি সেন্টার ফর ডিসিশন রিসার্চ, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব বিজনেসের ডিরেক্টর। লিখেছেন নাজ, মিসবিহেভিং, দ্য উইনার’স কার্স, এডভান্সেস ইন বিহেভিওরাল ফাইনান্স ইত্যাদি বই, যা মনস্তাত্ত্বিক অর্থনীতিতে আগ্রহীদের জন্য গুরুত্বপূর্ন পাঠ্য।
প্রিমর্টেম টার্মটি সম্পর্কে প্রথম বলেছেন এল্পাইড সাইকোলজিস্ট গ্যারী ক্লেইন। গ্যারী ক্লেইনের বই সিয়ীং হোয়াট আদার’স ডোন্ট নিয়ে এই ব্লগে একটি লেখা আছে।
এছাড়াও এই কোকিল তদন্ত বা প্রিমর্টেম নিয়ে লিখেছেন নোবেল বিজয়ী ও মনস্তাত্ত্বিক অর্থনীতির আরেক ফাদার ফিগার ড্যানিয়েল কায়নেম্যান।
রিচার্ড থ্যালার বলেছেন, কীভাবে আমরা হারলাম? এই প্রশ্নটি যদি করত কেউ, তাহলে অনেক যুদ্ধই হত না।
একইভাবে বলা যায়, ধরা যাক একজন ব্যক্তি জীবন যাপন করছেন। তিনি তার জীবন নিয়েই এক কোকিল তদন্ত শুরু করলেন। তিনি ভাবলেন, তিনি মারা গেছেন এবং সমস্ত লোকেরা বলছে, যাক চুদির ভাই মারা গেছে, একটা কুলাঙ্গার কমল ধরা থেকে। কেন? তিনি তার জীবনে এমন কী করেছিলেন যার জন্য মরার পর সবার গালি শুনতে হচ্ছে?