প্রারম্ভঃ
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বিষয়ে সবচেয়ে বিখ্যাত দু’টি বই আহমদ ছফার “যদ্যপি আমার গুরু” এবং সরদার ফজলুল করিমের সাথে আব্দুর রাজ্জাকের আলাপচারিতা ভিত্তিক “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ”।
এছাড়াও, আব্দুর রাজ্জাক সম্পর্কে আরো জানার উপায় বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত “জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক স্মারক গ্রন্থ”। সেখানে এই জ্ঞানান্বেষী শিক্ষককে নিয়ে তার ছাত্র এবং পরিচিতদের লেখা সংকলিত হয়েছে। আছে হুমায়ূন আজাদের নেয়া একটি স্বাক্ষাৎকারও।
এই স্বাক্ষাৎকারটি হুমায়ুন আজাদ শুরু করেছেন অপূর্ব ভাষা ভঙ্গিমায়। তুলে ধরছি শুরুর অংশঃ
আমাদের দেশটি ছোটো, আর এর মানুষরাও বেশ ক্ষুদ্র। প্রথাগত ভুয়োদর্শন আমাদের উপদেশ দেয় বেশি না বাড়ার, বেশি উঁচু না হওয়ার। বেশি বৃদ্ধি পেলে ক্রুদ্ধ ঝড়ে ভেঙে পড়ার ভয় আছে। আমাদের প্রকৃতি ও মানুষ যেনো এ-ভয়ে আতংকিত; তাই অভাব এখানে আকাশ-ছোঁয়া বৃক্ষের, দুর্লভ এখানে মহৎ ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব। মাঝারি, নিম্নমাঝারি ও নিম্ন আকারের ব্যক্তি ও বৃক্ষে পূর্ণ আমাদের লোকালয় ও অরণ্য।
কাউকে পাওয়া খুব কঠিন পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলে, যিনি আয় করেছেন মহত্ত্ব, অর্জনে বা ত্যাগে হয়ে উঠেছেন অসাধারণ, এক রকম বিস্ময় ও কিংবদন্তি। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক আমাদের এই সময়ের সে-অনন্য পুরুষ, যাঁকে ঘিরে কয়েকদশক ধ’রে জড়ো হয়েছে নানা রহস্য; পরিণত হয়েছেন যিনি জীবিত উপকথা বা কিংবদন্তিতে। ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর বহুমুখি পাণ্ডিত্যের নানা গল্প, জীবনের অসংখ্য উপাখ্যান। শারীরিক সৌন্দর্যে দেবতুল্য নন তিনি যে তাঁকে দেখেই দর্শক ভক্ত হয়ে উঠবে; বাগ্মীও নন তিনি যে শ্রোতা তাঁর বাণী আস্বাদ ক’রে স্পর্শ পাবে অমৃতের। মোটা মোটা বই লিখেননি অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, অলংকৃত করেননি জ্যোতির্ময় বিভিন্ন আসন; এমনকি নিজের নামের সঙ্গে তিন অক্ষরের একটি উপাধিও যুক্ত করেননি তিনি। তবু তিনিই হয়ে উঠেছেন আমাদের সাম্প্রতিক জ্ঞানজগতের কিংবদন্তি। এর মূলে আছে সম্ভবত দুটি সহজ কিন্তু অসাধারণ কারণ : প্রাচীন ঋষিদের মতো তিনি নিজের দীর্ঘ ও সমগ্র জীবন ব্যয় করেছেন জ্ঞান আহরণে, এবং ঋষিদের মতোই তিনি অবলীলায় অবহেলা ক’রে গেছেন পার্থিব সাফল্য। জ্ঞানের জন্যে এমন তপস্যা-জীবন, সংসার, সাফল্যের কথা ভুলে – এখন দুর্লভ ব্যাপার; আর তাই রূপ লাভ করতে দেখি জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মধ্যে। শুধুই জ্ঞানের জন্যে সব ত্যাগ ক’রে তিনি হয়ে উঠেছেন এই সময়ের জ্ঞানতাপস।
জন্ম, মৃত্যু ও শিক্ষকতাঃ
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক জন্ম নিয়েছিলেন ১৯১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর, মতান্তরে ১৯১২ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ১৯৩৮ সালের ৩১ তারিখে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ী প্রভাষক হিসেবে পলিটিক্যাল সাইন্স বিভাগে যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন প্রায় পাঁচ দশক। ১৯৯৯ সালের ২৮ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
জ্ঞানসাধনাঃ
তিনি বিখ্যাত অধ্যাপক হ্যারল্ড লাস্কির অধীনে পিএইচডি করতে গিয়েছিলেন লন্ডনে। পাঁচ বছর গবেষনা করেন। বিষয় ছিল ভারতের রাজনৈতিক দল। লাস্কি মারা গেলে তিনি তাঁর পিএইচডি থিসিস জমা না দিয়েই, অনেক বইটই নিয়ে দেশে ফিরে আসেন।
নির্ভেজাল জ্ঞানানুসন্ধানের জন্য জ্ঞানচর্চার কথা তিনি বলতেন। জ্ঞানচর্চাই ছিল তার জীবনের লক্ষ্য এমন মত অনেকের। স্মারক গ্রন্থে মনসুর মুসা লিখেন, ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসারের সত্য অনুসন্ধানের তিনটি উপায় স্বীকৃত। এক– ভক্তিমার্গ, দুই-জ্ঞানমার্গ, তিন-কর্মমার্গ। আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন জ্ঞানমার্গের সাধক।
অধ্যাপক রাজ্জাককে নিয়ে লেখা তিনটি বই পড়ে তাঁর যে জ্ঞানসাধনা ও জীবনাচারের পরিচয় মেলে তাঁর সাথে প্রাচীন গ্রীসের স্টোয়িক দার্শনিকদের মিল পেতে পারেন কেউ। তাঁর শিষ্য আহমদ ছফা ব্রাত্য রাইসু ও সাজ্জাদ শরিফের সাথে এক স্বাক্ষাৎকারে বলেন, “রাজ্জাক সাহেবের একটা স্টোয়িক ব্যাপার-সেপার আছে, স্টোয়িসিজম আছে তাঁর মধ্যে।” তিনি কথাবার্তার মাধ্যমে তাঁর জ্ঞানালাপ চালিয়ে যেতেন বলে অনেকে তাঁকে এদিক থেকে সক্রেটিসীয় পদ্বতির জ্ঞানসাধক ভাবেন।
তাঁকে অনেকে বলে থাকেন স্বাধীন বাংলাদেশের তাত্ত্বিক রূপকার। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য তিনিই নজরে আনেন সবার, এবং এ থেকেই দুই অর্থনীতি তত্ত্ব, ছয়দফা ইত্যাদির জন্ম। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক বানান।
আব্দুর রাজ্জাকের পান্ডিত্যের জন্য দেশ বিদেশের নানা গুণীজন তার দিকে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ডিক উইলসন তাঁকে বই উৎসর্গ করেছিলেন, খুশবন্ত সিং লিখেছিলেন তাঁকে নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসে বা দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছিল সম্মানসূচক ডি লিট ডিগ্রী। এছাড়াও উনাকে নিয়ে নানা গল্প আছে, সেসবের বর্ননা তাঁকে নিয়ে লিখিত দুই বই, ও স্মারক গ্রন্থে মিলবে। যদিও ঐ কাহিনীগুলি মজার, তবুও এখানে এগুলো উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন। এখানে আব্দুর রাজ্জাকের বই পড়া এবং জ্ঞানান্বেষনের কিছু প্রক্রিয়া নিয়ে জানা যেতে পারে, যা মনে রাখলে আমাদের জ্ঞানার্জনে সুবিধা হবে বলে আমার মনে হয়।
এই মডেলগুলির নাম আব্দুর রাজ্জাক বই পড়া নকশা দেয়া যায়।
নকশা বা মডেল- একঃ বই পড়া তথ্য যাচাইয়ের অনন্ত প্রক্রিয়া
মনসুর মুসা লিখেন, “তাঁর বই-পড়া ছিল তথ্য-যাচাইয়ের এক অনন্ত প্রক্রিয়া। একটি বই পড়তে বসে, সে বইয়ে উল্লিখিত সূত্র পরীক্ষা করার জন্য আরো পাঁচটি বই দেখতেন, সে পাঁচটি বইয়ের মনোভঙ্গি উপলব্ধি করার জন্য আরো পনেরোটি বই সংগ্রহ করে আনতেন, আবার সেই পনেরোটি বইয়ের সীমাবদ্বতা উপলব্ধির জন্য বিভিন্ন গোপনসূত্রে সংরক্ষিত দলিলপত্র পরীক্ষা করতেন।”
আমরা বেশীরভাগ সময়েই এক বই পড়েই জেনে ফেলেছি ভেবে বসে থাকি। এতে ঐ বিষয়ে আমাদের জানা তো হয়ই না, বরং অতি-আত্মবিশ্বাস তৈরী হয় এবং তা পরবর্তী জানার পথ বন্ধ করে দেয়। এক্ষেত্রে আব্দুর রাজ্জাকের মত খোলা মন নিয়ে তথ্য যাচাইয়ের মানসিকতা নিয়ে পড়তে থাকলে, এই দৃষ্টিভঙ্গী তৈরী করতে পারলে, জ্ঞানান্বেষন অধিকতর কার্যকরী হবে।
নকশা বা মডেল- দুইঃ যেকোন বই পড়া যায়
এ জেড এম আব্দুল আলী লিখেছেন, একদিন আমার হাতে পিজি উডহাউসের একটি বই দেখে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কী পড়েন ওইটা?’ আমি অপরাধীর সুরে বইয়ের এবং লেখকের নামটি বলাতে বললেন, ‘দেখি বইটা।’ হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে বললেন, “আমি বোধকরি পড়ি নাই। আপনার পড়া হইলে দিয়েন আমারে পড়তে।” স্যারের মত লোক, যাঁর শেলফে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকারই সম্ভবত পাঁচ সাতটি সংস্করণ রয়েছে তিনি পিজি উডহাউসের বই পড়েন এ-কথা বিশ্বাস করতে সেদিন একটু অসুবিধাই হয়েছিল আমার।
এছাড়া আরেকটি লেখায় দেখা যায় আগাথা ক্রিস্ট্রির লেখাও তিনি পড়তেন। অন্য বই পড়তে পড়তে বিরক্তি এলে পড়তেন পরশুরামের কোন একটা গল্প।
অর্থাৎ, এত এত সিরিয়াস বই পড়তে পড়তেও আব্দুর রাজ্জাক নাক উঁচা পাঠক হয়ে উঠেন নি। তিনি জনপ্রিয় রম্য বা থ্রিলার বা হুমায়ূন উপন্যাস পড়তেন। ফলে, যারা অন্য সিরিয়াস বইদের সাথে সাথে রম্য, থ্রিলার বা অন্য জনপ্রিয় উপন্যাস পড়ে থাকেন, তাদের হীনম্মন্যতায় ভোগার কারণ নেই।
নকশা বা মডেল-তিনঃ পড়ার জন্য পড়া নয়
মুজাফফর আহমদ চৌধুরী রাজ্জাক সাহেবের প্রিয় ছাত্র ছিলেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছিলেন। ইনি প্রচুর পড়তেন, অধিকাংশ সময়ই লাইব্রেরীতে কাটাতেন। একদিন আব্দুর রাজ্জাক তাঁকে বলেন, “আপনারা যে এত সোশ্যাল সায়েন্স পড়েন, হিউম্যানিটিজের কিছু আয়ত্তে না থাকল তা অপূর্ণই থেকে যায়।”
মুজাফফর আহমদ জানতে চান কী পড়বেন।
রাজ্জাক সাহেব বলেন, “শেক্সপিয়র দিয়েই শুরু করেন।”
লাইব্রেরি থেকে শেক্সপিয়র রচনাসমগ্র নিয়ে দুদিন পর মুজাফফর আহমদ তাঁর স্যার আব্দুর রাজ্জাককে জিজ্ঞেস করলেন, “শেক্সপিয়র পড়ে ফেলেছি-এবার কী পড়বো?”
অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মুজাফফর আহমদের দিকে তাকিয়ে থেকে আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “থাক, ওতেই চলবে।”
এই ঘটনাটি স্মারক গ্রন্থে আনিসুজ্জামান এবং মুনতাসীর মামুন এর লেখায় আছে।
মুজাফফর আহমদ পড়ুয়া লোক ছিলেন। কিন্তু, এই ধরনের পড়া অনেক ক্ষেত্রেই অকার্যকর। শেক্সপিয়র দুই দিনে পড়া, এবং কেবল পড়ে শেষ করার মত বিষয় নয়। বিভিন্ন ফেইসবুক বইয়ের গ্রুপে কত বেশী বই শেষ করেছি এই মাসে, ইত্যাদি লিস্ট দেখা যায়। কিন্তু এগুলি অর্থহীন কারণ বেশী বই শেষ করাই বই পড়ার উদ্দেশ্য না। বই পড়ে কী জানলেন, কী ইনসাইট পেলেন, কয়টা নতুন বিষয়ে আগ্রহী হলেন, দৃষ্টিভঙ্গী কেমন পালটালো, পুরনো কোন ধারণা বদলে গেল কি না, জীবন ও জগতরে আরেকটু ভালো ভাবে বুঝতে পারলেন কি না বা বুঝার দিকে গেলেন কি না ইত্যাদি বিবেচ্য। তা একটি বই হলেও, এক মাস বা দুই মাস বা তারো বেশী সময় লাগিয়ে পড়লেও তাতে কোন আপত্তি নেই। এখানে দ্রুত শেষ করতে হবে, বেশী শেষ করতে হবে, বা শেষ করতেই হবে; এমন কোন কথা নেই।
উপসংহারঃ
মীজানুর রহমান শেলী লিখেছেন, গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর শিক্ষা দর্শনের বিশ্বস্ত অনুসারী ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। তিনি মনে করতেন শিক্ষা কেবলমাত্র যান্ত্রিক কোন প্রক্রিয়া নয়। শুধু তত্ত্ব উপাত্ত দিয়ে শিক্ষার্থীর মনের ভার বাড়ানোকে শিক্ষা বলে না। শিক্ষার কাজ হচ্ছে একটি প্রক্রিয়ার সূচনা করা, যা শিক্ষার্থীকে ক্রমাগত জ্ঞানের দিকে ধাবিত করে, মানুষের ভেতরে জানার যে চোখ আছে তাঁকে জ্ঞানের দিকে ফেরায়। আমাদের বই পড়ার উদ্দেশ্য এমন হতে পারে।
সংযুক্তিঃ হুমায়ূন আজাদের নেয়া সাক্ষাৎকারটি অনলাইনে আছে। লিংক – এই সময়ের জ্ঞানতাপস।