মুজতবা আলী’র বিচারে আমাদের সাম্প্রতিক বই বাণিজ্য

সৈয়দ মুজতবা আলী’র পাণ্ডিত্য ছিল বিশাল, এবং লেখার ক্ষমতা ছিল ব্যতিক্রমী। এইসব বড় সাহিত্যিকেরা এসেছিলেন ও বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গিয়েছেন বলেই আমরা সাহিত্যের এক শক্ত ভিত্তি পেয়েছি, একথা বলা যায়। তাদের কাছ থেকে তাই শেখার, জানার ও বুঝার অনেক কিছু রয়েছে।

আলী সাহেবের রচনাবলী-৭ থেকে উভয় বাঙলা’র প্রবন্ধ পড়ছিলাম। সেখানে একটি প্রবন্ধে তিনি বলছিলেন তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে যখন পশ্চিমবঙ্গের বই নিষিদ্ধ করা হয় তখন কী খারাপ প্রভাব পড়ে ওপার বাংলার বই বাণিজ্যে এবং শিল্প সাহিত্যে। তার সেই বিশ্লেষণ যদিও তখনকার পশ্চিমবাংলা নিয়ে ছিল তথাপি এটি বাংলাদেশের বর্তমান বই বাণিজ্যের দশার সাথে মিলে যায়। পড়া যাক আলী সাহেবের কথাটিঃ

“একদা সাধনোচিত ধামে গত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় মহাশয় আমাকে বলেন, কলকাতার পরই জেলা হিসেবে ধরলে সিলেটে তাঁর কাগজ “প্রবাসী” সবচেয়ে বেশী বিক্রি হত। প্রকাশক সম্পাদক ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদের চেয়েও বেশী বিপাকে পড়ে লেখক। তখন কিছু লেখক বিক্রি বাড়াবার জন্য আরো “জনপ্রিয়” হতে গিয়ে লেখার মান নামিয়ে দেন। একাধিক সম্পাদক পাণ্ডিত্যপূর্ন পুস্তক, জটিল সামাজিক রাজনৈতিক সমস্যাময় কথাসাহিত্য ছাপতে দ্বিধাবোধ করেন, পক্ষান্তরে হুজুগে বাঙালী কোনো-কিছু একটা নিয়ে মেতে উঠলে সঙ্গে সঙ্গে বিস্তর প্রকাশক সেটা নিয়ে একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাশি রাশি ফরমাইশি বই রাতারাতি ঝপাঝপ বাজারে ছাড়তে আরম্ভ করেন। তড়িঘড়ি লেখা ফরমাইশি কেতাব অধিকাংশ স্থলেই নিম্নমানের হতে বাধ্য। পাঠকের রুচিকে এরা নিম্নস্তরে টেনে নামায় এবং তথাকথিত “গ্রোশামের” সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উচ্চমানের পুস্তক সম্মান হারায় ও মুক্ত হট্ট থেকে বিতাড়িত বা অর্ধ-বহিঃস্কৃত হয়।”

  • উভয় বাঙলা- অকস্মাৎ নিবিল দেউটি দীপ্ততেজা রক্তস্রোত, সৈয়দ মুজতবা আলী।

বাংলাদেশের বই বাণিজ্য বড় ধাক্কাটি খায় হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পরে। ইতিমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া ফেইসবুক অনেক জনপ্রিয় হয়েছে, অনেক অনেক লোকে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে শুরু করেছেন।

এই ফেইসবুককে মাধ্যম করে জনপ্রিয় হওয়া লোকদেরই টার্গেট করেন প্রকাশকেরা। যাতে হুমায়ূন পরবর্তী যুগে বই ব্যবসা করা যায়। এদিকে ফেইসবুকের জনপ্রিয় তথাকথিত লেখকেরাও বুঝতে পেরেছিলেন যে হুমায়ূন আহমেদের মতোই লেখতে হবে জনপ্রিয় হতে হলে।

তাদের অবলম্বন হুমায়ূনীয় আবেগ ও হুমায়ূনীয় রসিকতা, এবং কোন কোন ক্ষেত্রে এডাল্ট বা চটুল ফান।

এখানে বড় সমস্যাটা হলো লেখক হুমায়ূন নিজে শিল্প বুঝতেন। সমাজ ও রাজনৈতিক সচেতনতা তার ছিল। বিশ্বের বড় বড় সাহিত্যিক ও শিল্পীদের তিনি নিতে পারতেন। কিন্তু এই হুজুগে হুমায়ূন কপি লেখকেরা পড়েছেন মোটাদাগে কেবলই হুমায়ূন বা এই ধারার লেখা, এই তাদের সাহিত্যিক প্রস্তুতি!

যাইহোক, আমরা অনেক অনেক হুমায়ূন কপি লেখক পেতে শুরু করলাম বই মেলায়। প্রকাশকেরা ‘ফেইসবুক সেইব্রেটির বই’ বলে প্রচার করতে থাকলেন। এবং আরো অনেক লেখক এই ধারায় আসতে শুরু করলেন, যারা হয়ত আগে ভিন্নরকম লেখালেখি করতেন।

অর্থাৎ, হুজুগ যখন তৈরী হয়েছে, যেহেতু এই হুমায়ূন ধরণের বই বিক্রি হচ্ছে, সুতরাং এই জনপ্রিয় ধারায় গা ভাসাতে আরো অনেকে এলেন।

এগুলি বিক্রি হলো। অনলাইন বইয়ের দোকানগুলি তাই এদের আলাদা খাতির করা শুরু করলো। প্রকাশকরাও। কারণ এদের দিয়ে ব্যবসাটা হচ্ছে।

ফলে, পাঠকের রুচিকে এরা আরো নিম্ন থেকে নিম্নতর স্তরে নামাতে শুরু করেছে।

গ্রেশামের ল বা সিদ্ধান্ত হচ্ছে একটি অর্থনীতি’র সূত্র। মূল উৎপত্তি গ্রীসে, কিন্তু প্রায় চারশো বছর আগে টমাস গ্রেশাম এটি বর্তমান রূপে দিয়েছিলেন, তাই তার নামেই নাম।

এটি বলে যে, “ভালো টাকা খারাপ টাকাকে বাজার থেকে হটিয়ে দেয়।” আলী সাহেব এখানে নীতিটি সাহিত্যে এপ্লাই করেছেন, এবং বলেছেন ঐ বাজে ও নিম্নমানের বইগুলি ভালো বইকে মুক্ত বাজারে টিকতে দেয় না। এই অর্থনীতির নীতি কি সাহিত্যে প্রয়োগ ঠিক হলো? এরিস্টোফেনিস তার নাটকে প্রায় দুই হাজার বছর আগেই দেখিয়েছিলেন এথেন্সে ভালো মানুষদের হটিয়ে দিচ্ছে খারাপ মানুষেরা, অর্থাৎ, মানবব্যবস্থাপনায় গ্রেশাম তত্ত্ব কাজ করছিলো তার নাটকে।  গুরুত্বপূর্ন বুদ্ধিজীবী আকবর আলী খান তার গ্রেশাম’স ল সিনড্রোম অ্যান্ড বিয়ন্ড, এন অ্যানালাইসিস অব দ্য বাংলাদেশ ব্যুরোক্রেসি বইতে দেখিয়েছেন কীভাবে গ্রেশাম ল সিন্ড্রোম কাজ করছে বাংলাদেশের বুরোক্রেসিতে। মিস্টার খানের মতে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাতেও গ্রেশাম ল চলছে। তাই সাহিত্যে, বই বিক্রিতে গ্রেশাম ল সিন্ড্রোম হয়, সুতরাং আলী সাহেবের প্রয়োগটি অযথার্থ নয়।

এটা একরকম স্বাভাবিকই, সহজেই বুঝা যায়, কারণ সোশ্যাল প্রুফ টেন্ডেন্সির কারণে হুজুগ বাড়তে থাকবে, এবং জনপ্রিয় হতে থাকা বইগুলির দিকেই চোখ থাকবে ক্রেতার, ও প্রাধান্য থাকবে বিক্রেতার।

এভাবেই নিম্নমানের জনপ্রিয় বই দিন শেষে সাহিত্যের ক্ষতিই করে।