আন্তর্জাতিক রাজনীতি বা বিশ্ব রাজনীতি কীভাবে চলে? কিছু শক্তিশালী দেশ কি চায় কারণ ছাড়াই অন্য আরেক দেশকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে? অথবা আরো স্পষ্টভাবে প্রশ্ন করলে, আমরা যে রাষ্ট্রসমূহের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া তথা যুদ্ধ-শান্তিচুক্তি-ব্যবসা ইত্যাদি দেখি, এইসব নীতি নির্ধারনের পেছনে মূল শক্তি বা চিন্তাটি কী?
জন জে মার্শহেইমার একজন আমেরিকান নিও-রিয়ালিস্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। রিয়ালিস্ট বা বাস্তববাদী চিন্তকেরা বাস্তবতার বিচারে বিশ্ব রাজনীতির কোন ঘটনা বিচার করে থাকেন। ম্যাকায়াভেলী শুরুর দিকের এরকম একজন বাস্তববাদী চিন্তক, এবং তার দ্য প্রিন্স বাস্তববাদী বিশ্ব রাজনীতির জন্য এক অসাধারণ মাস্টারপিস।
বাস্তবাদী তত্ত্বগুলিকে প্রধান দুইভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগ মতে মানুষের স্বাভাবিক স্বভাব বা প্রকৃতিই তার ক্ষমতার আকাঙ্খার জন্য দায়ী, এবং এটিই বিশ্ব রাজনীতির চালিকা শক্তি। আর অন্য ভাগের মতে মানুষের স্বাভাবিক স্বভাব নয়, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাটাই এমন যে এখানে টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্রদের আগ্রাসী হতে হয়। দুই ভাগের তত্ত্বই একই সিদ্ধান্তে যায় কিন্তু কারণ হিসেবে তারা ভিন্ন জিনিসের কথা বলে।
মার্শহেইমার একজন স্ট্রাকচারাল রিয়ালিস্ট। তার একটি তত্ত্ব আছে, নাম অফেনসিভ রিয়ালিজম। এই তত্ত্বের কথা অনুযায়ী, রাষ্ট্রগুলি নিজেদের নিরাপত্তার জন্য ক্ষমতা দখলের নিমিত্তের পরস্পরের সাথে প্রতিযোগীতা করে। এবং এই প্রতিযোগীতার জন্য আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা দায়ী।
সব বড় শক্তির প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে নিজেদের ক্ষমতা বাড়ানো, এবং এর জন্য সে তার অঞ্চলে একটা হেজিমনি (বা শক্ত প্রভাব) তৈরী করতে চায়। এবং একই সাথে চায় তার প্রতিদন্ধী কোন বড় শক্তি যেন অন্য কোন অঞ্চলে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করতে না পারে।
এই তত্ত্ব প্রথমে পাঁচটি মূলনীতি ধরে নেয়, এবং এই মূলনীতির উপরেই তত্ত্বের বয়ান দাঁড়িয়ে আছে। মূলনীতিগুলি হলোঃ
১। রাষ্ট্র হচ্ছে আন্তর্জাতিক বা বিশ্ব রাজনীতির চালিকা শক্তি, রাষ্ট্রের উপরে আর কোন শক্তি নেই। রাষ্ট্রদের উপরে অভিভাবক হিসেবে এমন কোন শক্তি নেই যার কাছে বিপদে পড়লে সাহায্য নেয়া যাবে। এই সিস্টেম হলো নৈরাজ্যিক, অর্থাৎ উপরে কেউ নেই মীমাংসা ও সাহায্য করার জন্য।
২। সব রাষ্ট্রেরই আগ্রাসী সেনাবাহিনী আছে। কিছু দেশের মিলিটারী পাওয়ার অন্য দেশের চাইতে অনেক অনেক বেশী শক্তিশালী। কোন রাষ্ট্রের মিলিটারী পাওয়ার পরিমাপযোগ্য কারণ যেসব যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি তার আছে সেসব চোখে দেখা যায় ও পরিমাপ সম্ভব।
৩। রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের ইনটেনশন বা ভিতরে কী উদ্দেশ্য নিয়ে সে কাজ করছে তা সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত কখনো হতে পারবে না। কারণ ইনটেনশন অন্য রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনেতার মাথার ভেতরে থাকে। এটা নিশ্চিত হয়ে বলা সম্ভব নয় তিনি দশ বছর পরের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন কি না।
৪। রাষ্ট্রের প্রধানতম লক্ষ্য হচ্ছে টিকে থাকা। কিন্তু তা একমাত্র লক্ষ্য নয়। রাষ্ট্রের আরো নানা লক্ষ্য উদ্দেশ্য থাকে। কিন্তু যখন টিকে থাকার প্রশ্ন আসে তখন অন্য লক্ষ্য তার কাছে কম গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠে, এবং টিকে থাকার লক্ষ্যটিই প্রধান হয়ে দেখা দেয়। টিকে থাকার মধ্যে আছে তার সীমানার নিরাপত্তা, স্বাধীন নীতি নির্ধারন ইত্যাদি।
৫। ধরে নেয়া হয়েছে রাষ্ট্রসমূহে যৌক্তিক আচরণ করে। অর্থাৎ নিজেদের টিকে থাকার সম্ভাবনা বাড়াতে যৌক্তিক স্ট্র্যাটেজি তৈরী করতে সক্ষম তারা।
পৃথিবীতে কোন এক প্রতিবেশী রাষ্ট্রের খারাপ উদ্দেশ্য থাকতে এবং এর সাথে থাকতে পারে আগ্রাসী সেনাবাহিনী। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহ পরস্পরকে ভয় করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে। যে রাষ্ট্রের মিলিটারী শক্তি বেশী তাকে অন্যরা ভয় করে বেশী, এবং তার টিকে না থাকার ঝুঁকি কমে। ৯-১১ এর পরে রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের টিকে থাকার জন্য নিজেদের শক্তি বাড়ানোকেই প্রধান যুক্তিযুক্ত কাজ মনে করছে, কারণ বিপদে সাহায্য করার মতো কোন বড় বিচারক শক্তি নেই।
কোন বড় শক্তির মূল লক্ষ্য হলো একচ্ছত্র শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া।
কিন্তু কোন রাষ্ট্রের পক্ষে গ্লোবাল হেজিমনি অর্জন করা সম্ভব নয়। দূরের বড় শক্তিকে জয় করা এবং তাদের উপর প্রভাব বিস্তার প্রায় অসম্ভব। ইউনাইটেড স্টেইটসও তা করতে পারে নি, যদিও ইউএসকে অনেকে গ্লোবাল হেজিমনি বলে থাকেন।
কারণ ভিন্ন এলাকায়, ভিন্ন ভূ-প্রকৃতি, পরিবেশ ও সংস্কৃতির মানুষের সাথে যুদ্ধ করে জেতা কঠিন। একইসাথে জাতীয়তাবাদের তীব্র শক্তি উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।
কোন বড় শক্তি তার অঞ্চলে হেজিমন হতে পারে। যেমন ওয়েস্টার্ন হেমিস্ফিয়ারের হেজিমন বা মূল পাওয়ার ইউনাইটেড স্টেইটস। তার এক পাশে কানাডা, এক পাশে মেক্সিকো, দুই পাশে সমুদ্র। অর্থাৎ, নিরাপত্তা জনিত কোন আশংকা তার নেই। উপরন্তু মিলিটারী পাওয়ার এত বেশী যে পশ্চিমা কোন শক্তি তাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে না।যদিও আমেরিকা স্পষ্টতই পৃথিবীর সবচাইতে বড় শক্তি তথাপি সে গ্লোবাল হেজিমন নয়।
কোন রাষ্ট্র যদি তার আঞ্চলিক হেজিমন অর্জন করে ফেলে তখন তার পরের কর্তব্য হয়, অন্য কোন বড় শক্তি যাতে নিজেদের অঞ্চলে আঞ্চলিক হেজিমন অর্জন করতে না পারে। এজন্য আমেরিকা চায় না চীন সাউথ ইস্ট এশিয়ার হেজিমন বা একচ্ছত্র শক্তি হয়ে উঠুক।
যদি অন্য কোন বড় শক্তি তার অঞ্চলে হেজিমন হয়ে উঠে তাহলে বৈশ্বিক ব্যাপারেও প্রভাব খাটাতে শুরু করবে, এবং প্রতিযোগী হয়ে উঠবে।
এজন্য, আমেরিকা পৃথিবীর এমন সব অঞ্চলে হস্তক্ষেপ করে, অনেক টাকা খরচ করে যুদ্ধ করে, সাহায্য করে টাকা-প্রযুক্তি দিয়ে যেসব অঞ্চল থেকে তাদের উপর সরাসরি কোন থ্রেট নেই।
কিন্তু এসব তারা করে থাকে যাতে ঐ অঞ্চলে কোন একক শক্তি একচ্ছত্র হয়ে উঠতে না পারে।
বড় গ্লোবাল পাওয়ার হবে কোন রাষ্ট্র, যখন সে তার অঞ্চলে একচ্ছত্র ক্ষমতাধর হয়ে উঠতে পারবে।
দুই বা তিন রাষ্ট্র এভাবে নিজেদের অঞ্চলে হেজিমন হয়ে উঠলে তারা পরস্পর বৈশ্বিক বিষয়ে দর কষাকষি ও ঝামেলায় জড়াবে। এর জন্য কোন শক্তি চাইবে সেই যেন তার অঞ্চলে একচ্ছত্র অধিপতি থাকে (ইউএসএ যেমন আছে পশ্চিমা বিশ্বে) এবং অন্য কেউ যাতে তার অঞ্চলে (চীন যেন এশিয়ায়) এরকম ক্ষমতা অর্জন করতে কখনো না পারে।
কিন্তু চীন অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে এটা বুঝতে পারছে যে আঞ্চলিক হেজিমন হয়ে উঠাই তার টিকে থাকা নিশ্চিত করতে পারে। এজন্য সে মিলিটারী শক্তি বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করছে, এবং এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। চীন তার ইতিহাস ভুলে যায় নি। ১৮৫০ এবং ১৯৫০ এর মধ্যে চীন যখন মিলিটারী দিক থেকে দূর্বল ছিল তখন জাপান-ইউরোপিয়ান পাওয়ার-ইউনাইটেড স্টেইটস তাদের সাথে কী করেছিল। সেই ইতিহাস চীনের ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ন প্রভাব ফেলে চলেছে অদ্যাবধি।
চীন মিলিটারী দিক থেকে শক্তিশালী রাষ্ট্র হবে, এবং সাউথ ইস্ট এশিয়া ও ইন্ডিয়ায় তার প্রভাব বিস্তার করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাবে। এদিকে আমেরিকা তা কখনো চাইবে না, কারণ তার সর্বশক্তি দিয়ে হলেও তা প্রতিরোধ করবে। আর চীনের প্রতিবেশী জাপান, সিংগাপুর, ভিয়েতনাম, রাশা, ইন্ডিয়াও চাইবে না চীন আঞ্চলিক হেজিমন হয়ে উঠুক।