খুবই অল্প এগিয়ে থাকা, দীর্ঘদিন ধরে

গবেষক বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত আমাজন জঙ্গলে ১৬০০০ ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির গাছ শনাক্ত করেছেন। এত বিশাল সংখ্যক বৃক্ষ প্রজাতির মধ্যে মাত্র ২২৭ টি প্রজাতির গাছই আমাজনে প্রবল। তারা প্রায় ৫০ ভাগ দখল করে আছে। হিসাব করলে দাঁড়ায়, ১.৪ ভাগ প্রজাতির গাছ ৫০ ভাগ জায়গা দখল করে আছে। []

কিন্তু এটা কেন ও কীভাবে হয়?

যে প্রক্রিয়ায় এটা হয় তা খুবই সরল ও সহজবোধ্য। ধরা যাক দুই প্রজাতির ভিন্ন গাছ পাশাপাশি জন্মেছে আমাজন রেইন ফরেস্টে। তারা সূর্যের আলো, পানি, পুষ্টি ইত্যাদির জন্য পরস্পরের সাথে প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হবে। এখন একটি গাছ যদি সামান্য একটু বেশী বেড়ে উঠে তাহলে সে বেশী সূর্যের আলো পাবে। এই বেশী আলো পাওয়া তাকে আরো বেশী বাড়তে সাহায্য করবে। এভাবে প্রতিদিন একটু একটু করে সুবিধা পেয়ে সে তার পাশের গাছটিকে অনেক ছাড়িয়ে যাবে কিছু বছরে। সে তার বীজ ছড়িয়ে দেবার বেশী সুযোগ পাবে। পরবর্তীতে তার বংশধরেরাও এই বেড়ে উঠার ক্ষমতা কিছু কিছু পাবে জন্মগতভাবে। এবং প্রজাতি হিসেবে তারা এগিয়ে যাবে।

বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছে একুমিউলেটিভ এডভান্টেজ। একটি গাছের শুরুর দিকে সামান্য সুবিধার দরকার হয় পাশেরটাকে ছাড়িয়ে যেতে এবং প্রায় সমস্ত অরণ্য দখল করে নিতে।

অর্থাৎ সহজ কথায়, প্রতিদিন অতি অল্প পরিমাণ এগিয়ে যেতে থাকলে অনেক সময়ের ব্যবধানে অন্যদের চাইতে একজন অনেক বেশী এগিয়ে যায়।

মানুষের জীবনেও একই ব্যাপার ঘটে থাকে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে। যেসব প্রতিযোগীতায় বিজয়ীরাই সব পায়, সেইসব প্রতিযোগীতায় বিজয়ী হয়ত খুব সামান্য ব্যবধানে অন্যকে হারায়। যেমন, অলিম্পিক কোন রেইসে সেকেন্ডের একশো ভাগের এক ভাগ আগে গিয়ে একজন জিতে নেন গোল্ড মেডাল।

সব প্রতিযোগীতা অবশ্য “উইনার’স টেইক অল” ধরণের নয়। কিন্তু, যেকোন ব্যবস্থায় কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি নিয়মিত ভাবে দীর্ঘদিন খুবই অল্প পরিমাণ ভালো করে যেতে পারে, তাহলে সময়ের ব্যবধানে তারা অন্যদের চাইতে অনেক এগিয়ে থাকতে পারে।

যেমন, একজন ব্যক্তি প্রতিদিন ৩ পাতা করে কোন ভালো বই পড়েন। প্রতিদিন। এক বছরের ব্যবধানে তা হবে ১০৯৫ পৃষ্ঠা। দশ বছরে ১০৯৫০ পৃষ্ঠা।

১০৯৫০ পৃষ্ঠা খুবই বিশাল ব্যাপার।

দশ বছরের ব্যবধানে তিনি বই না পড়াদের চাইতে অনেক অনেক এগিয়ে থাকবেন বুদ্ধিমত্তা ও জানাশোনার দিক থেকে।

শুধু বই পড়া নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই অল্প এগিয়ে থাকার নীতি কাজে লাগাতে পারেন কেউ।

সূত্রটা এখানে হচ্ছে সহজ, দীর্ঘদিন ধরে খুবই অল্প একটু ভালো করে যেতে হবে।

 

বিজয়ীরা যেখানে সব পায়ঃ

ম্যাথিউ ইফেক্ট কথাটি এসেছে বাইবেল থেকে। বাইবেলে আছে, “যাদের আছে, তাদের আরো প্রচুর দেয়া হবে; এবং যাদের নেই, তাদের কাছ থেকে সব নিয়ে নেয়া হবে।”

For to every one who has will more be given, and he will have abundance; but from him who has not, even what he has will be taken away.

— Matthew 25:29.

ভিলফ্রেদো পারেতো একটা কৌতুহল উদ্দীপক জিনিস আবিষ্কার করেছিলেন তার বাগানে, ১৮০০ সালের শেষের দিকে। তিনি দেখেছিলেন যে তার বাগানের কিছু মটরশুটি গাছ থেকেই প্রায় ৮০ ভাগ মটরশুটি উৎপন্ন হয়।

তিনি এটি নিয়ে ভাবতে লাগলেন। গাণিতিক সমীকরণ করলেন। নিজের দেশ ইতালির হিসাব নিয়ে দেখলেন ৮০ ভাগ জমি ২০ ভাগ মানুষের দখলে। ব্রিটেনের ইনকাম ট্যাক্স বিশ্লেষণ করে দেখলেন ৩০ ভাগ মানুষ মোট আয়ের ৭০ ভাগ করে থাকেন। আরো নানা জায়গায় তিনি পরীক্ষা করেন। সব জায়গায় একই ফল পাবেন। বেশীরভাগ সম্পদ, অল্প সংখ্যক মানুষের হাতে।

পারেতো’র এই নীতিতে ৮০/২০ রুল বলা হয়। এটি আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরীক্ষা করে দেখা গেছে কাজ করে। যেমন, ফুটবল বিশ্বকাপে ৭৭ টি দেশ অংশ নিয়েছে, কিন্তু ব্রাজিল, জার্মানী ও ইতালি, এই তিনটি দেশ ২০ টি টুর্নামেন্টের ১৩টিই জিতে নিয়েছে।

এই ২০ পার্সেন্ট লোক, যারা বেশীরভাগ পুরস্কার নিয়ে নেন, অনেক ক্ষেত্রেই তারা একুমিউলেটিভ এডভান্টেজ বা শুরুতে অল্প অল্প সুবিধা পেয়ে থাকেন, ও এগিয়ে যান।

জীবনের সব কিছুই অবশ্যই উইনার’স টেইক অল নয়, কিন্তু অনেক কিছুই। তাই ইনেকুয়ালিটি বিদ্যমান থাকে সমাজে, ও থাকবে।

 

বিষয়টাকে আরেকভাবে দেখা যায়ঃ

একুমিউলেটিভ এডভান্টেজ মানে শুরু থেকে অল্প এগিয়ে থাকা মানব সন্তানেরা অনেক ক্ষেত্রেই পায় ভালো সোশিও-ইকোনমিক ক্লাসে জন্ম নিয়ে। আজ একজন মোটামোটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নিয়েছেন বলেই এই লেখা পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন কম্পিউটারে। এবং আরো আরো বই পড়ার অবকাশ আছে তার। ভালো ফিলিম দেখার সু্যোগ আছে। এবং এই আর্টিকেলের মত জিনিস লেখার সুযোগ তিনি পেয়েছেন বা পাবেন। [ লিংক-১ ,লিংক-২, লিংক-৩]

খারাপ আর্থ-সামাজিক ক্লাসে জন্ম নিলে আমাকে হয়ত আজ ক্বীন ব্রিজে রিকশা ঠেলতে হতো।

এই জিনিস মনে রাখা দরকার সামাজিক সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষদের। তখন সে অল্প হলেও বুঝতে পারবে যারা খারাপ আর্থ-সামাজিক শ্রেণীতে জন্ম নিয়েছে তারা কতো সুবিধা পাচ্ছে না। এবং বুঝতে হয়ত পারবে যে সমাজে আমাদের বাস তা ন্যায় নয়।

এই বোধ হয়ত মানুষকে একটু বেশী নৈতিক ও একটু পরার্থপর করে তুলতে পারে।