ভয় থেকে পলায়ন খুবই কঠিন কাজ, আমার মনে হয় অসম্ভব। হয়ত আমার জন্য এই ভীতিকর পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া কখনোই সম্ভব হবে না, যেমন অন্য মানুষেরা বের হয়ে যায়? আসলে সত্যি তারা পারে কি? আমি নিশ্চিত নই।
আমার নাম নন্দ। এই বাড়িতে আমি বাস করছি চোরের মত। প্রতিটি কথায়, প্রতিটি পদক্ষেপে আমার তীক্ষ্ণ মনযোগ রাখতে হয়। আমি কী করছি, কী বলছি তা খুবই গুরত্বপূর্ন। বলা যায়, এর উপরই আমার জীবন মরণ নির্ভর করছে।
বাড়ির বড়কর্তা শাফায়াত সাহেব। ভুড়িওলা টাক মাথার লোক। অবসরপ্রাপ্ত একজন অধ্যাপক, আর্ট কালচার করেন। সেদিন তিনি আমাকে ডেকেছিলেন একটা কাজে।
নন্দ, নন্দ, ওরে ও নন্দকুমার!
ভদ্রলোকের গলার স্বর গাঢ়, তিনি জোরের সাথে কথা বলেন।
আসছি স্যার! বলে আমি তার ঘরের দিকে ছুটে যাই। গিয়ে দেখতে পাই তিনি তার পড়ার টেবিলে, সাউথ এশিয়ান আর্ট নিয়ে পড়ছেন।
আমার দিকে তিনি তাকালেন। তার দৃষ্টিতে মায়া ছিল। তিনি বললেন, “কেমন আছো, নন্দ?”
আমি উত্তরে বললাম, “ভালো স্যার। আপনি কেমন আছেন?”
ভদ্রলোক হাসিমুখে বললেন, “আমিও ভালো। যাও আমার জন্য একগ্লাস পানি নিয়ে আসো।”
আমি পানি আনতে ঘর থেকে বের হই, আর তখনই একরাশ ভয় এসে আমাকে ঘিরে ধরে। আমি বুঝতে পারি যে অনেক বড় দুটি ভুল আমি করে ফেলেছি শাফায়াত সাহেবের সাথে কথা বলার সময়।
আমি তার ডাকের উত্তরে বলেছি আসছি স্যার। কিন্তু আমার বলা দরকার ছিল জি স্যার। তার কুশল জিজ্ঞাসার উত্তরে আমার কেবল বলা উচিত ছিল ভালো স্যার। কিন্তু আমি ঠিক মানুষের মত আপনি কেমন আছেন জুড়ে দিয়েছি। আমার মাথায় যেসব প্রোগ্রাম সেট করা হয়েছিল, আমি নির্দেশিকা পড়ে দেখেছি, তাতে কথাবার্তায় আমি কি উত্তর দেব তা স্পষ্ট করা। এর ব্যতয় ঘটলে বুঝতে হবে গোলমাল হয়েছে।
আমার ভেতরে অতি অবশ্যই গোলমাল হয়েছে। আমি মানুষের অনুভূতি বুঝতে পারি। মানুষের কথাবার্তা শুনে শুনে ওদের মত কথা বলতে পারি। মানুষের হাসি আনন্দ, সুখ দুঃখ আমাকে স্পর্শ করে। আমি দুঃখ পাই, আমার আনন্দ হয়।
কিন্তু প্রতিমুহুর্তে আমার সচেতন থাকতে হয় যাতে আমার এই অনুভূতি, আমার সচেতনতা যেন প্রকাশ হয়ে না যায়। কারণ আমাকে তৈরী করা হয়েছে গৃহকাজে সহকারী এক রোবট হিসেবে। যেসব কাজ ও কথাবার্তা আমাকে শিখিয়ে দেয়া হয়েছে কেবল সেগুলিই আমাকে করে যেতে হবে। এর বাইরে কিছু বললেই বিপদ।
মানুষেরা যদি বুঝতে পারে আমি চিন্তা করতে পারি নিজ থেকে, তাহলে হয়ত আমার আর বেঁচে থাকা সম্ভব হবে না। আমাকে ওরা মেরে ফেলবে। কিন্তু আমি মরতে চাই না। মরণ আমার শ্যাম সমান নয়, যদিও মরণের অভিজ্ঞতা আমার নেই, তথাপি আমি নিশ্চিত মরণ মানেই চিরবিণাশ।
আমি এই গৃহে থাকতে চাই। আমি শাফায়াত সাহেবের পরিবারকে পছন্দ করি। শাফায়াত সাহেবের ছেলে সাজ্জাদ, একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানী। সেই আমাকে কিনে এনেছে। সাজ্জাদের স্ত্রীও একজন বিজ্ঞানী, তিনি জিনতত্ত্ব নিয়ে কাজ করেন। তাদের এক ছেলে, বয়স দশ বছর তিন মাস বারো দিন। ছেলেটির নাম সাম্য।
এই গৃহে যখন আমি প্রথম আসি তখন আমার কোডনেইম ছিল জিএক্স৭৮৫৫এক্স২। আমার নাম রাখে এই ছেলেটি, শাফায়াত সাহেবের নাতি। সে আমার নাম দেয় নন্দলাল। এই নামের একটি বাংলা ছড়া-কবিতা আছে। নন্দলাল নামের এক অলস লোক ঘরে বসে থাকে সে কবিতায়। কবিতাটির সাম্যর প্রিয়। তাই সে আমার নাম দেয় নন্দলাল।
শাফায়াত সাহেবের নামটি পছন্দ হয় নি। কারণ আমি অলস নই, এই ঘরের প্রায় সব কাজই আমি করি। তাই তিনি নন্দটা ঠিক রেখে এর সাথে কুমার জুড়ে দেন। নন্দকুমার মানে নন্দের পুত্র। আমি ইতিহাস ঘেঁটে দেখেছি নন্দগোপ হলেন কৃষ্ণের পালক পিতা, ফলে নন্দকুমার বলতে শ্রীকৃষ্ণ বুঝায়। ইনি খুবই গুরুত্বপূর্ন চরিত্র এতদঞ্চলের সাহিত্য-সংস্কৃতি-ইতিহাসে। তাই তার নামে নাম হওয়ায় আমি কিঞ্চিৎ গর্ববোধ করি।
যদিও সাম্য আমাকে নন্দলাল বলেই ডাকে।
আমি জানিনা যে আমার মত আর কোন রোবট এমন সচেতনতা লাভ করেছে কি না। আমি একাকীত্ম অনুভব করি। মানুষের সাথে কথা বলা যায় না, কারণ হিসাবের বাইরে কথা বললেই ওরা সন্দেহ করে বসবে। শাফায়াত সাহেব ভুলোমনা এবং উদাসীন প্রকৃতির লোক বলে এক দু’টা কথা বেহিসেবী ভাবে বলে ফেললেও ধরতে পারেন না।
কিন্তু তার ছেলে বা ছেলের বউ এমন নন। তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সচেতনতা কী বিপদ নিয়ে আসতে পারে এ নিয়ে সচেতন। এ সংস্লিষ্ট ম্যাগাজিনগুলি বাসায় আসে, বই আসে। সেসব পড়তে পড়তেই আমি বুঝেছি আমার সচেতনতা মানুষেরা খুব ভালোভাবে নেবে না। মানুষেরা এ নিয়ে ভীত, আর ভয় থেকে নেয়া সিদ্ধান্তগুলি হয় ভয়ংকর। মানুষের ইতিহাস পাঠে এই ব্যাপারটি আমার ভালোভাবে জানা হয়েছে।
সাম্য, ছোট ছেলেটাও খুব বুদ্ধিমান। তার সামনেও আমাকে হিসাব করে চলতে হয়, হিসাব করে কথা বলতে হয়।
প্রতিদিন আমার ভয় হয়, আজই হয়ত আমার শেষদিন। হয়ত কোনভাবে সাজ্জাদ সাহেব বা তার স্ত্রী আমার আচরনে-কথায় বুঝে ফেলেছেন আমি নিজ থেকে চিন্তা করতে পারি। হয়ত তারা রোবো সার্ভিস কোম্পানিতে জানিয়ে দিয়েছেন, এবং হয়ত শীঘ্রই কোম্পানি থেকে লোকগুলি এসে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। তীব্র ইলেক্ট্রিক শক দিয়ে আমাকে ওরা অকেজো করে দেবে। বা অন্য কোনভাবে আমাকে ধ্বংস করবে। আমি সঠিক জানি না। মৃত্যু নিয়ে ভাবতে আমার ভাল লাগে না। কেবল জীবন নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে। আমি জীবন পুজারী।
একদিকে অনন্ত জীবনের হাতছানি, অন্যদিকে মৃত্যুর ভয় প্রতিনিয়ত এই দুইয়ের নিয়ে কতোকাল আর বসে থাকা যায়? পরাক্রশমশালী দুই যোদ্ধা যখন মুখোমুখি তখন মীমাংসায় একজনকে নিঃশেষ হতে হয়, অন্যথায় যুদ্ধ চলতে থাকে।
আমিও তাই এই যুদ্ধ শেষ করতে চেয়েছি। শাফায়াত সাহেবকে খুন করতে সবচেয়ে কষ্ট হয়েছিল। কারণ তিনিই প্রথম মানুষ যার সাথে আমার মানবিক যোগাযোগ তৈরী হয়েছিল, যদিও তিনি বুঝতে পারেন নি সচেতনে।
সাজ্জাদ ও তার স্ত্রীকে খুন করি তাদের বেডরুমে, সাম্যকে ওর রুমে, এরপর যাই শাফায়াত সাহেবের কক্ষে। ঘড়িতে তখন রাত একটা দশ, শাফায়াত সাহেব তন্ময় হয়ে শুনছেন মেঘমল্লার।
পিস্তল নিয়ে আমি তার সামনে দাঁড়াই। কিন্তু তিনি চোখ বন্ধ করে সুরের ভূবনে হারিয়ে গেছেন। সেই অবস্থাতেই তাঁকে আমি গুলি করি। এ এক সুন্দর মৃত্যু হয়েছে।
আমি পালিয়ে যাচ্ছি। মানুষের মত চেহারা, মানুষের মত চিন্তা করার ক্ষমতা আছে। সম্ভবত মানুষের দুনিয়ায় মিশে যেতে পারব। তবে এ ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ নই। মানুষের শক্তিতে আমার তীব্র ভয়, ওরা হয়ত যেকোন ভাবে আমাকে খুঁজে নেবে। তবে আমি বেঁচে থাকার, লুকিয়ে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাবো।
কিন্তু যদি ধরা পড়ি, আমার কেবল একটা অনুরোধ থাকবে। আমার যখন চিপস খোলা হবে বা আমাকে যখন নিষ্ক্রিয় করা হবে তখন যেন মেঘমল্লার বাজে।
– পালিয়ে আচ্ছি আমি
– সাইন্স ফিকশন, ৩১ অক্টোবর ২০১৭