সাধারণ মানুষ যারা মনঃসমীক্ষণ করতে চান, মনঃসমীক্ষণের জনক সিগমুন্ড ফ্রয়েড তার পক্ষে ছিলেন। ডাক্তাররা লাইসেন্স ছাড়া কাউকে মনঃসমীক্ষণ করতে দিতে চাইলেন না যখন, তখন ফ্রয়েড এর বিরোধীতা করলেন। ফ্রয়েডের বেশীরভাগ ছাত্ররা ছিলে সাধারণ মানুষদের মধ্য থেকে। ফ্রয়েড মনে করতেন মনঃসমীক্ষনকে কেবল ডাক্তারদের হাতে ছেড়ে দেয়া হবে ভয়ংকর বাজে সিদ্ধান্ত, এবং তা মনঃসমীক্ষণের বিকাশকে বাঁধাগ্রস্থ করবে।
সাধারণ মানুষ বলতে এখানে বলা হচ্ছে, এমনই যেসব মানুষ পড়ালেখা করে জেনে, বা কোন সাইকোএনালিস্টের কাছে সাইকোএনালিসিস করতে চান, তাদেরকে।
তাছাড়া মানুষের নিজের মনঃসমীক্ষণ বা সাইকোএনালিসিস করতে পারে তার জানা, বুঝা থাকলে। ফ্রয়েড মনে করতেন প্রতিটি মনঃসমীক্ষকের উচিত নিজের মনঃসমীক্ষণ করা। নিজের মনঃসমীক্ষণ করতে পারলেই অন্যের মনঃসমীক্ষণ করা যাবে।
ফ্রয়েড তার মনঃসমীক্ষণের ধারনাটি পেয়েছিলেন সাহিত্য ও দর্শন থেকে। আবার তার এই পদ্বতি দিয়েও সাহিত্যকে বিশ্লেষণ করা যায়। যেমন, কয়েকটি ক্ষেত্রে এই ব্লগের লেখায় ( এক দুই -শহীদুল জহিরের দুইটি গল্প) আমি তা করেছিলাম।
অবতেচনের নেগেটিভ প্রভাব, যা একজনের জীবনে নানা সমস্যা তৈরী করছে, তার থেকে বের হওয়ার থেরাপি পদ্বতিই সাইকোএনালিসিস বা মনঃসমীক্ষণ।
অনেক ফিল্মে ( যেমন, হাউজ অব গেইমস, ডনি ডার্কো ) বা টিভি সিরিজে (যেমন, সপ্রানোজ) সাইকোথেরাপি দেখে থাকবেন। একজন লোক গিয়ে বসে ও কথা বলে। সাইকোথেরাপিস্ট শুনেন। এইভাবে তার চিকিৎসা হয়।
সাইকোথেরাপির মাধ্যমে একজন লোকের বেশ কিছু উপকার হতে পারে। তার ভেতরের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর মত অবস্থায় সে যেতে পারে, অবচেতনের নেগেটিভ প্রভাবের কারণে কোন দুর্দশায়, মানসিক অশান্তিতে থাকলে তা থেকে মুক্ত হতে পারে, ওয়েল-বিং বা জীবন মানের উন্নয়ন, পরিবার সমাজের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে থেরাপি কাজ করতে পারে।
এর কিছু মূল বিষয় জানা থাকলে আপনি নিজের মন বুঝতে বা অন্যকে সাহায্য করতে পারেন।
লক্ষণ ও তার কারণ
মানুষ বিভিন্ন জিনিসে ভুগে, এবং ভুগতে ভুগতে সে বুঝতে পারে না যে কেন ভুগছে। যেমন, কেন সে সব সময় ভয়ে থাকে কারণ ছাড়াই, কেন সে সেক্স করতে পারছে না ইত্যাদি। যখন মাত্রাতিরিক্ত হয় তখন সাইকোথেরাপিস্টের কাছে যায়।
কোন সমস্যার ভেতরে, গভীরে কী কারণ লুকিয়ে আছে তা বের করাই সাইকোথেরাপি, এবং সাইকোএনালিসিসের কাজ।
দেখা যেতে পারে একজন লোক খালি ঘর দোর পরিস্কার করেন। একসময় তা পাগলের মতো হয়ে যায়। খালি তিনি সব ধুতে থাকেন। পরিবারের লোকেরা বুঝল এটা সমস্যা। তিনিও বুঝলেন। কিন্তু এর কারণ কী? কেউই ধরতে পারলেন না।
পরে সাইকোথেরাপিস্টের কাছে কয়েক সেশন বা অনেক কথাবার্তার পর বের হল তার শিশুকালের কোন ঘটনা। তিনি ভয়ে থাকতেন তার বাবা মা তাকে পরিত্যাগ করবেন। সেই ভয় তার অবচেতনে রয়ে গেছে ও কাজ করছে। এরই প্রতিক্রিয়ায় তার ধোয়ামোছা রোগ।
শুনতে বুজরুকি মনে হলেও অনেক ক্ষেত্রে এটা কাজের। ফ্রয়েড নিজে মেডিক্যাল ডাক্তার ছিলেন। তিনি জানতেন শরীরের এক অংশে ব্যথা হলে মূল কারণ অন্য অংশে থাকতে পারে। এই ধারণাটি তিনি মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করেন। তিনি ধরে নেন যে মানসিক যেসব সমস্যা আমরা দেখছি তার কারণে অবচেতনের দূরের কোন ঘটনার মধ্যে নিহিত থাকা অস্বাভাবিক নয়।
সাইকোথেরাপি ব্যক্তিকে ঐ মূল জায়গায় নিয়ে যায়। সেই দুঃসহ অতীতের ঘটনায়। নিয়ে যায় মূল কারণটি তাকে বুঝাতে। মূল কারণ ও ব্যাখ্যা পেলে মানুষ এর থেকে অধিক মুক্ত হতে পারে।
চাইল্ডহুড ট্রমা
শিশুকালের কোন ক্ষত ব্যক্তির বড় জীবনে খুবই মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করতেন ফ্রয়েড। সাইকোএনালিসিসের এক মূল ভিত্তি এই চাইল্ডহুড ট্রমা। এই ট্রমা যে সব সময় খুবই মারাত্মক কিছু হতে হবে এমনো নয়। দেখতে সাধারণ এমন ট্রমাও মানুষের বড় জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে সক্ষম।
ফ্রয়েডিয়ান ধারার সাইকোথেরাপিস্ট তার বইতে দেখিয়েছিলেন কীভাবে চার্লি চ্যাপলিন সহ অনেক বড় ব্যাক্তিদের জীবন ও কাজ নির্ধারীত হয়েছে তাদের চাইল্ডহুড ট্রমার প্রভাবে। এই পদ্বতিতে আমি হিমু চরিত্রটির সাইকোএনালিসিস করেছিলাম, আগ্রহীরা চাইল্ডহুড ট্রমার প্রভাব আরো বিস্তারিত বুঝতে ঐ লেখাটি পড়ে দেখতে পারেন। এছাড়া মানব জীবনে ট্রমার প্রভাব চিত্রায়িত হয়েছে শাটার আইল্যান্ড ফিল্মে, এটা নিয়ে লেখাটিও পড়তে পারেন।
অবচেতন
সাইকোএনালিসসের আরেক ভিত্তি হচ্ছে অবচেতন। মানুষের মাইন্ডকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এক হচ্ছে আমাদের চেতন স্বত্তা, যা মাইন্ডের খুব অল্প অংশ। টিপ অব দি আইসবার্গ। আর সবচেয়ে বিশাল ও বিস্তৃত অংশ হচ্ছে অবচেতন।
এই অবচেতন অংশই আমাদের কাজকর্ম, ভালো লাগা, মন্দ লাগা, রুচি, যৌনতা, ভায়োলেন্স সব নির্ধারন করে দেয়। অবচেতনে থাকা কোন ট্রমা বা ঘটনার প্রভাব চেতন স্বত্তায় তাই খুব বেশী।
অবচেতনের নিয়ন্ত্রণ অনেক ফিল্মে (এনিমি, নকটার্নাল এনিম্যালস , বিয়িং জন মালকোভিচ) সাহিত্যে চিত্রিত হয়েছে। গ্যেটে পর্যন্ত এর অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা রাখতেন, ফলে অবচেতনের আবিষ্কারক কিন্তু ফ্রয়েড না। ধারনাটি আগেই ছিল, ফ্রয়েড একে বিস্তৃত করেছেন, কাঠামো দিয়েছে। এরপর তার ছাত্ররা একে আরো বিস্তৃত করেছেন। অনেকে ফ্রয়েডের ধারণার চাইতে ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, যেমন বিখ্যাত ও খুবই গুরুত্বপূর্ন সাইকোলজিস্ট কার্ল গুস্তাব জাং বা ইয়ুং। এক বিতর্কের ধারাবাহিকতায় ফ্রয়েডের সাথে তার স্থায়ী বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল।
অবচেতনে থাকা আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা, কোন খারাপ অতীত অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করে এবং আমাদের বর্তমান জীবনে সেগুলো যে মারাত্মক বাজে প্রভাব ফেলছে, সে সম্পর্কে আমাদের সচেতন করে তোলার কাজটা করে সাইকোথেরাপি। এর মাধ্যমে আমাদের পথ তৈরী হয় পেইন বা বর্তমান বাজে অবস্থা থেকে মুক্তির।
যৌনতা
ফ্রয়েড হচ্ছেন সবচাইতে ভুল বুঝা হয়েছে এমন একজন চিন্তক। তিনি বলেছেন একজন মানুষের যৌনতা বা যৌনতা নির্ভর আনন্দ তার শিশুকাল থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত সময়ের উপর নির্ভর করে। শিশুকালে শিশুর মনে যৌনতার বোধ যখন তৈরী হয় তখনকার সময়ে কোন জটিলতা তার বড় জীবনের যৌন-সম্পর্কের ক্ষেত্রে জটিলতার তৈরী করে।
মানুষের মনে যৌনতা সম্পর্কে ধারণা তৈরী হয় বিপরীত লিঙ্গের তার পিতা-মাতাকে দেখে। এবং একসময় সে বুঝতে পারে ঐ ব্যক্তির সাথে যৌন সম্পর্ক তার জন্য সামাজিক ভাবে নিষিদ্ধ। ফলে এখানে যৌনতা বিষয়ে তার আকাঙ্খা এবং চেতনের অন্য অংশ থেকে বাঁধা এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব তৈরী হয়। এর মধ্য দিয়েই শিশুর নৈতিকতা বা মোরালিটি জন্মলাভ করে।
সঙ্গীর সাথে যৌনতার ক্ষেত্রেও তাই ব্যক্তির একই সাথে আকাঙ্খা, এবং একটা বাঁধা দুইই থাকে।
সাধারণত যৌনতার মূল লক্ষ্য ছিল পুনরোৎপাদন। কিন্তু মানুষ প্রাণী হিসেবে বিবর্তনের মাধ্যমে এই পর্যায়ে পৌছেছে যে তার যৌনতা কেবল পুনরোৎপাদনমুখী। বরং, শারীরিক, এবং এক্সট্যাসির বাইরে গিয়ে তার যৌনতা আধ্যাত্মিক স্তরেও পৌছে যায়। এই জটিল জিনিসটি তাই সাইকোথেরাপির সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন একটি জিনিস।
এখানে বেসিক সাধারণ কিছু কথা যৌনতা নিয়ে, নারী ও পুরুষের জন্য যৌনতা ও যৌন আকর্ষণ কিন্তু এক রকম নয়, সাধারণত। পুরুষ সাধারণত মনে করে যথেষ্ট সেক্স সে পাচ্ছেন না এবং খুঁজতে থাকে। পক্ষান্তরে নারীর কাছে শারিরীক মানসিক সম্পর্ক প্রথমে, পরে আসে সেক্স। পুরুষ সেক্স এর সাথে লাভ কে আলাদা করে দেখে কিন্তু নারী দুইটাকে এক করে দেখে। পুরুষ সাধারণত এক সঙ্গীতে তুষ্ট নয়, সে আরো খুঁজে। পক্ষান্তরে নারী এক সময়ে একজন সঙ্গীকেই চায়। নারীর ক্ষেত্রে সম্পর্কের আনন্দ ও পুনরোৎপাদন প্রধান গুরুত্ব পায়, সেক্স দ্বিতীয়।
এই সমস্ত বিষয় বিবেচনায়, এবং এ সংস্লিষ্ট আরো নানা ধর্মী জটিলতা ও সমস্যাকে বিবেচনায় নিলে, যৌনতাকে সহজ জিনিস বলার উপায় নেই। ফলে সাইকোএনালিসিসে তা বড় গুরুত্বপূর্ন স্থান পাবে তা স্বাভাবিকই।
প্রাথমিক নিয়ম
সাইকোথেরাপির প্রাথমিক নিয়মটি হলো পেশেন্টের মাথায় যে কথাটি আসে সেটা তার বলতে হবে, এবং এটাই সাইকোথেরাপি সফল হবার একমাত্র রাস্তা, ফ্রয়েডের কথায়। সে যদি যা মাথায় আসে তা না বলে তাহলে হবে না। এমন কিছু কথা আছে যা মাথায় আসলেও বলা যায় না সামাজিক কারণে, কিন্তু সাইকোথেরাপির বেলায় তা চেপে গেলে হবে না।
ফ্রয়েডের তত্ত্বকে সাইন্টিফিক্যালি ভুল ধরা হয় অনেক ক্ষেত্রেই। এবং এও মনে রাখতে হবে সাইন্স এখনো পূর্ন নয় এবং কখনোই হবে না। কিন্তু ফ্রয়েডকে ভুল ধরে নিলেও তিনি মারাত্মক প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ন হয়ে থাকে যে ক’টি কারণে এর মধ্যে একটি হতে পারে এই প্রাথমিক নিয়ম।
ফ্রয়েডই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি পেশেন্টকে নিয়ে তার রুমে বসতেন এবং তার মনে যা আসছে তা বলে যাবার পদ্বতি শুরু করেছিলেন। কনফিডেনশিয়ালিটি রাখা, এবং রোগীর এইসব কথা নাম পরিচয় সহ প্রকাশ না করার চর্চা তার।
নারীরা তার কক্ষে বসে এমন সব জিনিস নিয়ে কথা বলতে পারতেন যেগুলো তারা আর কোথাও পারতেন না। যেমন, রেপড বা মলেস্টেড হবার ঘটনা ইত্যাদি। এবং ফ্রয়েডই প্রথম ভেবেছিলেন সাইকোলজিক্যাল সমস্যাগুলি মানবিক ভাবে চিকিৎসা করা সম্ভব।
ফিল্মে যারা দেখেছেন সাইকোথেরাপিস্টদের তারা হয়ত জানেন, পেশেন্টের যেকোন ধরণের কথা শোনার সময় সাইকোথেরাপিস্টেরা নৈতিক বিচার করতে যান না। তারা কেবল শুনে যান। মানুষ যখন দেখে তার অন্ধকার গল্পগুলি স্বাভাবিক ভাবে নিচ্ছেন একজন তখন সে আস্তে আস্তে আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়। সপ্রানোজ টিভি সিরিজে টনি সপ্রানো’র কথা এক্ষণে মনে পড়লো। বা ডনি ডার্কোর ডনি।
প্যারাপেক্সেজ বা ফ্রয়েডিয়ান স্লিপ
এটা একটা মজার জিনিশ। অনেক সময় আমরা মানুষ বা বস্তুর নাম ভুলে যাই, স্লিপ অব টাং হয়, চ্যাটে একটা লিখতে গিয়ে আরেকটা লিখে ফেলি, পাসওয়ার্ড ভুলে যাই, মিটিং এর টাইম বেমালুম ভুলে যাই, কয়েন নিয়ে হুদাই টস করতে থাকি ইত্যাদি ইত্যাদি অতি সাধারণ কর্মকান্ড।
ফ্রয়েডের মতে এগুলি সাধারন নয়। এর পেছনে আছে অবচেতনে থাকা নানা জিনিসের সংকেত।
ফ্রয়েডিয়ান স্লিপ স্টাডির উদ্দেশ্য তা দূর করা তেমন নয়, বরং নিজের সম্পর্কে আরো বেশী জানা, যে ভেতরে আসলে কী হচ্ছে। কী কারণে এইসব সামান্য ভুল বারবার হচ্ছে এবং ঐ কারণটি বড় হলে তা বিষয়ে সচেতন হওয়া।
চলবে, আগামী পর্বে শেষ করব। নিজের উপর মনঃসমীক্ষণ করার ব্যাপারে একটি বড় লেখা আছে এই ব্লগে, এটা পড়তে পারেন।
ফ্রয়েড বিষয়ে সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর
ফ্রয়েড ছিলেন একজন জার্মান সাইকোএনালিস্ট। তিনি মানসিক রোগের চিকিৎসা করতেন। তার জন্ম অস্ট্রিয়ায়।
একটি মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব এবং থেরাপির প্রক্রিয়া। এটি মানুষের চিন্তার চেতন ও অবচেতন স্বত্তার ক্রিয়াকলাপ ও সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে মানসিক সমস্যা সমাধান ও আচরণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে।