একটা তামিল ফিল্ম আছে, জনতা গ্যারাজ নামে, টিভিতে আমি এর কিছু অংশ দেখছি মাঝে মাঝে। আপনেও হয়ত দেখছেন। ঐ ফিল্মে জনতা গ্যারাজের মালিকদের মাসল পাওয়ার থাকে বেশি। তারা সেই তাকত ইউজ কইরা সমাজের অন্যায়ের বিচার করেন, কেউ নালিশ নিয়া গেলে।
বিচার পাইয়া আপনে খুশি হইলেও এইটা কি ঠিক?
এইটা ঠিক আপনে ধইরা নিলে জনতা গ্যারেজের আইন হাতে তুইলা নেয়া আপনে মাইনা নিলেন। পরে ধরা যাক আরেক জনতা গ্যারেজ আরেক জায়গায় শুরু হইল, তারা মাসল পাওয়ার দিয়া অন্যায় করা শুরু করলো, সেইটারে কী বলবেন? ছিনতাই, রাহাজানি, চাঁদাবাজি।
আপনাদের গণতান্ত্রিক সিস্টেমে কোন গ্রুপের মাসল পাওয়ার বেশি শক্তিশালী হইয়া উঠা ভয়ের কথা।
কারণ তখন সে আপনাদের সম্মিলিত চুক্তিভিত্তিক যে সিস্টেম, তার উর্ধ্বে উইঠা যায়।
তার ভালো মন্দের হিসাব, তার বিচার অনুযায়ী সে কাজ করতে থাকে, ও আপনাদের উপর চাপাইয়া দিতে থাকে।
মাসল পাওয়ার গল্পের পরে আরেক ধরণের পাওয়ারের গল্পের দিকে যাই।
এটা হইল সম্পদের পাওয়ারের গল্প। একজনের সম্পদ বেশি আছে, সেইটা ব্যবহার কইরা সমাজে সে যে ক্ষমতাসম্পর্ক তৈরি করে ও সমাজরে নিয়ন্ত্রণ করে।
ধরা যাউক সম্পদ বেশি আছে হাশিম সাহেবের। প্রচুর প্রচুর টাকা তিনি কামাইছেন।
কিন্তু এতো টাকা দিয়া তিনি কী করবেন। যা যা মানুষেড় আরাম আয়েশের জন্য দরকার, এরও তো একটা লিমিট আছে। হাশিম সাহেবের টাকা সেইগুলার চাইতে অনেক অনেক অনেক বেশি।
তো ভদ্রলোক বানাইলেন একটা দাতব্য প্রতিষ্ঠান। যেইটা দিয়া তিনি নানা সামাজিক ভালো কাজ করবেন। স্কুল বানানো, পাইখানা বানানো, আর্ট প্রতিষ্ঠান করা ইত্যাদি ইত্যাদি।
আপনি বাহবা দিলেন। হাশিম সাহেবের গ্যারাজের জয় হউক।
কিন্তু বিপ্লবী, সমস্যাটা হইল, হাসিম সাহেবের প্রকল্পটাও জনতা গ্যারাজের মতোই। ভালো কাজ করলেও সে, আপনাদের গণতান্ত্রিক চুক্তি ভিত্তিক সিস্টেমের উর্ধ্বে উইঠা যায় তার সম্পদ ব্যবহার কইরা।
এরে বলে প্লুটোক্রেসি ইংরাজিতে, বাংলায় বলি ধনীতন্ত্র।
মানে ধনীরাই যখন তাদের ধন ব্যবহার কইরা সমাজে পাওয়ার এক্সারসাইজ করে ও নিয়ন্ত্রণ করে।
হাসিম সাহেবের দাতব্য সংস্থাটি হাশিম সাহেবের “ভালো” ও “মন্দের” ধারণা নিয়াই কাজ করবে। ফলে হাশিব সাহেব হইয়া যাইবেন এক পিতা, যিনি এগুলা দানের সাথে সাথে চাপাইয়া দিবেন আপনার সমাজে।
যে সমাজ আপনারা বানাইছিলেন গণতান্ত্রিক। ইন থিওরিতে যেখানে সকলেই সকল, মানে নাগরিক হিসাবে সমান।
এই যে হাশিম সাহেব, ইনি হইলেন বর্তমান দুনিয়াল বিল গেটস, জেফ বেজোস, মার্ক জাকারবার্গ এরা। একটা নতুন ইকোনমিক সিস্টেম যখন আসলো, সফটওয়ার ও ইন্টারভিত্তিক, তখন তারা এটিতে তাদের প্রতিভা এবং অন্যান্য সামাজিক ন্যায় ও অন্যায় সুযোগাদি ব্যবহার করে বিশাল পরিমাণ টাকা উপার্জন করে ফেলছেন।
যেইটা ওয়েলদিয়েস্ট ম্যান অব আমেরিকা বলে খ্যাত জন ডি রকফেলারও করছিলেন। টাকার পাহাড় যারে বলে।
এক পর্যায়ে তিনি টের পাইলেন এইগুলার সুরাহা করতে হবে নাইলে এর নিচেই চাপা পড়তে হবে। এবং তার মনে সমাজরে সাহায্য করার মনোবাসনাও যে ছিল না, এইটা বলি না আমি। তো তিনি যখন রকফেলার ফাউন্ডেশন করতে মনস্থ করলেন। গেলেন ইউ এস কংগ্রেসে বিল পাশ করানোর জন্য। একজন লোক এত টাকা দিয়ে ফেলতেছে সমাজের ভালোর জন্য সে তো হিরো হিসাবে সম্মান পাবার কথা। কিন্তু তিনি পাইলেন কঠিন সমালোচনা।
আমেরিকান তখনকার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম হাওয়ার্ড টাফট, সাবেক প্রেসিডেন্ট টেডি রুজভেল্ট এর বিরোধীতা করলেন।
পলিটিক্যাল সাইন্টিস্ট রব রাইখ তার বই জাস্ট গিভিং এর শুরুতেই এই কাহিনীটা উল্লেখ করছেন। তিনি বলতে চাইছেন, যারা ডেমোক্রেসির প্রতি বিগ ফিলানথ্রোপি তথা বড় দানবীরগিরি যে একটা সিরিয়াস সমস্যা এটা অনেকে তখনই তুলে ধরছিলেন।
এই সমস্যাটা হইল, ঐ জনতা গ্যারেজেরই সমস্যা।
রব রাইখ বলেন, একটা এইরকম ফাউন্ডেশন আসলে কেমন আজকের দুনিয়ায় সেইটা দেখি। একজন ব্যক্তি থাকেন তার পাহাড় পাহাড় টাকা আছে। তিনি এইগুলার কর যাতে জিরো হয় এর জন্য যা করা সম্ভব তার সবই করেন। অভিযোগ করতে থাকেন পাবলিক ওয়েলফেয়ারের জায়গাগুলাতে সরকার কেমনে ব্যর্থ হইতেছে। তারপর ঘোষনা দেন সমাজের ও লোকসকলের ভালোর জন্য তিনি নিজের সম্পদ দান করবেন, একটা ফাউন্ডেশন গইড়া কাজ করবেন। আর এইটা করতে গিয়া ট্যাক্স আরো কমান কারণ এরূপ সংস্থা করলে ট্যাক্স কমে বা ট্যাক্সমুক্তই হয়। এরপর তিনি বলেন সবাইরে, যেন তারে কৃতজ্ঞতা জানায় ও তার সংস্থার কার্যাদি কেমনে সমাজের ভালো করতেছে তা দেখান।
ট্যাক্সের যে কথাটা বব রাইখ বলেন, তা হইল, ধরেন একজন বিশাল ধনী বড় অংকের টাকা দান করলেন, এইটা যদি করমুক্ত হয়, তাইলে যে ৪০% কর ছিল, ওইটা কিন্তু জনগণের টাকাই।
মানে হাশিম সাহেব ধনী লোক, একশো কোটি টাকা দান করলেন। ধরলাম ট্যাক্স এখানে জিরো। এমনিতে ট্যাক্স হইত ৪০ কোটি। যেটা জনগণের টাকা। তিনি কিন্তু দিছেন আসলে ৬০ কোটি টাকা নিজের, বাকি ৪০ কোটি জনগণের। দিয়া নিজেরই ভিশন বাস্তবায়ন করতেছেন, নিজেরই পলিটিক্যাল ক্ষমতার বাস্তবায়ন করতেছেন। আর কৃতজ্ঞতা পাইতেছেন একশো কোটি দানের। আমেরিকায় ২০১৬ সালে ৫০ বিলিয়ন ডলার ট্যাক্স এইরকম দাতব্য সংস্থার কারনে সরকার পায় নাই।
এমনকী ইন্ডিভিজুয়াল দান যখন সংস্থাগুলিতে যায়, তখনো সংস্থাগুলি একটা ক্ষমতার এক্সারসাইজ করে।
রব রাইখ এর মতে, বড় ফাউন্ডেশনগুলির প্রধান সমস্যাগুলির মধ্যে আছে,
প্রথমত, এগুলির মাঝে কোন জবাবদিহিতা নাই। মার্কেটপ্লেইসের কম্পিটিশন বা ভোটার কারো কাছেই তাদের কোন জবাব দিতে হয় না।
দ্বিতীয়ত, এরা অস্বচ্ছ। একটা ট্যাক্স ফর্ম ফাইল করে জাস্ট।
তৃতীয়ত, এরা দাতামুখী। যারা কাজ করে তাদের না, দাতার মিশনই এদের ভিশন।
চতুর্থত, এমনকী দাতা মারা যাবার পরেও দাতার মিশন এরা মাইনা চলে, এমনকী সমাজ বদলে গেলেও।
পঞ্চমত, এদের কর দিতে হয় না।
এইভাবে আসলে সমাজে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বাইরে গিয়া জনতা গ্যারাজদের রাজত্ব শুরু হয়। যেই জনতা গ্যারাজদের আপনে ভোট দিয়া নির্বাচিত করেন নাই। তারা খারাপ করলে ভোট দিয়া ফালাইতেও পারবেন না।
ফলে ধনীদের ধন নিয়ন্ত্রিত ক্ষমতাচর্চার নিচেই আপনার বাস হবে তখন।
এমনকী তারে আপনে মোরালিও হাই অবস্থানে স্থান দিয়া দেখেন।
এইভাবে ধনীতন্ত্র আপনার নাগরিক অধিকারও নিয়া নিবে তাদের বলয়ে, এবং নিয়া নিবে আপনার সাধের ডেমোক্রেটিক ব্যবস্থাটারেও।
তো, এই অবস্থায় আপনার কখনোই জনতা গ্যারাজরে ব্লাইন্ডলি সমর্থন করা ঠিক হবে না।
এবং পলিটিক্যাল দিক থেকে আপনারে ফিলানথ্রপি তথা মহসিনগিরিরে দেখতে হবে। এমনিতে দার্শনিকেরা ব্যক্তিগত দিক থেকে দানের নৈতিকতা নিয়ে বেশী আলোচনা করেন। কিন্তু যেহেতু এইসব বড় বড় দানবীরেরা পলিটিক্যাল পাওয়ারের এক্সারসাইজ করছেন, সংস্থাগুলি করছে, তাই এইদিক থেকে কিছু প্রশ্নের আবশ্যকতা অপরিহার্য। রব রাইখের জাস্ট গিভিং থেকে,
From the perspective of political rather than moral philosophy, different and important questions arise: What attitude should a state have toward the preference of individuals to give away money for a public purpose? What role, if any, should philanthropy have in the funding or distribution of essential goods and services? When is philanthropy an exercise of power deserving of democratic scrutiny? Is philanthropy always remedial or second best to justice? How, when, and should the state frame, shape, subsidize, limit, or block individual preferences to give money away? Under what circumstances and for what purposes, if any, should associations be granted a corporate form with special tax treatment, as a nonprofit organization, for example?
মোটকথা, দানরে ভক্তি গদ গদ হয়ে দেখলেই সমস্যা। বরং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দানরে দেখতে হবে ক্রিটিক্যালি ও সন্দেহের চোখে, এইটাও মাথায় রেখে যে, এইগুলা থেকে অনেক ভালো কাজও হয়।