ধরেন আপনি একজন সিভিল এঞ্জিনিয়ার। এঞ্জিনিয়ারিং কাজ করেন। সাহিত্যও করেন, ফিকশন লেখেন। আবার প্রোগ্রামিংও জানেন। সার্চ এঞ্জিন অপটিমাইজেশনও শিখেছেন, কিওয়ার্ড র্যাংক করাইতে পারেন, সার্চ এঞ্জিন কীভাবে কোন সাইটরে প্রাধান্য দেয়, লিংক বিল্ডিং ইত্যাদি নিয়া সলিড ধারণা রাখেন। এদিকে আপনে ইতিহাসও পড়েন। টেক ওয়ার্ল্ডের খবরাখবর বুঝেন, ভূ-রাজনীতি নিয়া আগ্রহ রাখেন। সমাজতত্ত্ব পড়েন, সাইন্সও পড়েন। সাহিত্য সমালোচনাও করতে পারেন। ইনভেস্টিং নিয়াও ভালো জ্ঞান রাখেন। অর্থনীতি সাইকোলজি নিয়াও আপনার আগ্রহ। জ্ঞানের প্রায় সব ফিল্ড নিয়াই আপনি ইন্টারেস্টেড।
আপনে বিগ পিকচার দেখতে আগ্রহী। যেমন বিগ পিকচার অনেকেই দেখেছেন ইতিহাসে নানা জ্ঞানের ফিল্ড ব্যবহার করে। আধুনিক কালেও অনেকে দেখছেন (যেমন তালেব, হারারি), এদের আপনার ভালো লাগে।
তো, এসব দেখে একজন আপনারে বলতে পারে জ্যাক অব অল ট্রেডস, মাস্টার অব নান।
এইটা সে বলল আপনারে হেয় করতে।
এমতাবস্থায় আপনি কী করবেন? তার কথামতো এক ট্রেডে মাস্টার হইতে যাবেন নাকী?
না।
প্রথমে আপনারে দেখতে হবে এই প্রবাদখানা আসলো কোথা থেকে। এইটি কিন্তু একটি পজেটিভ কথা ছিল প্রথমে। জ্যাক অব অল ট্রেডস অংশটা প্রশংসার। পরবর্তীতে হেয় করা অংশ মাস্টার অব নান যুক্ত হইছে।
মূলত এই কথায় আপনি দুইটা দিক পাইবেনঃ
এক- প্রশংসা, কারণ আপনার জানার ফিল্ড বিস্তৃত।
দুই- ঈর্ষা, কারণ যে বলতেছে তার এই ক্ষমতা নাই।
আপনি একটু কুশলী হইলে জিগাইতে পারেন তারে সে কোন ফিল্ডে মাস্টার? মাস্টার মানে কিন্তু বড় কিছু বুঝায়। সিভিল এঞ্জিনিয়ারিং এ মাস্টার মানে দেশের পাঁচজন সেরা এঞ্জিনিয়ারদের একজন। বা বিশ্বের মাঝে নামকরা একজন। তো যে বলতেছে সে কি এইরকম মাস্টার?
দেখবেন যে সে এইরকম কিছুই না। কারণ এইরকম হইলে আপনারে সে এমন বলতোই না।
কোন ফিল্ডে মাস্টার হইতে গেলে ১০ হাজার ঘন্টা প্র্যাক্টিস করতে হয় এমন এক দাবী করেছিলেন আউটলায়ারসের লেখক। তিনি কিছু উদাহরণও হাজির করেন। কিন্তু এই ধারণার বিরুদ্ধে শক্ত যুক্তি আছে। একবার দেখা গেল একই এলাকা থেকে কয়েকজন চ্যাম্পিয়ন প্লেয়ার আসছেন টেবিল টেনিসের। দশ হাজার ঘন্টা পরিশ্রমের রুলে তাদের ফেলা হলো, তারা ঠিকই পরিশ্রম করেছিলেন। কিন্তু তারা ভাগ্যবানও ছিলেন, কারণ একজন বিখ্যাত রিটায়ার্ড টেবিল টেনিস কোচ ঐ এলাকায় থাকতেন। তিনি এইসব প্লেয়ার বাচ্চা থাকতে তাদের সাথে খেলতেন। তাই নিতান্ত ভাগ্যগুণে প্রথম থেকেই তারা ঠিক পথে পরিশ্রম কইরা গেছেন।
ফলে এই থিওরী মতে আসলে মাস্টার হওয়ার জন্য লাগে ১০ হাজার ঘন্টা পরিশ্রম + ভাগ্য।
জ্যাক অব অল ট্রেডস কারা কাদের বলে এটা বুঝার বিষয়। ১৫৯২ সালে রবার্ট গ্রীন নামে এক বুকলেট লেখক শেক্সপিয়রকে জ্যাক অব অল ট্রেডস বলে বাতিল করতে চাইছিল। কিন্তু এখন শেক্সপিয়রকে এই এট্যাকই তার নামের টিকে থাকার এই উপায় হইয়া আছে।
আমরা বলতে পারি দুনিয়ার বড় জ্যাক অব অল ট্রেডস শেক্সপিয়র। আর কে কে?
দুনিয়ার প্রায় সব ব্রড থিংকারই। কারণ চিন্তার প্রশস্ততার জন্য বিভিন্ন ফিল্ডের জ্ঞান আপনার দরকার। আমি এঞ্জিনিয়ার তাই ইতিহাস পড়মু না, ইতিহাস পড়ে অমেধাবীরা; এমন ছাগলামি কথা তারাই বলতে পারে যারা ছাগলাধম।
বিভিন্ন ফিল্ডে যারা জ্ঞান রাখেন, যারা ঈর্ষাকাতর অল্প জানাদের কাছে জ্যাক অব অল ট্রেডস, মাস্টার অব নান; এদের আসলে কী নামে ডাকা হয়?
এক্সপার্ট জেনারালিস্ট।
একজন বড় লিভিং এক্সপার্ট জেনারালিস্ট হইলেন চার্লি মাঙ্গার।
বিল গেটস বলেন, আমার দেখা সবচাইতে প্রশস্ততম চিন্তার লোক হইলেন তিনি। ব্যবসা নীতি থেকে অর্থনীতি, ছাত্রছাত্রীদের ডর্মিটরি ডিজাইন, ক্যাটামারান ডিজাইনে তার সমকক্ষ নাই। আমাদের সবচেয়ে দীর্ঘ কথাবার্তাটা হইছে মোল ইঁদুরের যৌন প্রজনন স্বভাব এবং তা থেকে মানব জাতি কী শিখতে পারে তা নিয়া।
এক্সপার্ট জেনারালিস্ট হইতে লাগে অপেননেস। মানে খোলা মনে আপনে বিভিন্ন ফিল্ডের আইডিয়া নাড়াচাড়া করতে পারেন। তথ্য বিশ্লেষণ কইরা নিজের প্রিয় আইডিয়া ভুল মনে হইলে তা বাদও দিতে পারেন।
আরেকজন এক্সপার্ট জেনারালিস্টের কথা মনে হইল। প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক। নানা ফিল্ডে তার জ্ঞাণ ছিল, এজন্যই তিনি বিগ পিকচার দেখার ক্ষমতা রাখতেন।
এ স্থলে তার একটা কথা তুলে দেই। সাক্ষাৎকার থেকে,
হুমায়ুন আজাদঃ আপনি তো আশাবাদী।
আব্দুর রাজ্জাকঃ আমি জানি না। আমি তথ্য নিই, আর তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই সিদ্ধান্তে পৌছি।
এক্সপার্ট জেনারালিস্ট হইতে বা বিভিন্ন ফিল্ডের জ্ঞাণ দ্বারা নিজেরে সমৃদ্ধ করতে কী করা লাগে?
ঐসব ফিল্ডের বই পড়া লাগে। ঐসব ফিল্ডের বড় আইডিয়াগুলি জানা লাগে। বিভিন্ন ফিল্ডের মাঝে ডট কানেক্ট করা লাগে। সময় দেয়া লাগে, পরিশ্রম লাগে।
আপনি মনস্তত্ত্ব জানতে হইলে তার বইগুলা পড়বেন, অর্থনীতি জানতে হইলে অর্থনীতির বই।
এই পরিশ্রম করা সহজ না। নানা ফিল্ডের জ্ঞাণ নিজের মধ্যে ধারণ অনেকের কাছে অসম্ভব। তারা তাই এক ফিল্ডে বইয়া থাকতে চায়। এবং কেউ বিভিন্ন ফিল্ড থেকে জ্ঞাণ নিলে তাদের তা খারাপ লাগে, কারণ ঐ ব্যক্তি তার চাইতে ভালো কোন ঘটনা বুঝার ক্ষমতা অর্জন কইরা ফেলতেছে।
প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের প্রভাব পড়ছিল আহমদ ছফার উপরে। যদ্যপি আমার গুরুতে আমরা দেখি রাজ্জাক সাহেবের কথামতো তিনি নানা বিষয়ে পড়েই চলেছেন। তার সাক্ষাৎকার পড়লে দেখা যায় যে তিনি মুহাম্মদ জাফর ইকবালের সাথে বিজ্ঞানের বিষয় নিয়ে চিঠিপত্র লেখছেন। ছবি আঁকছেন, চিত্র সমালোচনা করছেন, বিভিন্ন ধরনের লেখালেখি এবং সাংঘটনিক কাজ তো আছেই।
আরো কয়েকজন জ্যাক অব অল ট্রেডস বা এক্সপার্ট জেনারালিস্টের ছবি ফোর্বসের সৌজন্যে এখানে দেখা যাবে।
এখন কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন ফোর্বস যাদের ছবি দিছে, এরা তো আসলে অনেক ফিল্ডে মাস্টার।
ঠিকই, কিন্তু একসময় তারা জ্যাক অব অল ট্রেডসই ছিলেন। সারাজীবন জ্যাক অব অল ট্রেডস থাকতে থাকতে পরে দেখা গেছে মোট রেজাল্টে কয়েক ফিল্ডে তারা মাস্টারই হইয়া উঠছেন।
এনাদের মানুষ শুরু থেকেই মাস্টার ধইরা নিয়া বসে থাকে নাই। আগেই দেখছেন যে শেক্সপিয়ররে সোজা জ্যাক অব অল ট্রেডস বইলা বাতিলই করার চেষ্টা করা হইছে।
মানুষের লাইফের, তার এচিভমেন্টের, তার জীবন সুখের বিচার হয় তার লাইফ শেষ হইলে। তখন বুঝা যায় কে মাস্টার আর কে গোল আলু। কে রবার্ট গ্রীন আর কে শেক্সপিয়র।
এক ফিল্ড নিয়া যারা বইসা থাকে তারা সবাই মাস্টার হইয়া যায়? যায় না। কেরিরালিস্ট পুঁজিবাদী আধুনিক সমাজে মানুষ হইল ইউটিলিটি দেবার মেশিন। সমাজ চায় না কেউ পুরা শার্ট বানাইতে যাক। সমাজ বলে একজন লাগাইবে বোতাম, একজন করবে হাতা সিলাই, একজন লাগাইবে কলার। এইরকম করলে বেশী শার্ট বানানো যাবে মেশিনদের দ্বারা।
তাই তারা চায় বোতাম এক্সপার্ট, কলার এক্সপার্ট, হাতা এক্সপার্ট।
কিন্তু পুরা শার্টটা বানাইতে একজন পারবে না। আগেকার দিনে যখন শ্রমিক বানাইত প্রোডাক্ট তখন সেই প্রোডাক্ট তার জন্য একটা মিনিং হইয়া দাঁড়াইত। এখন তা হয় না, কারণ একজন তো বানায় নাই। তারা একেকজন মিনিংলেস একেকটা অংশ বানাইছে।
জ্ঞানের ক্ষেত্রেও তাই এমন ধারণা তৈরী হইছে। একেকজন বোতাম এক্সপার্ট আর হাতা এক্সপার্ট হইতে চায়। কিন্তু এরকম হওয়া মানে অল্প জ্ঞান নিয়া বইসা থাকা, ও তার দ্বারা সমাজের ভুল চিত্র দেখা; তা মূর্খতারই ভিন্ন একটা রূপ মাত্র।