নাম দেয়া ও নাম পরিবর্তনের গভীরে যা আছে 

ভিকারুন্নেসা স্কুলের নাম পরিবর্তনের কথা উঠেছে। অনেকে এর পক্ষে দাবী জানাচ্ছেন, একজন সচিবও এ নিয়ে মত দিয়েছেন। দৈনিক কালের কণ্ঠের (৯ ডিসেম্বর ২০১৮) এর মাধ্যমে জানলাম মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেছেন, ‘ভিকারুননিসার পাকিস্তান আমলের নাম পরিবর্তন করা হবে’। আমার দেখা মতে, দাবী উঠেছে স্কুলটির নাম বীর প্রতীক তারামন বিবির নামে বা জাহানারা ইমামের নামে করার জন্য।

এই অবস্থায় ঘটনাটির দুইটি দিক নিয়ে ভাবার দরকার আছে বলে মনে করি। প্রথমত যে প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা উঠেছিল তা পরিবর্তন করা অনেক কঠিন, কারণ প্রতিষ্ঠান ও রীতিনীতি দাঁড়িয়ে গেলে তা পরিবর্তন সহজ নয়। এই অবস্থায় একজন শিক্ষকের শাস্তি বা এই নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ ফোকাসকে ভিন্ন খাতে নেয়া নয় তো? স্বাভাবিক এই প্রশ্ন অনেকের মনেই এসেছে।

দ্বিতীয় দিকটি এর চাইতে গভীর ও কেবল এই ঘটনার সাথে যুক্ত নয়। এই দিকটি খোদ নামকরণ নিয়েই। নামকরণ জিনিসটা আসলে কী?

বুক অব জেনেসিসে এডামকে অন্য  সব প্রাণীদের নামকরণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন ঈশ্বর। অন্য  প্রাণীরা এডামের সামনে হেঁটে হেঁটে চলে গেছে। এডাম তাদের একটা একটা করে নাম দিয়েছেন।

“So the Lord God formed out of the ground every wild animal and every bird of the sky, and brought each to the man to see what he would call it. And whatever the man called a living creature, that was its name. The man gave names to all the livestock, to the birds of the sky, and to every wild animal; but for the man no helper was found as his complement.” (Gen 2:19-20)

তিনি কীভাবে দিতে পারলেন এতোসব প্রাণীর নাম? এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হবে স্বয়ং জগত বিধাতা তার ভেতরে এই জ্ঞান দিয়ে রেখেছিলেন। তিনি প্রাণী দেখেছেন ও নাম দিয়েছেন। এই নামকরণের ক্ষমতাটা লক্ষ্য করুন। এর মাধ্যমেই মানুষ অন্যসব প্রাণীর উপর ক্ষমতা অর্জন করলো। অন্য প্রাণীরা মানুষকে নাম দিতে পারে নি। বাইবেলে এই নামকরণের  ক্ষমতা মানুষকে বাকীসব প্রাণীদের চাইতে আলাদা করেছে ও মানুষ করে তুলেছে।

ভাষাকে জ্ঞানের ও চিন্তার কেন্দ্র ধরা হয় এক ধারার চিন্তায়। এই ক্ষেত্রে নামকরণ মহাগুরুত্বপূর্ন হয়ে ধরা দেয়। তখন পশ্চিমা জ্ঞানতত্ত্বের বা  পৃথিবীর জ্ঞানজগতের  প্রতীকী শুরুই হয় এডামের প্রাণীদের নামকরণের ঐ চিত্রটি দিয়ে।

যেহেতু নামকরণ জ্ঞানের সাথে এতো ভালোভাবে যুক্ত, তাই ক্ষমতার সাথেও যুক্ত। ড্যানিয়েল ডিফোর বিখ্যাত উপন্যাস রবিনসন ক্রুসোতে রবিনসন ক্রুসো নিঃসঙ্গ দ্বীপে আদিবাসী এক যুবককে বাঁচায় মানুষখেকোদের হাত থেকে। সে যুবকটির নাম দেয় ফ্রাইডে। শুক্রবারে তাকে পেয়েছিল তাই এই নাম দিয়েছিল সে, অন্য কোন কারণ ছিল না। কিন্তু এই নামকরণের পরেই উপন্যাস বদলে যায়, ফ্রাইডেকে কেন্দ্র করে রবিনসন ক্রুসোর নানা তৎপরতার মাধ্যমে গল্প এগিয়ে যায়। ফ্রাইডে নিঃসংকোচে রবিনসন ক্রুসোর প্রভুত্ব মেনে নেয়। নামকরণের বিষয়ে এই প্রভুত্ব মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে ফ্রাইডে নামকরণকে প্রতীকী হিসেবে দেখা যায়।

নামকরণ মানে অন্যের উপর কর্তৃত্বের একটা জায়গা তৈরি করে নেয়া। পিতামাতার সন্তানের নামকরণ করেন, এই জায়গাতেও একটা ক্ষমতার ব্যাপার রয়েছে। হঠাৎ কেউ এসে আপনাকে যদি বলে আজ থেকে আপনার নাম রহিম বাশশা, আপনি মানবেন না। প্রতিবাদ জানাবেন। আর মেনে নিলে আপনি ফ্রাইডের মতো তার অধীনতা মেনে নিলেন।

বিয়ের আগে ভবতারিণী দেবী ছিল রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর নাম। বিয়ের পর রবীন্দ্রনাথ নাম দেন মৃণালিনী, অনেকে বলেন এটি নাকি দিয়েছিলেন প্রাক্তন বান্ধবীর নামানুসারে, আনন্দবাজারে নীলাঞ্জন বন্ধপাধ্যায় এমনই লিখেছেন। এই নামকরণেও ক্ষমতার প্রকাশ ছিল। বলাবাহুল্য, তখনকার দিনে এই ক্ষমতা স্ত্রীদের উপর স্বামীরা খাটাতে পারতেন, এখনো এরকম বা  তার চাইতে অনেক অনেক বেশি পারেন এই সমাজে। (এখনো স্বামীদের নাম স্ত্রীদের নামে লাগানো হয়। লাইক মিসেস আহমেদ।)

নামকরণের সাথে  ক্ষমতার সম্পর্ক থাকার কারণে এক রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে অন্য দলের সময়ে নির্মিত স্থাপনার নাম বদলে দেয়। এটা নিজের ক্ষমতা দেখানো, প্রতীকী ভাবে অন্য দলের উপর নিজের ডমিনেন্স দেখিয়ে দেয়া। এই কারণেই বিজেপি শাসিত ভারতে এলাহাবাদ প্রয়াগগঞ্জ হয়, বাংলাদেশের অনেক এলাকায় নাম বদল হয় বা এর পায়তারা হয়।

বর্তমান বাস্তবতায়, ভিকারুন্নেসা স্কুলের নতুন নামকরণ নিয়ে কথাবার্তাও একই উদ্দেশ্য তাড়িত।

এটি যদি হয়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি বলে কথিত অবস্থানটি তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির উপর নিজেদের ডমিনেন্স দেখানোর একটা প্রতীকী উপায় পেয়ে যাবে।

শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিকতা বিষয়ক যেসব পরিবর্তন হলে শিক্ষার্থী ও সমাজের জনয় মঙ্গল, এর সাথে নাম পরিবর্তনের সংযোগ নেই, বা থাকলে অগুরুত্বপূর্ন ভাবে অল্প আছে। তারামন বিবি বা জাহানারা ইমামের নাম বদলে রাখা হলেও এটা তাদের সম্মানার্থেই কেবল করা হয়েছে,  এটা কখনওই বলা যাবে না। তাদের নাম এখানে মূলত টুল হিসেবে ব্যবহার হবে।