সাইকোলজিঃ আমাদের ভুল সিদ্ধান্তের মূলে যে ২৮ টি বিষয় কাজ করে

এই ২৮ কারণ চার্লি মাঙ্গার তার সাইকোলজি অব হিউম্যান মিস জাজমেন্ট লেকচারে বলেছিলেন অনেক আগেই, ১৯৯৫ সালে।

চার্লি মাঙ্গার একজন ইনভেস্টর, ওয়ারেন বাফেটের পার্টনার, এবং মাল্টি ডিসিপ্লিনারি নলেজের চর্চাকারী, লাইফ লং লার্নিং এর ভেতর দিয়ে যেতে যেতে তিনি একজন বিখ্যাত এক্সপার্ট জেনারালিস্ট।

এক্সপার্ট জেনারালিস্ট কারা?

এমনিতে একটি ধারণা আছে কোন বিষয়ে বিশ্ব সেরা এক্সপার্ট হতে গেলে ঐ বিষয়ের উপর দশ হাজার ঘন্টা ব্যয় করতে হয়। এটি জনপ্রিয় করেন লেখক ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল। এই নিয়মের ব্যতিক্রম আরেক পন্থা হলো এক্সপার্ট জেনারালিস্ট।

ব্রেইন এন্ড কোং এর চেয়ারম্যান অরিত গ্যাদিয়েশ এই টার্মটি ব্যবহার করেন। তার সংজ্ঞায় এক্সপার্ট জেনারালিস্ট

যারা বিভিন্ন ডিসিপ্লিন থেকে নলেজ সংগ্রহ করেন এবং এগুলি মিলান।

ফোকাস গভীর রাখেন ও চিন্তাকে নিঁখুত করে তোলেন।

আমরা যে বাস্তবতায় বাস করি তা কোন এক ফিল্ডের নিয়মে চলে না। কেবল রসায়ন বিদ্যা দিয়ে বাস্তবে ঘটতে থাকা কোন সমস্যা, যেমন টিলাগড় পয়েন্টে রাজনৈতিক দুই ছাত্র সংঘটনের মারামারি ব্যাখ্যা করা যাবে না। কেবল পদার্থবিদ্যা দিয়ে ঘটনাটি যাবে না বুঝা। কিন্তু, সাইকোলজি, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদি নানা ফিল্ডের জ্ঞাণ থেকে ঘটনাটি বুঝার চেষ্টা করলে বুঝা যেতে পারে।

Developing the habit of mastering the multiple models which underlie reality is the best thing you can do. — Charlie Munger

চার্লি মাঙ্গার বিগ ফিল্ডের বিগ থিওরী নিয়ে একটি মেন্টাল মডেল তৈরীর উপর জোর দেন, এবং এই টুলবক্স নিয়মিত চিন্তা কাজে ব্যবহার করতে বলেন।

এই সাইকোলজি অব হিউম্যান মিসজাজমেন্ট লেকচারে মাঙ্গার মানুষের কিছু সাইকোলজিক্যাল বায়াস এর কথা উল্লেখ করেছেন, এগুলি মানুষকে ভুল বিচারে উদ্বুদ্ধ করে বা ভুল সিদ্ধান্ত নেবার পেছনে কাজ করে।

এই তালিকা একটী চেকলিস্ট। এই চেকলিস্ট আপনি যদি সংরক্ষণ করে রাখেন, ও নিয়মিত পড়েন, মনে রাখেন তাহলে অনেক কম মিস-জাজমেন্ট করবেন।

স্মার্টনেস মানে নিজে নিজে বসে বুদ্ধি বের করা না, মাঙ্গারের কথায় এমন স্মার্ট আসলে কেউ না। স্মার্টনেস হলো আপনার আগে অন্য গ্রেট মানুষেরা কী কী বের করে গেছেন তা খুঁজে বের করা, শেখা ও কাজে লাগানো।

মাঙ্গারের কোন সাইকোলজির বা ইকোনমিক্সের ডিগ্রি নেই। তিনি এই কারণগুলি বের করেছেন সাইকোলজির বিভিন্ন বই থেকে, ও জ্ঞান দর্শনের অন্যান্য অনেক বই থেকে, এর সাথে যুক্ত হয়েছে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। এটা হলো মাল্টি ডিসিপ্লিনারি নলেজ এপ্রোচ। বিভিন্ন ফিল্ডের নলেজ ব্যবহার করা।

ফিল্ডগুলো মানুষ আলাদা ভাগ করেছে কারণ সে মনে করেছে একজনের পক্ষে সব ফিল্ডে যাওয়া সম্ভব নয়, বা শেখা সম্ভব নয়। একদিক থেকে এটা ঠিক। সাধারণ কেউ একজন একইসাথে এক্সপার্ট ডাক্তার, এক্সপার্ট ইঞ্জিনিয়ার ও এক্সপার্ট ভূগোলবিদ হতে হয়ত পারবেন না।

কিন্তু এই ভাগ বিভাজন মানুষের তৈরী। ন্যাচার তথা পৃথিবী এমন ভাগ ভাগ হয়ে কাজ করে না। পৃথিবীর কোন ঘটনা এক নলেজ ফিল্ড দিয়ে ব্যাখ্যা তাই দুরূহ। বরং এই ঘটনায় নানা ফিল্ডের প্রভাব থাকবে।

আপনি আমি ফিল্ডগুলিতে এক্সপার্ট হতে চাই না। এক্সপার্ট তারা আছেন যারা ঐসব ফিল্ডে গবেষণা করছেন, জ্ঞান তৈরী করছেন। আমরা আমাদের দরকার মত বড় ফিল্ডের বড় আইডিয়াগুলো জেনে নিতে পারি। এবং এই জানা আমাদের পৃথিবীর কোন ঘটনা ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।

ভুল সিদ্ধান্ত ও ভুল বিচারের কারণগুলো অল্প কথায় এখানে রাখলাম।

 

১। কাকতালীয় মিলঃ

সুন্দর ব্যক্তি মানে তার ভালো গুণ আছে। অসুন্দর ব্যক্তি মানে তার খারাপ দোষ আছে।

ভালো কোন জিনিসের সাথে যুক্ত থাকলে ঐ জিনিসকেও ভালো মনে করি, খারাপ জিনিসের সাথে যুক্ত থাকলে খারাপ।

একই ধরনের সিচুয়েশনকে একই রকম সিচুয়েশন বলে ভ্রম হয় আমাদের। এ নিয়ে আগের একটি লেখা থেকেঃ

এরকম এক বড় কাকতাল আবিষ্কার করেছিলেন একজন বড় মনোবিজ্ঞানী। তার নাম আইভান পাভলভ। কুকুরদের নিয়ে তিনি গবেষণা করছিলেন। খাবার দিলে তাদের মুখে কী পরিমাণ লালারস জমে এসব ব্যাপার স্যাপার। পাভলভ দেখলেন, তিনি কক্ষে ঢুকলেই তার কুকুরদের মুখে লালা চলে আসছে। এমনকি হাতে খাবার নিয়ে না আসলেও লালা ঝরতে থাকে। ব্যাপার কী তা তিনি বুঝতে চাইলেন। এরপর কুকুরদের খাবার দিতে শুরু করলেন একটি নির্দিষ্ট ঘণ্টা বাজিয়ে। তিনি লক্ষ্য করলেন, ঘণ্টা বাজালেই কুকুরদের মুখে লালা চলে আসে, এমনকী খাবার না দিলেও।

এই পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি দিলেন তার ক্লাসিক্যাল কন্ডিশনিং তত্ত্ব। অর্থাৎ কিছু ব্যাপার আছে যা ঘটলে অন্য আরেকটি ঘটনা ঘটে; যেমন, ঘণ্টা বাজলেই কুকুরের মুখে লালা চলে আসে বা লোকে একটি ঘটনার সাথে আরেকটি ঘটনা মিলিয়ে দেখে। এই ক্লাসিক্যাল কন্ডিশনিংয়ের ব্যাপার আমাদের মধ্যেও আছে। বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে বড় বড় কোম্পানিগুলো তা ব্যবহার করে। যেমন, কোনো আনন্দ উৎসব, খেলাধুলা ইত্যাদিতে যে ব্র্যান্ডগুলো স্পন্সর করে, মানুষেরা তাকে ঐসব ঘটনার সাথে মিলিয়ে দেখে। আবার কোনো শোকের দিন, বড় মানুষের মৃত্যুশোক ইত্যাদিতে যারা স্পন্সর করে, তাদেরকে ঐসব ঘটনার সাথে মিলিয়ে দেখবে মানুষ।

অনেক ক্ষেত্রে আরো মারাত্মকভাবে মেলানো হয়। যেমন, প্রাচীন পারস্যে রাজাদের কাছে খারাপ সংবাদ নিয়ে যেত যে দূত, তাকে মেরে ফেলা হতো। অলক্ষুণে বলে একটি শব্দ প্রচলিত আছে। ঘর থেকে বের হবার পরে একজন লোককে দেখলেন, দেখার পরপরই কলার খোসায় বিরাট এক আছাড় খেলেন। তখন ভাবলেন, ঐ লোকের মুখ দেখে বের হয়েছিলাম, তাই আজ আমার এই দশা। এছাড়া, আগেকার বাংলা ফিল্মে দেখবেন খারাপ সংবাদ নিয়ে আসলে ভিলেন কীভাবে তার দলের লোকদের গুলি করে মারে।

কিন্তু এসব ক্ষেত্রেই আমরা ভুলভাবে বিচার করি। বাস্তবে দুই ঘটনার মিল নেই, এরা কাকতাল মাত্র। যে খারাপ খবর নিয়ে আসছে সে দোষী না। আপনি যদি পারস্যের প্রাচীন রাজাদের মতো এমন হন যে লোকে আপনাকে দুঃসংবাদ দিতে ভয় পায়, তাহলে আপনি কিছু বড় সমস্যায় পড়তে পারেন। ধরা যাক, আপনার ব্যবসা আছে, গুদামে আগুন লেগেছে, কর্মচারীরা দুঃসংবাদ দিতে ভয় পেলে সংবাদ পেতে পেতেই আপনার গুদাম পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারে। তাই কোনো প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার হলে আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে যেন কর্মীরা দুঃসংবাদ আপনার কাছে আগে আগে পৌঁছায়। ওয়ারেন বাফেট তার কর্মচারীদের বলেন, তোমাদের কাজ হলো যত দ্রুত পারা যায় দুঃসংবাদ আমাদের কাছে পৌছে দেয়া। সুসংবাদ নিয়ে ভাববে না। কারণ সুসংবাদ এমনিতেই পৌঁছাবে আমাদের কাছে, দেরীতে পৌঁছলেও সমস্যা নেই।

তাছাড়া, কোনো ব্যবসায়ী না হলেও আপনার এ বিষয়ে নজর থাকলে ভালো। অহেতুক কোনো মানুষকে অলক্ষুণে, অপয়া ইত্যাদি বলার মতো অন্যায় থেকে বিরত থাকতে পারবেন তাহলে। তাতে নিজের লাভও হতে পারে। যেমন, বেশী দাম মানেই ভালো জিনিস এমন একটি ব্যাপার আমাদের মধ্যে আছে। পাভলভের কুকুরের মতো আমরা এটা শিখেছি যে বেশী দাম হলে জিনিস ভালো হয়। আসলেও সাধারণত এমনই হয়। কিন্তু আমাদের এই প্রবণতার সুযোগ নিতে পারে কোনো অসাধু ব্যবসায়ী। বাড়িয়ে দিতে পারে একটি পণ্যের দাম অন্যটির চাইতে, কেবলমাত্র আমাদের ঠকাতে। এক্ষেত্রে ভালো দাম মানেই ভালো জিনিস এই অন্ধ বিশ্বাস এর চাইতে গুণমান বিচার করে ভালোমন্দ বিচারই শ্রেয়।

 

২। পুরস্কার ও শাস্তিঃ

মানুষ সেইসব জিনিস করতে চায় যেখানে সে পুরস্কার পাবে, সে সব জিনিস থেকে বিরত থাকতে চায় যেখানে সে শাস্তি পাবে।

একেবারে সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ন কথা। চার্লি মাঙ্গার এটাকে সবচাইতে গুরুত্ব দিয়ে দেখেন। এটা কীভাবে মিস-জাজমেন্ট এর কারণ হতে পারে? ধরা যাক, কোথাও আপনার লাভ হলো, অর্থাৎ রিওয়ার্ড পেলেন, সেখানে পরবর্তীতে আপনি অন্ধের মত ঝুঁকি নিতে পারেন।

কোথাও লস হলো, মানে শাস্তি, সেখানে পরে আরেকটি ভালো সুযোগও আপনার কাছে মনে হবে বেশী ঝুঁকিপূর্ন।

এছাড়া, যখন আপনি ম্যানেজমেন্টে আছে, কিছু লোক আপনার অধীনে কাজ করছে, তাদের যদি পুরস্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা না রাখেন, তাহলে সমস্যায় পড়তে পারেন।

এছাড়াও কোন ঘটনা পর্যবেক্ষণে আপনি যদি তাত্ত্বিক ভাবে দেখতে যান, ও ঐ লোকদের ব্যক্তিগত স্বার্থ (পুরস্কার) না দেখেন তাহলে আসলে কেন তারা কাজটি করেছে তা বুঝতে পারবেন না। ভুল বুঝবেন।

আমেরিকান লেখক আপটন সিনক্লেয়ার বলেছিলেন,

 “It is difficult to get a man to understand something, when his salary depends on his not understanding it.”

 

 

 

শাস্তি বিষয়ে সান জু, জর্জ ওয়াশিংটন ও মুজতবা আলী’র বর্ননা থেকে

 

শাস্তির ক্ষেত্রেও সান জু কঠোর নীতি অবলম্বণ করতে বলেন। তার সম্পর্কে একটি কথিত গল্প এমন, তার বই পড়ে ওউ এর রাজা হো লু তাকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে গেলেন। তাকে বললেন, একটি মহড়া দেখাতে। তবে সেখানে সৈন্য হিসেবে থাকবে রাজার নর্তকীরা।

সান জু এতে রাজী হলেন। তিনি রাজার হেরেমের একশো আশি জন নর্তকীকে দু’ভাগ করে কীভাবে কী করতে হবে তা বুঝিয়ে দিলেন। কিন্তু নর্তকীরা হাসে। সান জু তাদের কমান্ড দিলেন। তারা হাসে। সান জু আবার তাদের বুঝালেন। এভাবে পাঁচবার বুঝানো হলো। কিন্তু নর্তকীরা কমান্ড শুনে হেসে গড়াগড়ি খায়।

তখন সান জু নির্দেশ দিলেন, দুই নর্তকী দলের নেত্রীর শিরোচ্ছেদের। পাঁচ বার বুঝানোর পরও যখন কমান্ড মানা হচ্ছে না তখন দোষ দুই দলের দলনেত্রীর।

রাজা তো তখন প্রিয় দুই নর্তকীর মাথা যাবে দেখে বাঁধা দিতে এলেন। কিন্তু সান জু কি আর শুনেন তার কথা! সান জু সাফ জানিয়ে দিলেন, সেনাপতি সেনাবাহিনী চালাতে গিয়ে রাজার সব আদেশ মানতে বাধ্য নন।

সত্যি সত্যিই দুই নর্তকী নেত্রীর মাথা গেল। এরপরে দেখা গেল সবাই ঠিক। সান জু’র আদেশ দিতে দেরী হয়, নর্তকীদের আদেশ পালনে দেরী হয় না। পানিশম্যান্ট বা শাস্তি যে এভাবে কাজ করে তা নতুন কথা নয়। সান জু’র এই গল্পটি কথিত বলে আছে, এরকম সত্যি নাও হয়ে থাকতে পারে। তবে ইতিহাসে নানা সময়ে মারাত্মক অনেক শাস্তির বিবরণ পাওয়া যায়, যেগুলি দেওয়া হত অপরাধীকে কেবল কষ্ট দিতেই নয়, অন্যদের একই ধরনের অপরাধ থেকে বিরত রাখতে। প্রসঙ্গত এখানে স্মরণ করা যায় জর্জ ওয়াশিংটন সৈন্যদল থেকে পালিয়ে যাওয়া একটি খামার বালককে চল্লিশ ফিট উঁচুতে তুলে ফাঁসি দিয়েছিলেন। এই চল্লিশ ফিট উঁচুতে তোলার কারণ হল অন্যেরা যাতে ভয়ে এই কাজ আর না করে।

শাস্তির আরেকটা ঘটনা আছে সৈয়দ মুজতবা আলীর পঞ্চতন্ত্রে। আঠারো শতকে একবার গুজরাতে দূর্ভিক্ষ দেখা দিল। পর পর কয়েকমাস বৃষ্টি না হওয়ায় এই অবস্থা। লোকেরা খাদ্যের আশায় আহমেদাবাদ যাচ্ছে, পিতামাতারা সন্তানদের বিক্রি করে দিচ্ছে এমন অবস্থা। গুজরাতের সুবাদার তখন আহমেদাবাদের সবচেয়ে ধনী শ্রেষ্ঠীকে ডাকিয়ে আনলেন পরামর্শের জন্য। শ্রেষ্ঠীরা জৈন ধর্মের লোক এবং ব্যবসা বাণিজ্য করে অনেক ধনী। ধনী শ্রেষ্ঠী এলে সুবাদার তার কাছে পরামর্শ চাইলেন। শ্রেষ্ঠী বললেন মালওয়া অঞ্চলে প্রচুর ফসল হয়েছে। অনেক গম পাওয়া যাবে। আমি তা আনতে পারব। কিন্তু দুইটা শর্ত মানতে হবে।

সুবাদার বললেন কী শর্ত।

শ্রেষ্ঠী জানালেন যেহেতু দুই প্রদেশে দূর্ভিক্ষ চলছে তাই মাল লুঠ হবার সম্ভাবনা আছে অতএব সাথে ফৌজ পাঠাতে হবে।

দ্বিতীয় শর্ত, গম আনার পর তিনি যে দামে বলবেন মুদিরা যেন সে দামে বিক্রি করে। কেউ বেশী দাম নিলে তাকে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।

সুবাদার সানন্দে রাজী হলেন।

শ্রেষ্ঠী তার সঞ্চিত অর্থ নিয়ে গেলেন গম আনতে। তার সাথে গেল ফৌজ। তিনি গম আনলেন নিরাপদেই। এবং এনে কেনা দামেই তিনি ছেড়ে দিলেন মুনাফা ছাড়াই। অনেক লাভ করেছেন জীবনে, এই দুর্ভিক্ষের কালে তার লাভ করার ইচ্ছা ছিল না। নির্দিষ্ট দাম বেঁধে দিলেন এবং যাতে কেউ মজুত করে রাখতে না পারে এজন্য হিসাব করে মুদিদের দিলেন গম। কিন্তু এত সতর্কতা স্বত্ত্বেও দু’জন মুদি বেশী দাম নিচ্ছিল। শ্রেষ্ঠী খবর পেয়ে চটে গেলেন। তিনি তাদের এই হীন কর্মের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেলেন সুবাদারের বাড়ি। গিয়ে বললেন, এদের বিহিত করুন।

সুবাদার আদেশ দিলেন মুদি দু’জনের পেট কেটে দেয়ার জন্য। পেট কাটা হল। তাদের নাড়ি ভুড়ি বের হয়ে গেল। এই অবস্থায় সুবাদার নির্দেশ দিলেন শহরের সবচেয়ে উঁচু দুই উটের পিঠে লাশ দুটি বেঁধে সারা শহর প্রদর্শনের জন্য। সমস্ত রাত ধরে এই কাজ করা হয়েছিল।

এটা করা হয়েছিল যাতে এই ধরনের কাজ আর কেউ করতে সাহস  না পায়। মুজতবা আলী তার লেখায় জানাচ্ছেন, ঐ ইতিহাসিক যিনি এই ঘটনা লিখেছিলেন তিনি জানিয়েছেন এরপর থেকে অধিক মুনাফার জন্য আর কেউ বেশী দাম নেয়ার সাহস পায় নি।

এখন আপনি নিশ্চয়ই এমন মারাত্মক সব শাস্তি দিতে পারবেন না ম্যানেজার হিসেবে, বা দেয়া উচিত হবে না। কিন্তু ভিন্ন ভাবে আপনারে এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে কেউ নিয়ম ভাঙলে সাজা পায় কোনভাবে। আর আরেকটা ব্যাপার এখানে গুরুত্বপূর্ন, শিশুদের ব্যাপারে শাস্তি দান থেকে বিরত থাকুন, এতে আসলে তাদের ক্ষতি হয়। এক্ষেত্রে কীভাবে শিশুকে নৈতিক করে গড়ে তুলবেন লেখাটি পড়তে পারেন।

 

পুরস্কারের বা আর্থিক প্রণোদনার ক্ষমতা বিষয়ে ফেডারেল এক্সপ্রেসের ঘটনাটি

 

ফেডারেল এক্সপ্রেসের প্যাকেজ এক জায়গায় প্রতি রাতে শিফট হবে, এর উপরই তার কাজের সততা নির্ভর করে। সময়মতো পুরো শিফট ডেলিভারি না হলে কিন্তু তাদের এই কর্ম সততাটা আর রইল না। কিন্তু সংস্থাটি মারাত্মক সমস্যায় পড়লো। যারা কাজ করছিলো তারা সময়মতো মাল নিয়ে যাচ্ছে না, দেরী হয়ে যাচ্ছে। নানা ধরণের পদক্ষেপ নিল তারা, নৈতিক ভাবে কর্মচারীদের বুঝানোও হল। কিন্তু কিছুই কাজ করলো না। পরে একজন বুঝতে পারলেন রাতে কাজ করা লোকদের ঘন্টা হিসেবে টাকা দেয়া হচ্ছে। এর চাইতে শিফট ভিত্তিক টাকা দিলেই হয়। টাকার জন্য সবাই দ্রুত কাজ করবে।  এটা চালু করা হলো এবং দেখা গেলো ব্যাপারটা কাজ করছে।

আর্থিক প্রণোদনা বিষয়ে জেরক্সের উদাহরণ

 

জেরোক্সের প্রাথমিক সময়ে একজন কর্মকর্তা জো উইলসন দেখলেন তাদের বাজে মেশিনটি বেশী বিক্রি হচ্ছে ভালোটির চাইতে। তিনি এর কারণ বুঝতে পারলেন না। পরে বাজারে গিয়ে যাচাই করে দেখলেন তাদেরই বাজে মেশিনের কমিশন বেশী, তাই সেলসম্যানরা এটি বেশী বিক্রি করছে। ফলে ভালোটা চলছে না।

 

 

 

৩। ব্যক্তিস্বার্থ ও আর্থিক প্রণোদনার শক্তিকে অগ্রাহ্য করাঃ

 

আমরা ব্যক্তিস্বার্থ ও আর্থিক প্রণোদনার (ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লাভ কী এখানে) ব্যাপারটা মাথায় না রেখেই অনেক সময় ঘটনা বুঝতে যাই।

মাঙ্গার বলেন, আর্থিক প্রণোদনার ক্ষমতা নিয়ে ভাবার সময়, কখনো, কখনোই অন্য কিছু নিয়ে ভাববেন না।

 

 

৪। আমাদের সেলফ-সার্ভিং বায়াসঃ

 

আমি কি ভুল? আমি ভুল হলে কে তা বলতে পারবে?

আমাদের সেলফ-সার্ভিং বায়াস মারাত্মক। আমরা আমাদের জ্ঞানকে, আমাদের আইডিয়াকে বড় করে দেখি। আমরা অতি-আত্মবিশ্বাসী হই। যেন আমরা অতি বুদ্ধিমান বা অতি বুদ্ধিমান হতে চাই। প্রাসঙ্গিক লেখা, যে কারণে অল্পবুদ্ধিরা বুঝতে পারে না তারা অল্পবুদ্ধি।

 

কিন্তু আমাদের, নিয়মিত ভাবে কম স্টুপিড বা কম গর্দভ হবার চেষ্টা করা উচিত, অতি বুদ্ধিমান হবার চাইতে।

মাঙ্গার বলেন, “আপনার কোন কাজ খারাপের চাইতে বেশী ভালো করবে এমন মনোভাব এবং এ নিয়ে খুবই আত্মবিশ্বাসী হওয়ার বিরুদ্ধে আমি। আপনি যা নিয়ে কাজ করছেন (পৃথিবী) তা অত্যন্ত জটিল সিস্টেম যেখানে সব কিছুই একে অন্যের সাথে যুক্ত।”

সেলফ সার্ভিং বায়াস আরো কাজ করে যখন আমরা নিজের দোষ দেখতে পাই না। বরং কাজটির পক্ষে নানা যুক্তি হাজির করতে থাকি।

চার্লি মাঙ্গারের প্রজ্ঞা নির্ভর বই পুওর চার্লি’জ অলমানাকে আছে এই ঘটনা।

এক ছেলে একবার তার বাপের এমপ্লয়ীর ঝুঁড়ি থেকে দুটা চকলেট নিয়ে বলল, “পরে দুইটা রেখে দিব।”

বাচ্চা ছেলে, তার বয়স কম।

তার বাবার নজরে পড়ছিল ঘটনাটা। বাপ ছেলে বললেন, “ তুমি ঐ ঝুঁড়ি থেকে যত ইচ্ছা চকলেট নিতে পারো। কিন্তু প্রত্যেকবার নিবার সময় নিজেরে বলবা, “আমি একটা চোর।”

এই পিতা তার পুত্রকে দারুণ এক শিক্ষা দিয়েছিলেন। অপরাধ করে অন্য নামে তা জায়েয না করার শিক্ষা। পোলা পরে একটা মিউজিক ইস্কুলের ডীন হন। পঞ্চাশ বছর পরেও তিনি এ শিক্ষা মনে রাখেন এবং তার এক বন্ধুকে বলেন। সেই বন্ধু, চার্লি মাঙ্গার। মাঙ্গার তার লেখায় এই ঘটনার উল্লেখ করেন এবং তিনি তলস্তয় ইফেক্টের কথা বলেন। তলস্তয় ইফেক্ট হচ্ছে অপরাধী অপরাধ করে যখন নানা অজুহাত দেখিয়ে তার সেই কৃত অপরাধের ন্যায্যতা দিতে চায়। চার্লি মাঙ্গার বলেন তলস্তয়ের উপন্যাসে দেখা যায় অপরাধীরা হয় তারা বলে তারা অপরাধটি করেই নি, অথবা তারা বলে তারা যে কঠিন অবস্থায় ছিল তাতে সেই অপরাধ করতে হয়েছে।

অপরাধী’রা এটা করে নিজের অপরাধবোধ থেকে বাঁচতে এবং নিজের কাছে নিজেকে ভালো হিসেবে রাখতে। কিন্তু ভিন্ন নামে অপরাধ করলে, তা কখনোই ন্যায্য বা ঠিক কাজ হয়ে উঠে না। অপরাধীর এটা এক ডিফেন্স মেকানিজম, যেমন ছোট বাচ্চাটি চকলেট সরিয়ে নেবার সময় চুরিকে ভিন্ন নামে ডেকে বুঝাতে চেয়েছিল সে চুরি করছে না। একজন প্রজ্ঞাবান পিতা তার ছিলেন বলে সে ছোটকালেই তার ভুলটা বুঝতে পেরেছিল।

তো আমরা এভাবে অপরাধকে বা ভুল কাজকে, ভুল সিদ্ধান্তকে ভিন্ন নামে ডেকে, ভিন্ন পদ্বতিতে দেখে ঠিক মনে করতে পারি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আত্ম-প্রতারণা এবং এতে কোন লাভই নাই।

জর্জ ওরওয়েল চমৎকার ভাবে বলেছেন,

আমরা এমন জিনিস বিশ্বাস করতে সক্ষম যেগুলি আমরা জানি অসত্য, এবং আমরা শেষপর্যন্ত ভুল প্রমাণিত হলে, ফ্যাক্ট বদলে দিয়ে দেখাতে পারি যে আমরা আসলে ঠিক ছিলাম। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে এটা অসংখ্য বার করে যাওয়া সম্ভব, কিন্তু ঘটনা হচ্ছে শীঘ্র হোক বা দেরিতে হোক, একসময় নিরেট বাস্তবতা আমাদের ভুল বিশ্বাসের বিরুদ্ধে এসে উপস্থিত হয়, সাধারণত একেবারে যুদ্ধক্ষেত্রে বা শেষসময়ে।

 

 

৫। আত্ম-প্রতারণা এবং অস্বীকারঃ

এক মা এর ছেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গিয়েছিল। সেখানে নিঁখোজ হয়। তার মা সারাজীবন ধরে মনে করতেন ছেলেটি বেঁচে আছে। এটা তিনি স্বীকার করতে চাইতেন না যে তার ছেলে মারা গেছে ও ফিরে আর আসবে না।

এইরকম ভাবে আমরা অস্বস্থিকর জিনিস ডিনাই করতে চাই। এটি আমাদের ভুল-জাজমেন্টের কারণ হয়। এর ইংরেজিম নাম পেইন এভয়ডিং সাইকোলজিক্যাল ডিনায়াল।

 

 

৬। আগে যা করেছি তাতেই স্থির থাকা বা কনসিস্টেন্সি বায়াসঃ

 

আমরা আমাদের চিন্তার সাথে মিল আছে এমন জিনিসই খুঁজি ও দেখতে পাই। আমরা আমাদের আগের ধারণায় স্থির থাকতে চাই। এই প্রবণতা কনফার্মেশন বায়াস তৈরী করে।

চিন্তার ক্ষেত্রে এই বিভ্রান্তি মারাত্মক ক্ষতিকর ফল বয়ে আনতে পারে। যেমন, আপনি ইনভেস্ট করবেন। একটা কোম্পানি সম্পর্কে নিজে একটি তত্ত্ব ধার করালেন বা একটা তত্ত্ব আপনার ভিতরে জন্ম নিল এই কোম্পানি ভালো, ভবিষ্যতে লাভ করবে। তখন আপনি আপনার তত্বের স্বপক্ষে নানা প্রমাণ দেখতে থাকবেন বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু সেইসব জায়গাতেই হয়ত আরো অনেক জিনিস ছিল যা আপনার তত্ত্বকে নাকচ করে দেয়। সেসব আপনার চোখে পড়বে না। এই না পড়ার দরুণ আপনি অযৌক্তিক একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসবেন।

এ থেকে বাঁচতে দার্শনিক কার্ল পপার এর পদ্বতি হলো আপনার ধারনাকে সমর্থন করে এমন জিনিস না খুঁজে যা আপনার ধারনাকে অসমর্থন করে এমন জিনিস খুঁজতে থাকা।

 

 

রিয়ালিস্ট শিল্পী Ilya Repin এর আঁকা ছবি বার্জ হলার অন দি ভলগার মতো আমরা আমাদের পুরনো ধারণা ও স্থিরিকৃত বিশ্বাস বজায় রেখে, এভাবেই চলতে থাকি।

 

 

৭। ডেপ্রাইভাল বা লস এভার্সঃ

 

আমাদের কোন লস হয়ে যাচ্ছে এমন সিচুয়েশন হলে আমরা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাতে থাকি। সমাজের প্রচুর রিয়েকশনের মূলে এই প্রবণতা কাজ করে। বিহেভিওরাল ইকোনমিক্সের মূল তত্ত্ব এর উপর ভিত্তি করেই। একই পরিমান লাভের আনন্দের চাইতে একই পরিমাণ লস প্রায় দ্বিগুন কষ্ট দেয়।

কায়নেম্যান এবং টিভার্স্কি প্রসপেক্ট থিওরী ডেভলাপ করেন, যাতে তারা দেখান যে, একই পরিমাণ লাভ এবং লসের মধ্যে লসটা মানুষকে বেশী পেইন দেয়। ৫০ টাকা লাভ হলে যে সুখ হয় ৫০ টাকা লস হলে দুঃখ হয় বহু বেশী

ইনভেস্টিং এ বা জুয়া খেলায় লস করার পর আমাদের এত খারাপ লাগে যে, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে আমরা এই লস পুনরোদ্ধারের চেষ্টা করি। ফলে দেখা যায় ঐ শেয়ারের দাম কমতে থাকলে আমাদের আরো বেশী লস হয়, আর জুয়া খেলায় হারতে হারতে বাকী যা ছিল তাও যায়।

 

৮। যেমন আছে তেমন থাকুকঃ

 

এটাও একটা সাইকোলজিক্যাল বায়াস। আমরা অনেক সময় স্ট্যাটাস কুও তথা অবস্থা যেমন আছে তেমন থাকুক, কিছু করতে চাই না, কিছু করার দরকার নেই- এমন ভাবে থাকি।

সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে, কোন ভালো পরিবর্তন হলেও অনেক লোক এর বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। তারা দাঁড়ায় এই সাইকোলজিক্যাল কারণেই। অবস্থা যেমন আছে তেমন থাকলেই তারা স্বস্থি পায়।

ভালো না লাগলেও আপনার যা করা দরকার তা করতে হবে। শুধু অনুমান করলেই কাজ হয় না বৃষ্টি হবে, আপনাকে নৌকা বানাতে হবে। অন্যথায় মহাপ্লাবণ হলে আপনি আগে অনুমান করেছিলেন এজন্য বেঁচে যাবেন না।

নোয়াহ বা নূহ নবী বিশ বছর ধরে নৌকা বানিয়েছিলেন। এই সময় অন্যেরা তাকে গর্দভ ভেবেছিল। রৌদ্রদীপ্ত সময়ে একজন নৌকা বানাচ্ছে, সামনে বৃষ্টি হবে এই আজগুবি কথা বলে, তাকে অবশ্যই সেই সময়ের প্রেক্ষিতে বোকা মনে হয়েছিল। কিন্তু পরে যখন দেখা গেল সত্যিই শুরু হয়েছে বর্ষণ, তখন বদলে গেল চিত্র। তো আপনি যখন এভাবে নৌকা বানাবেন, যখন অন্যেরা রৌদ্রে খেলাধুলা করছে, তখন তারা আপনাকে গর্দভই ভাববে, আপনাকে বোকাই দেখাবে। কিন্তু বৃষ্টি শুরু হলেই আপনার কাজের ফল আপনার সামনে হাজির হবে।

 

 

৯। অধৈর্য হওয়াঃ

 

বর্তমানকে ভবিষ্যতের চাইতে বেশী গুরুত্ব দেয়া।

আহমদ শরীফের কালিক ভাবনা বইতে আছে, বাংলার মানুষেরা ইহকালপন্থী। তারা বর্তমানকে জাতিগতভাবেই বেশী গুরুত্ব দেয়। তিনি উদাহরণ দিয়েছিলেন, দেখেন ইসলামের মত পরকালপন্থী ধর্মও এখানে ইহকালপন্থী রূপ নিয়েছে। মাজার হয়েছে। মানুষ মাজারে মানত করে কিন্তু পরকালের লাভের জন্য নয়। ইহকালেই তার কোন উপকারের জন্য। নগদ কারবার।

কিন্তু এই ধরনের অধৈর্য আচরণ আমরা সব ক্ষেত্রে করতে গেলে প্রচুর ভুল জাজমেন্ট হবে।

 

বর্তমানের অল্প লাভ না ভবিষ্যতের বেশী লাভ?

ধরা যাক কাউকে দুইটা অপশন দেয়া হল। অপশন এক- আজকে দশ হাজার টাকা দেয়া হবে। অপশন দুই- এক সপ্তাহ পরে বারো হাজার টাকা দেয়া হবে। এই দুইটার মধ্যে একটা পহন্দ করতে হবে।

সাধারনত মানুষেরা এই ক্ষেত্রে অপশন এক অর্থাৎ আজকে দশ হাজার চয়েজ করে।

পরীক্ষার টাকার পরিমান এক রেখে এবার সময় বাড়ানো হল। বলা হইল, আগামী এক বছর পর আপনারে দশ হাজার টাকা দেয়া হবে, এটা অপশন এক। আর  আগামী এক বছর এক সপ্তাহ পর আপনারে বারো হাজার টাকা দেয়া হবে, এইটা অপশন দুই।

দুই ক্ষেত্রেই এক বছর করে সময় বাড়ছে।

এই ক্ষেত্রে সাধারণত মানুষেরা অপশন দুই চয়েজ করে। তার কাছে তখন মনে হয় এক বছর তো গেছে, আর এক সপ্তাহে আর কী!

কিন্তু এখানে আসলে হচ্ছেটা কী? খেয়াল করে দেখেন, যখন বর্তমানে তারে বিচার করতে দেয়া হচ্ছে তখন সে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে নারাজ বাড়তি দুই হাজার টাকার জন্য। কিন্তু যখন ভবিষ্যতে বিচার করতে দেয়া হচ্ছে তখন সে বাড়তি দুই হাজারের জন্য এক সপ্তাহ অপেক্ষা করছে।

এটা মানুষের একটা ইন্টারেস্টিং আচরণ। একই জিনিস বর্তমানের সাপেক্ষে সে একভাবে দেখে, ভবিষ্যতের সাপেক্ষে অন্যভাবে।

ভবিষ্যতের সাপেক্ষে দেখলে সে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করে দুই হাজার বেশী পাইতে পারে অর্থাৎ ভালো সিদ্ধান্ত সে নিতে পারে। এটা এক গ্রাফের মাধ্যমে দেখা যাক-

 

গ্রাফ

 

গ্রাফে এস এস টা হচ্ছে শর্ট টার্মে লাভ, যেমন এখনই দশ হাজার টাকা।

এল এল টা হচ্ছে লং টার্মে লাভ, অর্থাৎ, এক সপ্তাহ পরে বারো হাজার টাকা।

মূল বিন্দু থেকে একজন যখন দেখবেন, তখন তিনি দেখতে পাবেন এল এল অনেক উঁচু। মানে এল এল নেয়াই ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু এস এস ও এল এল এক জায়গায় মিলিত হয়েছে, তারপরের একটা অংশ স্ট্রাইপ করা আছে, এই জায়গা থেকে তিনি যদি দেখেন তাইলে তার কাছে এস এস উঁচা মনে হবে। তখন তিনি শর্ট টার্মেই লাভ চাইবেন। নগদ যা পাও হাত পাতিয়া লও, বাকীর ঘরে শূন্য থাক, দূরের বাধ্য লাভ কী শুনে, মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক- টাইপের ব্যাপার।

এই জায়গাটার নাম ল্যাপস জোন, অর্থাৎ এই খানেই মানুষেরা ডিজায়ারের সাথে পরাজিত হয়ে লোভে পতিত হন।

ল্যাপস জোনে যে জিনিস কম লাভজনক তা বেশী লাভজনক মনে হয়। আর্কিটেকচারে একটা জিনিশ আছে প্যারালাক্স নামে। প্যারালাক্স বলতে বুঝায় কোন অবজেক্টরে আমরা যেভাবে দেখছি, বাস্তবিক ভাবে সে সেইরকম না এমন অবস্থা; এবং এর কারণ যেই এঙ্গেলে বা কোনে আমরা তারে দেখছি তা।

দুইটা বিল্ডিং ধরেন পাশাপাশি, আপনি দূর থেকে দেখতে পাচ্ছেন একটা উঁচু, আরেকটা নিচু। কিন্তু নিচুটার নিচে গিয়া উপরে তাকিয়ে দেখলে আপনার মনে হলো নিচুটা উঁচুটার চাইতে একটু উঁ্চু আসলে। এইরকম অবস্থা হল প্যারালাক্স।

উপরের গ্রাফে তাই হচ্ছে ল্যাপস জোনে। গ্রাফে হচ্ছে মানে আমাদের মাথায় হচ্ছে, সিদ্ধান্ত নেবার সময়। তাই সে শর্ট টার্ম লাভটা দেখছে, লং টার্ম লাভটা দেখছে না।

মানুষের ভিতরে অংশ দুইটা আছে ধরা যায় ।একটা বুদ্ধিমান, বিচার বুদ্ধি করে আগাতে চায়, আরেকটা অত বিচারের ধার ধারে না, তার মনে খালি সুখ চায়। বিচার বুদ্ধির অংশ ব্যবহার করলে কেউ লং টার্ম লাভটাই দেখবে, সে মূল বিন্দুতে গিয়া ভবিষ্যতের দিকে তাকাবে।

যেকোন ধরনের আসক্তি মানুষের সুখ লোভী অংশের কারণে হয়। যেমন, কেউ সিগারেট ছাড়তে চায়। তার বিচার বুদ্ধির অংশ তারে বুঝায় সিগারেট খারাপ। খাইলে ক্ষতি হয়। হুদাই পয়সা নষ্ট। তাই সে ঠিক করে সিগারেট ছেড়ে দিবে। কিন্তু তার সুখ লোভী অংশে হঠাৎ নিকোটিনের লোভে কাতর হয়। তখন সে আস্তে আস্তে মূল বিন্দু থেকে সরে ল্যাপস জোনে চলে আসে। সুখ লোভী অংশ বুঝায়, কাল থেকে ছাড়ব, আজ খেয়ে নেই। ভবিষ্যতের বেইল নাই, লিভ ইন বর্তমান। সে খায়। এইভাবে তার সিগারেট ছাড়া আর হয় না।

তো ঐ ব্যক্তির সিগারেট ছাড়তে হলে, প্রথমে ভবিষ্যতের হিশাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি সিগারেট ছাড়বেন।

 

সিগারেট দিয়ে উদাহরণ দিলাম, তা ফেইসবুক আসক্তি বা অন্য কোন আসক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। প্রায় প্রতিটি বাজে আসক্তিই ভবিষ্যতের ক্ষতি করে; অর্থনৈতিক, শারিরিক বা মানসিক।

কোন ছাত্র যদি ভাবেন তার ফেইসবুক আসক্তি পড়ালেখায় ক্ষতি করছে তাহলে তিনি ভবিষ্যতের দিকে তাকাইয়া ভাবতে পারেন। তিনি যদি ফেইসবুক ব্যবহার করতেই থাকেন পড়ালেখা বাদ দিয়া, যেটা তার কাছে এখন দারুন লাগে; ইন দ্য লং রান তিনি বাজে রেজাল্ট করবেন। তার অভিভাবকেরা দুঃখ পাবেন। তার নিজের কেরিয়ার পড়বে হুমকির মুখে। ফলে, তারে ল্যাপস জোন অর্থাৎ লোভের গর্তে না পড়ে পড়ালেখায় মন দিতে হবে। এটা তার জন্য ভালো সিদ্ধান্ত মূল বিন্দু থেকে দেখলে।

 

 

 

Loewenstein (1991)

 

 

উপরের গ্রাফখানা জার্নাল অফ কনজিউমার রিসার্চে প্রকাশিত সেলফ কন্ট্রোল বিষয়ক একটি আর্টিকেল থেকে নেয়া। এই খানে দেখানো হচ্ছে উইলপাওয়ার তথা ইচ্ছাশক্তি ও ডিজায়ারের ভিতরের যুদ্ধ। উইলপাওয়ার বিজয়ী হলে আপনে যেকোন আসক্তি ছাড়তে পারবেন। ডিজায়ার উইলপাওয়ারের চাইতে বলশালী হলে আপনি আসক্তিতে আরো নিমজ্জিত হবেন।

বাংলা ফিল্মের নায়করা অনেক সময় মারাত্মক ভবিষ্যত দেখে সিদ্ধান্ত নেন, ফিল্মে দেখা যায়। ধনীর মেয়ের সাথে তার প্রেম। এক পর্যায়ে ধনী বিজনেস ম্যাগনেট নায়ককে ব্রিফকেস ভর্তি টাকা দিয়ে বলেন তার মেয়ের জীবন থেকে সরে যেতে। কিন্তু নায়ক এখানে টাকার লোভে পড়েন না। বর্তমানের সুখ তিনি বর্জন করেন, তার প্রচণ্ড উইলপাওয়ারের কারণে। তিনি তার প্রেম থেকে সরেন না। এবং ফিল্মের শেষে তিনি নায়িকারে পান, আর সম্পত্তিও পান।

 

 

১০। পরশ্রীকাতরতা ও ঈর্ষাঃ

 

ভুল জাজমেন্টের আরেক বড় কারণ ঈর্ষা ও পরশ্রীকাতরতা। মাঙ্গারের কথায় হলো ঈর্ষা এমন এক গর্দভী পাপ যাতে কোন মজা আপনি পাবেন না।

Time_Saving_Truth_from_Falsehood_and_Envy

ছবিটির নাম টাইম সেইভিং ট্রুথ ফ্রম ফলসহুড এন্ড এনভি। আঁকছেন আঠারো শতকের একজন সেরা চিত্রশিল্পী ফ্রান্সিস লিমোয়েন। তিনি যেইদিন আত্মহত্যা করেন তার আগের দিনে ছবিটা আঁকেন। এইখানে বর্শার মত জিনিস হাতে দাড়িওয়ালা যে লোক আছে সে হইল টাইম, তার কোলে যে মহিলা ইনি হইলেন ট্রুথ আর নিচে পড়ে আছে এনভি তথা হিংসা। পিছন দিকে আছে ফলসহুড। অথবা পিছনেরটা হিংসা আর সামনেরটা ফলসহুড হতে পারে, কারণ সামনের পড়ে থাকা লোকটার হাতে মুখোশ দেখা যায়। ফলসহুডের মুখোশ থাকবে এটা স্বাভাবিকই। এই ছবিটিকে হিংসা বিষয়ক বায়াসটির প্রতীক হিসেবে রাখলাম।

ফ্রেঞ্চ দার্শনিক রেনে জিরার্দ, সাইকোলজিতেও যার অবদান অনস্বীকার্য, তিনি বলেছেন আমাদের ডেজায়ার বা আকাঙ্খা তৈরী হয় অন্যদের ডেজায়ার দেখে। আরেকজন ৫০০ লাইক পাচ্ছে দেখে আমাদের ৫০০ লাইকের আকাঙ্খা জন্মে। আরেকজনের গাড়ি আছে দেখে আমাদের গাড়ির ডেজায়ার জন্মে। অন্য শিশুর হাতে খেলনা শিশু খেলনার জন্য কাঁদে।

এই ডেজায়ার দেখে ডেজায়ার জন্ম নেয়াই মূলত আমাদের ঈর্ষার মূলে। কী আমাদের চালাচ্ছে, প্রভাবিত করছে আমরা যদি বুঝতে পারি তাহলে আমরা আমাদের কাজ ও ডেজায়ার বিষয়ে সচেতন হতে পারবো। আমার ধারণা আমরা যখন বুঝতে পারি অন্যরে দেখে আমাদের ডেজায়ার তৈরী হচ্ছে, তখন আমরা ঈর্ষা থেকে চাইলে দূরে থাকতে পারবো, অথবা ঐ ডেজায়ার যা আমার মধ্যে তৈরী হচ্ছে তা ভালো না মন্দ আমার জন্য তা বিবেচনা করে দেখতে পারবো ঠান্ডা মাথায়।

 

১১। তূলনাভ্রান্তিঃ

 

কোন জিনিসকে ঐ জিনিস হিসেবেই না বুঝে অন্য জিনিসের সাথে তূলনা করে বুঝার সমস্যা।

 

১২। এংকরিং-

 

এংকরিং হচ্ছে রেফারেন্স পয়েন্ট বদলে নিয়ে কোন জিনিসকে ভূল বুঝা।

 

তূলনাভ্রান্তি ও এংকরিং বিষয়েঃ

 

পিটার বেভেলিন তার সিকিং উইজডম বইতে লিখেছেন, আমেরিকার ঘর-সম্পত্তি বিক্রেতারা (রিয়েল এস্টেট ব্রোকাররা) মানুষের চিন্তার এই সীমাবদ্বতা ব্যবহার করে বাজে ঘর তাদের গছিয়ে দিত। ধরা যাক, কোন ব্রোকার তার বাজে চেহারার ও জায়গার ঘরটি বিক্রি করতে চায়। ক্লায়েন্টকে সে নিয়ে যাবে ততোধিক বাজে ও খারাপ জায়গায় থাকা ঘরগুলিতে এবং চাইবে উচ্চ দাম। এরপর শেষে নিয়ে যাবে যে ঘরটি সে বিক্রি করতে চায় সেখানে, সেখানে দাম চাইবে আগেরগুলার চাইতে কম।

ক্রেতা অন্যগুলির সাথে এর তুলনা করবে, তখন তার মনে হবে ঘরটি ভালো, দামও ঠিক তার মনে হবে। সে একরকম লাভ করেছে ভেবেই কিনবে, বিক্রেতার প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করে। যদিও বিক্রেতা তাকে রীতিমত পরিকল্পনা করে ঠকিয়েছে।

ড্যান আরিয়ালি এমন একটি বিষয় সামনে এনেছিলেন, যা করেছিল বিখ্যাত দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকা। এটা সরাসরি পাঠকদের ঠকানো না হলেও ভোক্তাদের এই বুঝার সীমাবদ্বতাকে ব্যবহার করা।

 

ইকোনমিস্টে একবার সাবস্কিপশন ছিল এমনঃ

ওয়েব ভার্শন – ৫৯ ডলার।

শুধুমাত্র প্রিন্ট ভার্শন – ১২৫ ডলার।

ওয়েব এবং প্রিন্ট ভার্শন – ১২৫ ডলার।

 

এখন বাইরে থেকে একজন দেখলে বুঝতে পারবেন এখানে মাঝের খালি ওয়েব ভার্শন দেয়াটা ফালতু। কারণ ১২৫ ডলারে যখন ওয়েব এবং প্রিন্ট দুটোই পাওয়া যাচ্ছে তখন কে ১২৫ ডলারে খালি প্রিন্ট কিনতে যাবে!

ড্যান আরিয়ালি এটা নিয়ে পরীক্ষা করলেন। তিনি এই তিনটি অপশন দিয়ে তার ছাত্রদের বললেন পছন্দ করতে। ৮৪ ভাগ ছাত্র ছাত্রী প্রিন্ট এবং ওয়েব অপশনটি পছন্দ করল। ১৬% কেবল ওয়েব।

আরিয়ালি এবার অপ্রয়োজনীয় ‘শুধুমাত্র প্রিন্ট’ অপশনটি সরিয়ে নিলেন। তখন দুইটা অপশন ছিল। ওয়েব অপশন ৫৯ ডলার। আর ওয়েব এবং প্রিন্ট অপশন ১২৫ ডলার। ছাত্রছাত্রীদের তিনি বললেন পছন্দ করতে।

এবার দেখা গেল ৬৮% ছাত্রছাত্রী ওয়েব অপশন নিয়েছে, এবং মাত্র ৩২% নিয়েছে প্রিন্ট ও ওয়েবের যুগ্ন প্যাকেজটি।

এখানেই অপ্রয়োজনীয় শুধুমাত্র প্রিন্ট প্যাকেজটির বিশেষত্ব। যদিও এটা কেউ নেয় না তথাপি এটি থাকলে প্রিন্ট+ওয়েব অপশনটি অধিকতর স্বস্তা মনে হয় লোকের কাছে। তাদের মনে হয় তারা এতে লাভ করছে।

আরিয়ালি এটার ব্যাপারে পত্রিকাটিতে যোগাযোগ করেন, জিজ্ঞেস করেন তারা এটা কেন করেছে। তারা উত্তর দেয় নি কিন্তু সাবস্ক্রিপশন স্টাইলটি সরিয়ে ফেলে।

আপনারা যারা আগেকার বাংলা ফিল্ম দেখেছেন, দেখবেন নায়িকার সাথে যেসব মেয়েরা থাকত এরা দেখতে অত সুন্দর না। এমন মেয়েদের মাঝে নায়িকাকে রাখলে বেশী সুন্দর দেখাবে, এমন ধারণা থেকেই কাজটি করা হতো।

এটাও একই পদ্বতিতে কাজ করে। তাই কনে দেখানোর সময় যদি কনের পাশে তার চাইতে সুন্দরী কোন মেয়ে থাকে তাহলে কনেকে অসুন্দর লাগবে দর্শকদের কাছে। একই কথা বর মহাশয়দের জন্যও খাটে।

 

১৩। সাম্প্রতিক তথ্যাবলিকে অতি গুরুত্ব দেয়াঃ

 

আমরা সাম্প্রতিক তথ্য দ্বারা অতি প্রভাবিত হই। ফেইসবুকে ইস্যু ও ডিজিটাল মিডিয়ার আকর্ষক হেডলাইন এই প্রভাবজনিত সমস্যাকে আরো খারাপ করে তোলেছে।

সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ঘটনার তীব্রতা আমাদের বেশী মনে হয়। এবং মিডিয়া কভারেজের কারণে সাম্প্রতিক ঘটতে থাকা কোন ঘটনার তথ্য আমাদের সামনে বেশি আসতে থাকলে ঐ ঘটনার তীব্রতা আমাদের মনে হয় বেশী।

এটি মূলত স্মৃতির সমস্যা যা ছোট ঝুঁকিকে বড় ঝুঁকি হিসেবে মনে করায়, এবং এর ফলে একজন বড় ঝুঁকি না দেখতে পারেন।

সমাজবিজ্ঞানী, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পুরোধা ব্যক্তিত্ব ও নোবেলজয়ী হার্বার্ট সিমন লিখেছিলেন, আমি শীঘ্রই বুঝতে পারলাম মানুষ পুরস্কার পেতে থাকে কারণ সে আরো পুরস্কার পেয়েছে এজন্যঃ বব মার্টন যাকে ম্যাথিউ ইফেক্ট বলেছেন তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরন। রাজনীতিতে এই বিষয়টি “সহজে প্রাপ্তি” বা “চেনা নাম” প্রবণতা নামে পরিচিত। একজন যখন পুরস্কার পেতে থাকে, তার নাম উঠে আসতে থাকে, ফলে অন্য পুরস্কার কমিটিও পুরস্কার দেবার সময় তার নাম বেশী দেখে বেশী গুরুত্বপূর্ন ভাবে।

 

 

১৪। তথ্য দেখায় অন্ধত্বঃ

আমরা যখন কোন তথ্য দেখি, তখন আমাদের মনযোগ আকর্ষণ করে এমন জিনিসই আমরা দেখতে থাকি। আমাদের মনযোগের বাইরে গুরুত্বপূর্ন জিনিস রয়ে যায় ঐ একই জায়গাতেই। এইজন্য সারভাইভর শীপ বায়াস তৈরী হয়। আমরা কে জিতলো তাই দেখি, মনে করি এটাই একমাত্র সত্য। কিন্তু একই কাজ করতে গিয়ে নিরবে কতো লোক ব্যর্থ হয়েছে, সেই বাস্তবতা একেবারে কমন সেন্স হলেও আমাদের মাথায় আসে না। একদিকে অতি-মনযোগ অন্ধত্বের তৈরী করে।

ডিজিটাল মিডিয়ায় বিভিন্ন এটেনশন গ্র্যাবিং হেডলাইন এবং তথ্য এইজন্য আমাদের স্মার্ট করে তোলে না, বরং উলটা আমাদের ভুল-জাজমেন্ট ও ভুল-সিদ্ধান্ত প্রবণ করে তোলে।

 

 

১৫। রেসিপ্রোকেশনঃ

 

কেউ আমাদের জন্য কিছু করলে, আমরা তাকে একইরকম কিছু করার চেষ্টা করি। এটা মানুষের সহজাত রেসিপ্রোকেশন প্রবণতা। অনেক ক্ষেত্রে এটিও ভুল জাজমেন্ট ও সিদ্ধান্ত তৈরীতে কাজ করে। সাধারণত মার্কেটাররা এটা ব্যবহার করে।

রবার্ট চিয়ালদিনি তার ইনফ্লুয়েন্স বইতে রেসিপ্রোকেশন প্রবণতা যেভাবে কাজ করে তা বলতে গিয়ে যেসব উদাহরণ দিয়েছিলেন এর মধ্য থেকে হরে কৃষ্ণ সোসাইটির উদাহরণটির কথা এখানে বলা যায়। এরা আমেরিকায় দান সংগ্রহের জন্য প্রথমেই একটি ফুল দিত ব্যক্তিকে। এরপর তারা দান চাইত। এভাবে বিপুল সফলতা পায়। কারণ প্রথম প্রথম অধিকাংশ মানুষই ফুল নেয়ার পর কিছু টাকা দান করতে বাধ্য হতো।

তারা এই ফুল ডাস্টবিনে ফেলে দিত, কারণ এটা তাদের দরকারে লাগবে না। হরে কৃষ্ণ সোসাইটির লোকেরা ডাস্টবিন থেকে ফুল নিয়ে আবার লোকদের দিত।

একসময় এতে মানুষ অতিষ্ট হয়ে ওদের সামনেই ফুল মাটিতে ফেলে দিত, এবং পা দিয়ে পিষে ফেলত। এতে তারা নতুন পদ্বতি শুরু করে। তারা তখন দিতে শুরু করে আমেরিকান পতাকা। এবার পতাকা তো কেউ আর ফেলতে পারবে না।

 

 

১৬। পছন্দ দ্বারা অতি-প্রভাবিতঃ

 

কাউকে আমরা পছন্দ করলে অতি প্রভাবিত হয়ে তার দোষ হয়ত দেখতে পাব না। কোন সেলিব্রেটিকে অতি পছন্দ করলে, সে এমন একটি পন্যের বিজ্ঞাপন করলো যা আমার দরকার নেই, তাও আমি কিনে আনতে পারি, ইত্যাদি রকম ভুল জাজমেন্ট এবং সিদ্ধান্ত হতে পারে।

 

 

১৭। সোশ্যাল প্রুফঃ

সবাই করছে, তাই এটা ভালো, আমিও করছি। এই প্রবণতা।

মানুষে অন্য বেশীরভাগ লোক যা করছে তাই সে অনুকরণ করতে চায়। এটার কারণ হচ্ছে সে মনে করে সবাই যেহেতু করছে অতএব এতে হারাবার ঝুঁকি কম। এটা তাকে একটি নিরাপদ অনুভূতি দেয়। এই প্রবণতা নানা ক্ষেত্রে কাজ করে। ফেইসবুকে যখন কোন পোস্ট বেশী লাইক এবং শেয়ার পেয়ে ভাইরাল হতে থাকে, তখন সেই পোস্ট আরো বেশী লাইক এবং শেয়ার পেতে থাকে। বা কমেডি সিরিয়ালে হাসির ট্র্যাক বাজানো হয় হাস্যকর দৃশ্যে এবং এতে দর্শকেরা সেইসব দৃশ্যে বেশী হাসেন বা হাসতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন ।

মানুষ যখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে তখন সে জনপ্রিয় জিনিসটা নিয়েই নিরাপদ বোধ করে। যেমন, কোন রেস্টুরেন্টের মেন্যুতে যদি অনেক খাবারের লিস্ট থাকে তবে ভোক্তা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবে। সেই মেন্যুতে যদি একপাশে পপুলার আইটেম নামে কয়েকটা খাবারের তালিকা থাকে, তাহলে ভোক্তা সিদ্ধান্তহীনতা থেকে মুক্তি পেতে ঐ পপুলার আইটেমের একটি খাদ্যই পছন্দ করবে।

যারা বিজ্ঞাপন নিয়ে কাজ করেন, বড় কোম্পানির মার্কেটার, তারা বিভিন্নভাবে এই “সামাজিক প্রমাণ (সোশ্যাল প্রুফ)” প্রবনতা ব্যবহার করে তাদের পন্যকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করে থাকেন।

সামাজিক প্রমাণের ব্যাপারটি সাইকোলজিস্ট রবার্ট চিয়ালদিনি তার ইনফ্লুয়েন্স বইয়ে আলোচনা করেছিলেন। রেস্টুরেন্টের মেন্যুতে অতিরিক্ত খাবারের তালিকা বা অন্য কোথায় খুবই বেশী পছন্দের অপশন থাকা ভোক্তার সিদ্ধান্তহীনতার জন্ম দেয়, তিনি তখন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, এ নিয়ে লিখেছেন সাইকোলজিস্ট ব্যারী শোয়ার্জ তার প্যারাডক্স অব চয়েজ বইতে। একই নামে তার একটি টেড লেকচার আছে। আর রেস্টুরেন্টের মেন্যুতে অতিরিক্তি খাবারের তালিকা থাকলে মানুষ তালিকার একপাশে থাকা পপুলার আইটেমগুলি থেকে বেশী পছন্দ করে সিদ্ধান্তহীনতা থেকে বাঁচতে, এটা নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করেছেন মনস্তাত্ত্বিক অর্থনীতিবিদ দিলীপ সোমান এবং অন্যরা।

মানুষের মধ্যেকার “সামাজিক প্রমাণ” প্রবণতা বা অধিকাংশ লোক বা ভীড়ের সিদ্ধান্তকেই ঠিক মনে করা অবশ্যই সব ক্ষেত্রে ভালো ফল বয়ে আনে না। কিছুক্ষেত্রে তা মারাত্মক হয়। যেমন, স্টক মার্কেটে, দাঙ্গার ক্ষেত্রে বা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের দল সোশ্যাল প্রুফ প্রবণতার কারণে উদ্ভট সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

রবার্ট চিয়ালদিনি একবার একটা পরীক্ষা করেছিলেন। আমেরিকার আরিজোনা অঙ্গরাজ্যের একটি সংরক্ষিত বন পার্কে গাছ চুরি হচ্ছিল। তিনি এই চুরি কমানোর জন্য গাছে একটি মেসেজ লিখে দিলেনঃ

“অতীতে অনেকে এই পার্কের সংরক্ষিত গাছ কেটে নিয়েছেন যা পার্কের পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করেছে।”

এর ফল হলো উলটা। গাছ কাটা কমার পরিবর্তে বেড়ে গেল শতকরা ৮ ভাগ। গাছ যারা চুরি করছিলেন তাদের জন্য এটি সামাজিক প্রমান হিসেবে কাজ করল।

 

 

 

 

 

১৮। অথোরিটির ভূল প্রভাবঃ

 

অথোরিটি দ্বারা মারাত্মক ভুল প্রভাবের সম্ভাবনা থাকে। অথোরিটিকে অন্ধ বিশ্বাস খারাপ। এ নিয়ে বিস্তারিত একটি লেখাই আছে সাইটেঃ অথরিটির ভুল প্রভাব থেকে বাঁচার উপায় নামে।

 

 

১৯। বুঝ দেয়াঃ

কোন ঘটনা ঘটে যাবার পর আমরা সহজে পিছনে তাকিয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে ফেলি ঘটনাটি কেন ঘটলো।

একজনের বিয়ে ভেঙ্গে গেছে। আমরা তখন বললাম, ওদের বিয়ের দিনই আমি জানতাম এমন ঘটবে। আমার মনে হয়েছিল কারণ ওদের কেমন ছাড়া ছাড়া মনে হচ্ছিল।

কিন্তু ঐ একই বিয়ে যদি না ভাঙত, তাহলে ওদের প্রথম দেখে আমাদের ছাড়াছাড়া মনে হয়েছিল না কী মনে হয়েছিল আমরা তা বেমালুম ভুলে যেতাম।

এই বুঝ দেয়া প্রবণতা হচ্ছে হিন্ডসাইট বায়াস।

মানুষের কোর প্রবণতা সে অনিশ্চিত পৃথিবীতে সব কিছুর ব্যাখ্যা চায়। কিন্তু পৃথিবী এতো নিশ্চয়তাহীন যে এখানে একেবারে ঠিকঠাক কোন ব্যাখ্যা নেই। মানুষ এই অনিশ্চয়তা সহ্য করতে পারে না।

 

 

২০। কারণকে সম্মান দেখানোঃ

 

আমরা কারণকে সম্মান দেই। কেউ কোন কিছু কেন করছে তা বললে ঐ বিষয়টাকে আমরা অন্যভাবে দেখি।

আপনি যদি লোকদের কী কারণে আপনি করছেন বলেন তাহলে তারা সেটি বেশী আমলে নিবে।

আন্তোইন ডি সেইন্ট জুপেরী বলেছিলেন, মানুষকে জাহাজ নির্মান শেখাতে হলে জাহাজ কীভাবে বানাতে হবে ইত্যাদি না বলে সমুদ্রের বিশালতা সম্পর্কে শিক্ষা দাও।

এই কথাটির মধ্যে লুকিয়ে আছে এই ইনসাইট, কারণ দেখাও।

জি জিয়াং এর অদ্ভূত এক্সপেরিমেন্টসহ অনেক সাইন্টিফিক রিসার্চে মানুষের কারণকে সম্মান দানের প্রবণতার ব্যাপারটি দেখা গেছে।

 

 

২১। আগে বিশ্বাস করা এবং পরে সন্দেহ করা – আরেকটি মিস-জাজমেন্ট ও ভুল সিদ্ধান্তের কারণ।

 

২২। স্মৃতি দূর্বলতাঃ

আমাদের স্মৃতি দূর্বল। এজন্য অনেক সময় ভূলভাবে, এবং আংশিক ভাবে আমরা মনে রাখি, আর ভাবি পুরাটা মনে আছে।

একটা ঘটনা ঘটছিল এমন যে, একজন লোক আদালতে প্রত্যক্ষদর্শী স্বাক্ষীর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন, এ নিয়ে টিভিতে পত্রিকায় কথাবার্তা বলেন। তার প্রচারণা ছিল স্বাক্ষী স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে ভুল স্বাক্ষ্য দিতে পারে না জেনে, এবং এতে একজন নির্দোষ ফেঁসে যেতে পারে। তিনি এক টকশোতে একই বিষয়ে একদিন কথা বলছিলেন।

টকশো শেষ হবার পরে রেইপের দায়ে তিনি গ্রেফতার হন। তিনি পুলিশরে এলিবাই দেখান যে ঐসময় তো আমি টিভিতে ছিলাম, সরাসরি টকশোতে। এর শক্ত প্রমাণ ছিল। তিনি রেইপ করেন নি। কিন্তু ভিক্টিম বলছে তার নাম!

পরে দেখা গেল ভিক্টিম বিশ্বাস করে তিনিই রেইপ করেছেন। কারণ যেই ঘরে ভিক্টিম রেইপ হয় ঐ ঘরে তখন টিভি খোলা ছিল আর সেই টকশোটাই চলছিল যেখানে তিনি বলছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী স্বাক্ষীদের গ্রহণযোগ্যতা আছে কি না এই বিষয়ে।

মানুষের স্মৃতি তার সাথে প্রতারনা করতে পারে। এছাড়া এক্সপেরিয়েন্সিং সেলফ আর রিমেম্বারিং সেলফের পার্থক্য দেখিয়েছেন ডেনিয়েল কাহনেম্যান, এ নিয়ে তার গুরুত্বপূর্ন টেড লেকচার আছে।

কোন ঘটনা যখন মানুষ এক্সপেরিয়েন্স করে, এই যেমন প্রতি সেকেন্ড আমরা এক্সপেরিয়েন্স করে যাচ্ছি এর বেশিরভাগই আমাদের মেমোরিতে স্থান পায় না।

তিনি দুইটা ভাগ করেছেন, এক হচ্ছে এক্সপেরিয়েন্সিং সেলফ। আর একটা রিমেম্বারিং সেলফ।

রিমেম্বারিং সেলফ পূর্বের কোন ঘটনা মনে করে এবং এই মেমোরি হ্যাপি হলে এতে সে ঐ ঘটনাটাকে হ্যাপি মনে করে।

যেমন, কলেজে আপনি প্রতিদিন গেছেন এক সময়, কিন্তু সব দিন আপনার মনে নাই। গুরুত্বপূর্ন কয়েকদিন মনে আছে। ঐ দিনগুলির প্রেক্ষিতেই আপনার রিমেম্বারিং সেলফ কলেজ লাইফ কেমন ছিল তা বিচার করবে।

রিমেম্বারিং সেলফ তার স্মৃতিতে রাখা তথ্যের হিশাবে কোন ঘটনারে হ্যাপি অর স্যাড বলে রায় দেয়।

প্রতিদিন একইরকম দারুণ ফুটবল ম্যাচ যদি খেলতে থাকেন, তাহলে প্রতিদিন আপনি প্রায় একই ধরনের হ্যাপিনেস এক্সপেরিয়েন্স করবেন। কিন্তু স্মৃতিতে জমা হবে একদিনের খেলাই। যেহেতু নতুন কিছু হয় নাই, তাই নতুন কিছু যোগও হবে না। ফলে অনেকদিন পরে চিন্তা করলে তা একদিনের স্মৃতি হিশাবেই রইবে রিমেম্বারিং সেলফের কাছে।

 

 

২৩। কিছু একটা করতে হবে প্রবণতা। এর কারণে আমরা অনেক বাজে কাজ করি।



Paul Gavarni, Le Flâneur, 1842

 

কোন কিছু না করে থাকা কখনো কখনো দরকারী, বা কিছু একটা করতে হবে, সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই ইমপালস থেকে ভুল কিছু করার চাইতে। এটা মনে রাখতে ভবঘুরে Flâneur এর ছবিটির দিকে আমরা তাকাতে পারি, যে কারণ ছাড়াই ঘুরে বেড়াতে পারে।

 

২৪। কিছু একটা বলতে হবে প্রবণতা। এর কারণে আমরা বলার কিছু না থাকলেও অনেক বাজে বকি।

 

২৫। আবেগতাড়িত সিদ্ধান্ত। আবেগের বশবর্তী হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত ও বিচার।

 

২৬। দুশ্চিন্তার কারণে ভুল সিদ্ধান্ত।

 

২৭। কোন শারীরিক, মানসিক পেইন বা রাসায়নিকের ক্রিয়ায় ভুল সিদ্ধান্ত।

 

২৮। এই সবগুলো কারণের সবগুলো বা কয়েকটা যখন একসাথে কাজ করে। যাকে বলে লোলাপালোজা ইফেক্ট।

 

 

উপসংহারঃ

এইগুলো মনে রাখলেই কি কেউ ভুল-বিচার ও ভুল-সিদ্ধান্ত থেকে বাঁচবেন?

না।

তিনি অন্যদের চাইতে হয়ত কম ভুল করবেন, এবং নিজের ভুল অন্যদের চাইতে তাড়াতাড়ি নিজের ভুল ধরতে পারবেন।

প্রথমে যুক্তি দিয়ে বিচার, এরপর এইসব সাইকোলজিক্যাল ফ্যাক্টরগুলি প্রভাব ফেলছে কি না, বা কীভাবে ফেলছে তা ভাবলেই অনেক সিদ্ধান্ত নেয়া তুলনামূলক বেটার হবে।