ইন্ডিয়ান তামিল-ভাষীয় ফিল্ম ভিক্রাম-ভেধা (২০১৭) যে গল্প বলে, তা একেবারেই নতুন নয়। এই ধরনের ক্রাইম থ্রিলার আরো হয়েছে। বলা যায় পুলিশ এবং ক্রিমিনাল ফাইটের এমন ক্রাইম থ্রিলারগুলির গল্প বেশীরভাগই এমন হয়। কিন্তু ভিক্রাম-ভেধার বিশেষত্বটা হলো তার গল্প বলার স্টাইল বা ধরণ, এর কারণেই ফিল্মটি বিশেষত বিশেষ হয়ে উঠে।
ভিক্রাম-ভেধা’র গল্প বলা হয়েছে বেতাল পঁচিশির/পঞ্চবিংশতির ধরনে। যা অভিনব। বেতাল পঁচিশির গল্প বহু পুরানো। রাজা বিক্রমাদিত্য একজন তান্ত্রিকের কথায় গিয়েছিলেন বেতাল নামক এক অদ্ভুত জীবকে ধরে আনতে। বেতালকে ধরে আনার সময় তিনি নানা বাঁধার সম্মুখীন হন। বেতাল তাকে নিম্নরূপ শর্ত দেয়,
সে একটি গল্প বলবে, গল্পের শেষে থাকবে একটি ধাঁধার মত প্রশ্ন। রাজা বিক্রমাদিত্য এই প্রশ্নের ভুল উত্তর দিলে বেতাল তার সাথে যাবে। ঠিক উত্তর দিলে বেতাল গিয়ে আবার গাছে চড়বে। আর উত্তর জেনেও যদি রাজা চুপ থাকেন তাহলে তার মাথা ফেটে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।
এইভাবে বেতাল রাজাকে গল্প বলতে থাকে। চব্বিশবারই রাজা ঠিক উত্তর দেন এবং বেতাল গিয়ে গাছে চড়ে। পঁচিশতম গল্পটা ছিল এমন,
এক ভয়াবহ দূর্যোগের পর এক রাজা ও তার পুত্র জঙ্গলে পেলেন এক রানী ও রাজকন্যাকে। রাজা রাজকন্যাকে বিয়ে করলেন, রাজার পুত্র বিয়ে করল রানীকে। তাদের সন্তান হল। রাজপুত্র ও রানীর এক ছেলে, এবং রাজা ও রাজকন্যার এক মেয়ে। এখন বলতে হবে এই বাচ্চাদের পরস্পরের সাথে কী সম্পর্ক?
রাজা বিক্রমাদিত্য এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন নি। ফলে শর্ত অনুযায়ী বেতাল তার সাথে যেতে সম্মত হয়। পথে যেতে যেতে বিক্রমাদিত্যকে বেতাল তার নিজের জীবনের গল্প বলে। গল্প বলতে বলতে যে তান্ত্রিক বিক্রমাদিত্যকে পাঠিয়েছে তার সম্পর্কেও সত্যটা বলে বেতাল, এবং বিক্রমাদিত্যকে পরামর্শ দেয়। বিক্রমাদিত্য তার পরামর্শ মেনে নেন, ও সফল হন।
বিক্রাম ভেধা’র গল্পে, বিক্রাম একজন সৎ, আগ্রাসী পুলিশ অফিসার। এবং ভেধা একজন গ্যাংস্টার। ভেধাকে ধরতে একশনে নেমেছেন পুলিশ অফিসার ভিক্রাম তার দলবল নিয়ে। তারা এনকাউন্টারে মারতে থাকেন ভেধার লোকদের।
কিন্তু একসময় ভেধা নিজে এসেই ধরা দেয়। এবং ভিক্রামকে তার গল্প বলে। বেতালের গল্পের মত তার গল্পের শেষেও নৈতিক সমস্যাযুক্ত প্রশ্ন থাকে। এই সব গল্পে, প্রশ্নে, এই নৈতিক প্রশ্নটিও সামনে আসে যে পুলিশ হয়ে ভিক্রাম যে এনকাউন্টারে খুন করে যাচ্ছেন তার সাথে ক্রিমিনালের খুনের পার্থক্য কোথায়? গুড গাই এবং ব্যাড গাই এর মাঝখানের দাগ টানা সীমারেখা উলট পালট করে দিতে চায় ভেধা, তার গল্পের মাধ্যমে।
বেতালের গল্প শুনে রাজা বিক্রমাদিত্য জানতে পেরেছিলেন, যে তান্ত্রিকের কথায় তিনি বেতালকে ধরতে এসেছেন সে নিজেই ভয়ংকর যাদুকর। সে বেতাল এবং তাকে বলি দিয়ে বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত হতে চায়। একইভাবে ভেধার গল্পে পুলিশ অফিসার বিক্রম গ্যাংস্টার ভেধাকে ধরার পুলিশি মিশন সম্পর্কে নতুন কিছু জানতে পারে, যা তার পুরানো জানাকে ভেঙ্গে দেয়।
ফিল্মটি একশন ধর্মী, সাথে এইসব ধাঁধা এবং গল্প একে ভিন্নরূপ দিয়েছে। ভেধার গল্পের মাধ্যমে নতুন নতুন বিষয় দর্শকেরাও জানতে পারেন ভিক্রামের সাথে সাথে। আমরা শুধু আমাদের জানা গল্পের লেন্সেই দুনিয়া দেখতে চাই, কিন্তু এক গল্পের বাইরেও গল্প থাকে, এবং সেইসব গল্প ও সকল অবস্থা বিবেচনা করলে সহজে “ভালো” এবং “মন্দের” বিভাজন টানা সহজ হয় না; এই জটিলতাই বুঝাতে চায় গ্যাংস্টার ভেধার গল্পগুলি বা এই ফিল্ম।
ভিক্রাম চরিত্রে অভিনয় করেছেন আর মাধাবান। ভেধা চরিত্রে ভিজয় সেথুপাথি। লিখেছেন এবং পরিচালনা করেছেন পুষ্কার-গায়ত্রী দম্পতি। তারা এক নায়ক বা হিরো ওরিয়েন্টেড ফিল্ম এড়িয়ে চলেন লেখা-নির্মান এর ক্ষেত্রে এবং তাদের মতে ভিক্রাম-ভেধা হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ।