আমি মনে করি কোন সমাজের সামাজিক সমস্যাকে বৃহৎ সংখ্যক লোকের সামনে তুলে ধরে তাদের দেখিয়ে দিতে পারে, এক ধরনের প্রতিবাদ করতে পারে থ্রিলার ফিকশন বা মুভি। সুইডিশ ক্রাইম থ্রিলারের লেখক হেনিং মেঙ্কেল বলেছিলেন, যে সমাজে লেখা হচ্ছে তার যেন একটি সাইকোলজিক্যাল নিরীক্ষা হয় ক্রাইম ফিকশন। এটাও ঠিক কথা, এবং এরকম মেঙ্কেলের লেখায় যেমন পাওয়া যায়, তেমনি অন্য অনেক থ্রিলারে দেখা যায়, এখানে নাম করা যায় মিখায়েল হানেকের ফিল্ম হিডেন বা ক্যাশ এর।
আমেরিকান হিস্টোরী এক্স এইরকম একটি ফিল্ম যেখানে আমেরিকার উগ্র জাতীয়তাবাদ, শাদাদের শ্রেষ্টত্ব মূলক বর্ণবাদ, এবং নয়া নাৎসিজম এর তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। এই ফিল্মের প্রধান চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন এডয়ার্ড নর্টন। ফিল্মে নর্টন নয়া নাৎসীজমী একটা পার্টির সাথে যুক্ত। তারা অভিবাসন বিরোধী, তারা শাদাদের শ্রেষ্ঠত্বমূলক বর্ণবাদী, ইহুদীবিদ্বেষী। সব সমস্যার জন্য তারা কালোদের, অভিবাসীদের দোষারূপ করে।
ফিল্মের গল্প খুব জটিল কিছু নয়। সহজ ও সাধারণ। নর্টন এক সময় তার ভুল বুঝতে পারে, ও তার ছোট ভাইকে নয়া নাৎসীজম থেকে সরাতে চায়। ফিল্মের মূল টেনশন এখানে।
থ্রিলারের একটি টেকনিক হলো হঠাৎ মাঝখান থেকে শুরু করা। যেমন লেখা হলো বা দেখানো হলো তিনজন লোক মরে পড়ে আছে আর একপাশে পিস্তল হায়ে খুঁড়িয়ে যাচ্ছে নায়ক। সে গিয়ে বসল এক জায়গায়। তখন তার স্মৃতিতে দেখানো শুরু হলো কীভাবে এসব ঘটনা ঘটল, সে কে, যারা মরে পড়ে ছিল তারা কে, ইত্যাদি। আমেরিকান হিস্টোরী এক্স এই ফর্ম অনুসরন করেছে।
এই ফিল্ম ডিরেক্টর টনি কে’র প্রথম ফিল্ম, কিন্তু তিনি এটি নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। এডওয়ার্ড নর্টনের সাথেও ফিল্মটি নিয়ে তার ঝামেলা হয়, নর্টন এর ফাইনাল কাট দিয়েছিলেন যা ডিরেক্টর টনি কে’র কাটের চাইতে বিশ মিনিট বেশী। নর্টনকে কাস্ট করার ব্যাপারেও পরিচালক সম্মত ছিলেন না, কিন্তু আর কাউকে না পাওয়ায় মেনে নেন। টরেন্টো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যখন ডিরেক্টরের কাট না রেখে স্টুডিও-নর্টনের কাট ফিল্মই জমা দেয়া হয় ও দেখানোর জন্য মনোনীত হয় তখন জার্মানী থেকে ছুটে যান পরিচালক। গিয়ে ফিল্মটি দেখানো বন্ধ করে। তিনি একজন রাব্বি, একজন পাদ্রী ও একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুকে সাথে নিয়ে স্টুডিও একজিকিউটিভের সাথে আলোচনাতেও বসেন। অর্থাৎ, তার কাট না রাখায় তিনি প্রায় উন্মাদের মত আচরণ শুরু করেন। পত্রিকায় ৪০ টি ফুলপেইজ বিজ্ঞাপন দেন। তার এসব কর্মকান্ড তার কেরিয়ারকে ধ্বংসের মুখে টেলে দেয়, এবং তিনি পরিচিত হন সমস্যা সৃষ্টিকারী হিসেবে।
তার কথায়, তার কাটটি ছিল ৯৫ মিনিটের। কিন্তু যেটি মুক্তি পেয়েছে তা আরো ৪০ মিনিট বেশী। এরা একজন আরেকজনে কাঁধে কাঁদছে ইত্যাদি দৃশ্য ভরে দিয়েছে, এবং নর্টন অবশ্যই উদারভাবে নিজেকে বেশী বেশী দেখিয়েছে।
পরিচালকের প্রতি স্টুডিও-নর্টনের আচরণ হয়ত অনেকের খারাপ লাগবে, কিন্তু যেহেতু ফিল্ম এখানে কমার্শিয়াল প্রকল্প তাই সৃষ্টিশীলতার স্বাধীনতা অনেক ক্ষেত্রেই বাধাগ্রস্থ হয়।
এদিকে এডয়ার্ড নর্টন সেইভিং প্রাইভেট রায়ানের একটি রুল ছেড়ে দেন আমেরিকান হিস্টোরী এক্স এ অভিনয়ের জন্য। এ ফিল্মে তার অভিনয় খুব ভালো হয়, অস্কারের মনোনয়ন পায় এবং এমনো বলা হয় যে ট্যাক্সি ড্রাইভারে ডি নীরো’র অভিনয় যেমন তাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে, আমেরিকান হিস্টোরী এক্সে নর্টনের অভিনয় তার কেরিয়ারের জন্য তেমন হয়েছে।
অভিনয়ের সাথে সাথে এডয়ার্ড নর্টনের লুকও ছিল ভিন্নরকম এই ফিল্মে। তিন মাসে তিনি ত্রিশ পাউন্ড ওজন বাড়িয়েছেন, তাও মাসল ম্যাস। শোয়ার্জনেগার এর মনেও এ নিয়ে সন্দেহ আসে, এবং তিনি জিজ্ঞেস করেন সে স্টেরয়েড নিয়েছে কি না। কিন্তু নর্টনের মতে স্টেরয়েড নয়, তিন মাস নিয়মিত ওয়ার্ক আউট ও ঠিকমত খাওয়াদাওয়া মেইন্টেইন করেই তিনি ত্রিশ পাউন্ড মাসল ম্যাস অর্জন করেছেন। এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সাধারণ একজন মানুষ এরকম মাসল ম্যাস ন্যাচারালি অর্জন করতে পারবে, তবে এর জন্য তিন মাসের চাইতে বেশী সময় লাগবে।
যাইহোক, ফিল্মের মূল মেসেজটা ভালো। উগ্র জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, নিজ জাতি সেরা ও অন্য জাতের বা ধর্মের মানুষেরাই সব সমস্যার মূলে এমন ভ্রান্ত সব বিশ্বাসের বিপদ চিত্রায়ণ করা হয়েছে, যা হয়ত দর্শকদের “আমরা” এবং “তারা” বিভাজন পন্থায় চিন্তা থেকে বিরত রাখতে ভূমিকা রাখতে পারে।