সাত আট বছর আগে হুমায়ূনই পড়া হইত বেশী। এর এক কারণ ছিল বন্ধুদের সবাই তার বই পড়ত। তখন আমি আলীজ কেয়ারে থাকি ও ক্যান্ট পাবলিকে পড়ি। আমার বন্ধু পলাশ হুমায়ূনের বড় ভক্ত ছিল। তার কাছে নতুন বই টই পাওয়া যাইত।
এরপর তো অনেক দিন গেল, অনেক অনেক দিন। হুমায়ূন আহমেদ মারা গেলেন ১৯ জুলাই ২০১২ তে। তাহিয়ান পল এর আগেই অবশ্য দেশ ছাড়ছে, ছেলে থেকে মেয়ে হইছে, আর এইদিকে আমিও লেখক হইয়া উঠছি । এই হইয়া উঠা প্রক্রিয়াটা কখনো শেষ হবে কি না তা জানি না, তবে লেখক হওয়ার প্রক্রিয়ার ভেতরে ঢুকে পড়াটা ছিল বিস্ময়কর এবং অদ্ভুত। যেমন পলাশের মাইয়া হইয়া যাওয়াটাও। তবে যাই হোক, এটাই বাস্তবতা, আমরা সবাই কালের বিবর্তনে বিভিন্ন কিছু হইয়া উঠি বা উঠার প্রক্রিয়ার মধ্যে পইড়া যাই।
অনেক দিন পর হুমায়ূনের আরেকটি উপন্যাস আমি এক কয়েক মাস আগে পড়লাম। রজনী নামের ক্ষুদ্র একটি উপন্যাস। বহু পুরানা, ১৯৮৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এই বইখানা পড়ার পর হুমায়ূনের অন্য একটা রূপ আমার সামনে উইঠা আসল যেন। যা নিয়াই মূলত এই লেখা। আমি হুমায়ূন সাহিত্যের কিছু লেয়ার আপনাদের দেখাইতে চাই বা কিছু লেয়ারের নিচের অন্য কিছু লেয়ার আপনাদের সামনে আনার চেষ্টা করব।
হুমায়ূন সাহিত্য সম্পর্কে তার ভক্তদের এক ধরনের মত আছে, যা তার ক্রিটিকদের মতের সাথে খুব একটা ব্যতিক্রম নয়। যেমন, হুমায়ূন সাহিত্যরে হালকা মনে করেন কতিপয় ক্রিটিক, পাঠকেরাও তাই ভাবেন। ভাবেন যে হাস্যরস পূর্ন, বিনোদন নির্ভর লেখালেখি এইগুলা সব।
হুমায়ূন প্রচুর লেখছেন। আমাদের সাহিত্যের এইটা এক বাস্তবতা। প্রায় লেখকই প্রচুর লিখে থাকেন। এর একটা বড় কারণ অর্থনৈতিক বলে আমি মনে করি। তো প্রচুর লেখা হইলে কিছু কাহিনী বার বার ফিরে আসবে, কিছু লেখা বাজে হবে। স্বাভাবিক বিষয়ই এইটা। আকিরা কুরোসাওয়া পাঁচশ ফিল্ম বানাইলে সব মাস্টারপিস হইত কি?
এই বাস্তবতা মাথা রাইখা হুমায়ূন সাহিত্য বিচার করতে পারলে ভালো। বোর্হেসের কথা আমার ভালো লাগে, তিনি বলছিলেন, একজন লেখকরে বিচার করা উচিত তার সেরাসব লেখা দিয়া। এ রাইটার শ্যুড ওলওয়েজ বি জাজড বাই হিজ বেস্ট পেইজেস।
রজনী হুমায়ূন আহমেদের সেরা লেখা বলে কোথাও কেউ উল্লেখ করেছেন বলে দেখি নাই, তবে আমি মনে করি এই লেখা তার সেরার কাতারে ফেলা যায় এবং এর মাধ্যমে আমরা তার সাহিত্য বিচারে যাইতে পারি।
এর কাহিনী শুরু হয়েছে চিরাচরিত হুমায়ূনীয় স্টাইলে। বাবা কাশছেন, মনে হচ্ছে এই কাশিতেই তার জান যাবে আর মটকা মেরে পইড়া আছে বীরু। বীরুর জবানেই আমরা পুরা গল্পটা পাই।
বীরুদের ফ্যামিলি টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত। তার দাদা অবস্থাপন্ন ছিলেন। কিন্তু বাবা কয়েকটি ডিগ্রী বাগিয়ে সাহিত্য সৃষ্টিতে মন দেন, আয় রোজগারের দিকে তার কোন লক্ষ্য ছিল না। তার উপর তিনি একটি তেরো বছরের মেয়েকে বিয়ে করেন। যখন তার নিজের বয়স ত্রিশ।
বাপের মৃত্যুর পর জায়গা জমি যা পাইছিলেন তার সবই বীরুর বাবা উড়াইয়া দেন এবং তিনটি ছেলেমেয়ের জন্ম দেন। তিনি এখন একটি ইন্সুরেন্সের ক্যাশিয়ার। তার সাহিত্য প্রতিভা একেবারে শেষ হয়ে যায় নাই। পত্রিকায় নানাবিদ চিঠি লেখেন শহরের সমস্যা নিয়া। সম্প্রতি লিখেছেন ঢাকা শহরের মশা বিষয়ে। হুমায়ূনের লেখায়, বীরুর বয়ানেঃ
“চিঠির বিষয়বস্তু হচ্ছে ঢাকা শহরে মশার উপদ্রব। কঠিন ভাষা। ভাগ্যিস মশারা পড়তে জানেনা। জানলে এই চিঠি পড়েই তাদের আক্কেল গুরুম হয়ে যেত।”
মশার এই বাস্তবতা আমরা এখনো দেখতে পাই। দেখেন এই জায়গায় হুমায়ূন মজা কইরা লেখছেন কিন্তু। ফান করছে বীরু তার বাবার সাহিত্য প্রতিভা নিয়া। কিন্তু আলটিমেটলী এইখানে হুমায়ূন ফানের মাধ্যমে ঢাকা শহরের মশা সমস্যা তুইলা ধরছেন। কয়দিন পর পর ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার বাস্তবতায় এ সমস্যা খুব ছোট কিছু নয়।
এটাই হুমায়ূন সাহিত্যের ফান লেয়ারের নিচের লেয়ার।
আরেকটি অংশে যাই যেখানে বীরু তার মায়ের কর্ম অপটুতা নিয়ে ফান করছে। তার মা কোন কাজই পারেন না ভালোমত। চাও বানাতে পারেন না, বানাইলে বিশ্রী হয়। তো একবার তিনি সূচিকর্মে আগ্রহী হইয়া একটা তাজমহল বানাইলেন। সেটা ঘরে ঝুলাইয়া রাখলেন বীরুর বাবারে অবাক কইরা দেয়ার জন্য। কিন্তু সেইটা হইছিল একটি অদ্ভুত বস্তুবিশেষ ফলে বীরুর বাবা অবাক না হইয়া বস্তুখানা নামাইতে বলেন। বীরুর জবানে হুমায়ূন লেখেনঃ
“তাজমহল অবশ্যি নামানো হল না। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল এই দুই কবির মাঝখানে তাজমহল হাইফেনের মত বসে রইল। এখনো আছে তবে রবীন্দ্রনাথের ছবিটা নেই। একাত্তুরের যুদ্ধের সময় বাবা রবীন্দ্রনাথকে বিসর্জন দেন।”
রবীন্দ্রনাথ বিদ্বেষ পাকিস্তানিদের এক প্রধান বিষয় ছিল এবং রবীন্দ্রনাথকে একসময় নিষিদ্ধও করেছিল পাকিস্তানিরা। যুদ্ধের সময়ের সেই রবীন্দ্র বিদ্বেষী বাস্তবতা হুমায়ূন এখানে আনছেন অন্য একটি বিষয়ে ফানের মাধ্যমে।
যুদ্ধের সময় সংখ্যালঘু হিন্দুদের অবস্থার এক চিত্র আমরা পাই বীরুর বর্ননায় ডাক্তার ধীরেন কাকু নিয়া তার কথাবার্তায়। এই ধীরেন কাকু ক্যারেক্টারটি খুবই অল্প আছে উপন্যাসে, দুয়েকখানা ডায়লগ আছে তার মুখে। কিন্তু তার বিষয়ে বলতে গিয়া বীরু আমাদের সংখ্যালঘু হিন্দুদের এবং দুনিয়ার তাবত সংখ্যালঘুর কিছু গভীর সমস্যা দেখাইয়া দেয়। যেমনঃ
“উনিশ’শ একাত্তুরে ধীরেন কাকুকে মিলিটারীরা ধরে নিয়ে গেল। তখন আমাদের পাড়ার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হাজি আবদুল কাদের তাকে অনেক ঝামেলা করে ছুটিয়ে নিয়ে এলেন। এবং এক শুক্রবারে হাজি আবদুল কাদের ধীরেন কাকুকে মুসলমান বানিয়ে ফেললেন। নতুন মুসলমান ধীরেন কাকুর নাম হল মোহাম্মদ সুলায়মান। তিনি দাড়ি রাখলেন। চোখে সুরমা দেয়া শিখলেন। মসজিদে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়তে লাগলেন। একদিন বেশ ঘটা করে বাজার থেকে গরুর গোশত কিনে আনলেন। শান্তি কমিটির একটা মিছিল বের হল। সেখানেও টুপী মাথায় তাঁকে দেখা গেল। দেশ স্বাধীন হবার পর ধীরেন কাকু আবার হিন্দু হয়ে গেলেন। তবে দাড়ি ফেললেন না। দাড়িতে তাকে বেশ ভালো মানায়, কেমন ঋষি ঋষি লাগে।”
মুক্তিযুদ্ধের কালে সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মের লোকদের অসহায়তা এখানে হুমায়ূন তুলে আনছেন, আবার ভিন্ন এক গল্প আনছেন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের। সে কিন্তু ধীরেন কাকুরে বাঁচাইছে, আবার ধর্মান্তরিতও করছে। অর্থাৎ, চিরাচরিত ন্যারেটিভের বাইরেও যে জটিলতা ছিল বাস্তবে, তাই এখানে আছে।
কিছু নিম্ন মধ্যবিত্ত হিন্দুদের অবস্থার একটা চিত্র আমরা একটু ভিন্ন ভাবে পাই হুমায়ূনের এই ন্যারেটিভে, যখন তিনি ১৯৬৫ এর ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং তৎপরবর্তী সময়ে ধীরেন কাকুর অবস্থার এক চিত্র তুলে ধরেন আমাদের সামনে। বীরুর জবানিতেঃ
“ডাক্তার হচ্ছেন আমাদের ধীরেন কাকু। দীর্ঘদিন এই পাড়ায় আছেন। উনিশশ পয়ষট্টি সনে পাক-ভারত যুদ্ধের পর দলবল নিয়ে কোলকাতায় পালিয়ে গিয়েছিলেন। সুবিধা করতে না পেরে আবার ফিরে এসেছেন। এখানেও সুবিধা করতে পারেন নি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকদের সমস্ত দূর্বলতা ধীরেন কাকুর আছে। তিনি আশপাশের সবাইকে খুশী রাখতে চান। বেশীর ভাগ সময়ই ভিজিট নেন না। ভিজিট দিতে গেলে তেলে তেলে একটা হাসি দিয়ে বলেন, আরে আপনার কাছে ভিজিট কি নেব? ভাই ভাই হিসেবে বাস করছি, কি বলেন? ঠিক না? আপনার বিপদে আমি আপনাকে দেখব, আমার বিপদে আপনি দেখবেন আমাকে। হা হা হা।”
ধীরেন কাকুর এই নিরাপত্তাহীনতা যুদ্ধের পরেও। গল্পে এই চরিত্রটি খুবই নিরীহ এবং অল্প সময়ের জন্য। কিন্তু তার অবস্থার বর্ননার ভেতর দিয়ে হুমায়ূন আমাদের দেখিয়ে দিলেন তার এক ধরনের ভীতিপূর্ন জীবন যাপন। কেন আমরা যুদ্ধের পরেও সংখ্যালঘু নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলাম না, ইত্যাদি সরাসরি প্রশ্ন তিনি তুলেন নাই। কিন্তু পরোক্ষভাবে ঠিকই দেখাইয়া দিছেন। এবং যথার্থ শিল্পীর মত কোন সমাধানে যান নাই।
এই সমাধানে না যাওয়া ও সরাসরি প্রশ্ন না তোলায় অনেকে তাকে মনে করেন প্রশ্নহীন লেখক! কিন্তু তা হুমায়ূনের সমস্যা নয়, সমস্যা ক্রিটিকের, যিনি হুমায়ূন সাহিত্যে উত্থিত প্রশ্নগুলি দেখেন নাই।
সংখ্যালঘু ধীরেন কাকুর বর্ননায় হুমায়ূন যখন দেখান, “ভাই ভাই হিসেবে বাস করছি, কি বলেন? ঠিক না? আপনার বিপদে আমি আপনাকে দেখব, আমার বিপদে আপনি দেখবেন আমাকে। হা হা হা।”—এই অবস্থা কিন্তু একজন সংখ্যালঘুর জন্য খুবই মারাত্মক বাজে অবস্থা। তাকে এইভাবে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে, বা সামাজিক প্রেশারের কারণে ভয় পাচ্ছেন। হয়ত তিনি দাড়ি ফেলে দেন নাই এইজন্য। সংখ্যালঘুরে পরোক্ষ প্রেসারে রেখে এই ধরনের অতি সহযোগীতামূলক অবস্থানে থাকতে বাধ্য করা এক ধরনের সামাজিক নির্যাতন।
যদি কোন কলকাতার মুসলিমরে এইভাবে পরোক্ষ প্রেসার দিয়া পূজায় সহায়তা করানি হয়, এবং এই সহযোগীতারে উদার ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশ হিসাবে দেখানি হয়; বা বাংলাদেশে যদি কোন হিন্দুরে ধীরেন কাকুর মত রাখা হয়, বা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বইলা গরুর মাংস খাইতে বা কোরবানি দেখতে বাধ্য করা হয়; এগুলি সবই হবে সামাজিক অন্যায়।
আরেকটা প্রশ্ন আছে এই উপন্যাসে, বেশ বড় প্রশ্নই যে, গনপিটুনী নামক অসভ্য বর্বর জিনিসটা আমাদের সমাজে প্রশ্রয় দেয়া হইতেছে, এবং এর ফল হবে ভয়াবহ। নিচের ছবিতে বিষয়টা আছেঃ
হুমায়ূন যে এইরূপে হালকা চালে প্রশ্ন করছেন, তাতে কাজ কী হইছে তা জানি না। তার পাঠকেরা এইগুলারে নিছক মজা হিসেবে নিলেও তা হুমায়ূন আহমেদের দোষ বলা যায় না। স্যাটায়ারিক স্টাইলে হইলেও সামাজিক প্রশ্ন তিনি তুলে গেছেন, হয়ত রাষ্ট্র কাঠামো বিষয়ক প্রশ্ন তুলেন নাই। কিংবা যেসব সামাজিক প্রশ্ন তুলছেন সেইগুলাও আর বিস্তারিত দেখান নাই, কিন্তু তবুও বলা যায় না হুমায়ূনে প্রশ্ন নাই অথবা প্রশ্নহীন লেখক হুমায়ূন।
–
লেখা হইছে, জুলাই ১৯ তারিখ, ২০১৭ এবং ৩ অক্টোবর ২০১৭।