রাজা বল্লাল সেন একবার ঠিক একরলেন মানুষের উপকারের জন্য দীঘি খনন করাবেন। সেই দীঘির আকার কেমন হবে তা ঠিক করতে তিনি এক অদ্ভুত উপায়ের সাহায্য নেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তার মা না থেমে একনাগারে হেঁটে যতদূর যেতে পারবেন, সে সমস্ত অঞ্চল নিয়েই খনন করা হবে দীঘি। তিনি প্রতীজ্ঞা করলেন এক রাতের মধ্যেই সেই দীঘি খনন করা হবে।
রাজার মা ছিলেন বৃদ্ধ। রাজা ভেবেছিলেন মা সারাজীবনে খুব অল্প পথই হেঁটেছেন, হয়ত তিনি বেশীদূর যেতে পারবেন না।
এদিকে রাজার মা কীভাবে যেন জানলেন তিনি যত বেশী হাঁটবেন তত প্রজাদের মঙ্গল হবে, তারা সাহায্য পাবে।
রাজমাতার দয়ার হৃদয়। তিনি হাঁটা শুরু করলেন। সেই হাঁটা আর থামে না। তিনি চলতেই থাকলেন।
রাজমাতার এই চলা দেখে বল্লাল সেন চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এভাবে যদি তিনি চলতেই থাকেন ও না থামেন, তাহলে তো সেই দীঘি খনন করতে মহাসমস্যায় পড়তে হবে। একরাতের মধ্যে অত বড় দীঘি খনন সম্ভব হবে কী করে?
মরিয়া হয়ে রাজা এক ফন্দি আঁটলেন। তিনি একজন কর্মচারীকে বললেন, যাও রাজমাতার পায়ে এক ফোঁটা সিঁদুর কৌশলে দিসে আসো গে।
কর্মচারীটি কুর্নিশ করে বলল, যথাহুকুম মহারাজ।
কর্মচারীটি রাজার আদেশ পেয়ে লাল সিঁদুর নিয়ে গেল, এবং রাজমাতা যখন হাঁটছেন তখন সুকৌশলে তার পায়ে সিঁদুর ফেলে দিল।
রাজমাতা লাল রঙ দেখে ভাবলেন হয়ত জোঁকে ধরেছে পায়ে। তিনি নিচু হয়ে দেখতে লাগলেন, আর সেই সময়ে থেমেও গেলেন। সুতরাং, এই পর্যন্ত নির্ধারীত হলো দীঘির সীমানা।
বিপুল জনবল নিয়োগ করলেন বল্লাল সেন, একরাতের মধ্যে দীঘি খননের জন্য। যে পর্যন্ত রাজমাতা হেঁটেছিলেন তাও বিশাল। এক মাইল দীর্ঘ। রাজার লোকেরা এক রাতের মধ্যেই খনন করে ফেললো দীঘি।
দীঘি খনন সমাপ্ত হলে বল্লাল সেন লোকদের বললেন একটা জায়গা থেকে এক কোদাল করে মাটি তুলতে। খনন কাজে নিয়োজিত সব লোক এক কোদাল করে মাটি তুললো। এত লোক খনন কাজে যুক্ত ছিল যে সেই এক কোদাল করে মাটি তোলা আরেকটি ছোট দীঘির তৈরী করল। সেই দীঘির নাম হলো কোদাল ধোওয়া দীঘি।
এখন, প্রথম খনন হওয়া দীঘিতে একটি সমস্যা দেখা দিল। খনন হলেও পানি উঠছে না। বল্লাল সেন মহাচিন্তিত হলেন। তিনি তার বিদ্বান, পরম ধার্মিক বন্ধু রামপালকে জিজ্ঞেস করলেন, কী বিত্তান্ত রামপাল?
রামপাল স্বপ্নযোগে জানতে পারলেন বল্লাল সেনের চালাকি দেবতারা পছন্দ করেন নি। তাই পানি উঠছে না। রাজার প্রিয় বন্ধু রামপাল যদি দীঘিতে নামেন তাহলে তার আত্মাহুতির মাধ্যমে দীঘিতে পানি আসবে।
রামপাল বন্ধুকে সব বললেন, এবং কাউকে আপত্তি জানানোর সুযোগ না দিয়ে, নেমে গেলেন দীঘিতে। মাটি ফুঁড়ে কলকল শব্দে জলরাশি এলো, ভরে গেল দীঘি। সেই থেকে দীঘিটির নাম হলো রামপালের দীঘি।
জনতা আর্তনাদ করে উঠল, রামপাল! রামপাল! হায় রামপাল!।
এই গল্পটি একটি প্রচলিত লোকমুখের গল্প। এটিসহ প্রাচীন সমৃদ্ধশালী ঢাকা শহরের অনেক লোকমুখের গল্প, ও ইতিহাস রয়েছে প্রাচ্যের রহস্য নগরী বইতে। বইটি লিখেছেন ব্র্যাডলী বার্ট, ১৯০৬ সালে। ইংরাজি নাম রোমান্স অব এন ইস্টার্ন ক্যাপিটাল। এর অনুবাদ করেছেন, সুন্দর বাংলায়, রহীম উদ্দীন সিদ্দিকী। এই বইটি প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি।
এই লোকমুখের গল্পটি রেনে জিরার্দ বর্নিত স্কেইপগোট মেকানিজমের দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়।
সেই ব্যাখ্যা হয় এইরকম, এই লোকমুখের গল্পটি সম্ভবত একটি সত্যিকার কাহিনীর উপর ভিত্তি করে তৈরী। আসলেই সেখানে একজন লোককে মরতে হয়েছিল দীঘি খননের কালে। কিন্তু যেভাবে বলা হচ্ছে লোকমুখের গল্পে তার মৃত্যু এরকম ছিল না।
রামপাল নামক ব্যক্তিটিকে কোন দোষে অভিযুক্ত করে, অথবা পানি আনার জন্য দীঘি খননের পূর্বে বা পরে কোন রিচুয়ালের অংশ হিসেবে উৎসর্গ করা হয়।
দীঘি খননের পর যখন পানি আসে, তখন এতে অনেক লোকের উপকার হয়। তারা ঐ উৎসর্গীত ব্যক্তি রামপালের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করতে থাকে।
তারা মনে করতে থাকে তার মৃত্যুই প্রকারন্তরে দীঘিতে পানি এনে দিয়েছে।
ফলে সে শ্রদ্ধার সাথে স্মরিত হয়, এবং দীঘির নাম হয় রামপালের দীঘি।
তার মৃত্যুটি যেহেতু স্কেইপগোটারদের তথা জনতার দ্বারা সংগঠিত এক হত্যাকান্ড ছিল, (বা রাজার দ্বারা সংগঠিত হলেও জনতার তাতে পূর্ন সায় ছিল) তাই এটির মূল কাহিনী বদলে প্রচলিত লোকমুখের গল্পটি বানিয়েছে মানুষেরা।