আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত সংগঠক ও লেখক। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র নামক সফল প্রতিষ্ঠান তিনি তৈরি করেছেন। তার এই সংগঠন কেন্দ্রিক অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা এই বই। এখানে তিনি সাদা চোখে যা দেখেছেন ও অনুভব করেছেন বাঙ্গালি চরিত্র নিয়ে, সেগুলি লিখেছেন।
ব্রিটিশদের লেখায় বাঙ্গালি চরিত্র হিসেবে অলস কপট স্বার্থপর ইত্যাদি এসেছে, অনেকে বলেন এর কারণ হলো ব্রিটিশেরা যেসব বাঙালির সাথে চলেছিল, সেগুলা ছিল দালাল ও চামচা গোত্রের। যেমন এখন যদি দেশের সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে চলাফেরা করে একদল এলিয়েন, আর তারা গিয়ে রিপোর্ট দেয় এই দেশের লোকেরা ঘুষখোর, নীতিভ্রষ্ট, তাহলে সেইসব এলিয়েনদের আমরা দোষ দিতে পারব না।
তবে, একদল আলাপ আছে, ব্রিটিশেরাই সব নষ্ট করে গেছে, আগে আমাদের সোনার বাংলায় সব ছিল, মানুষও ছিল সবাই ভালো, এমন রূপকথার গল্প আমি অসত্য মনে করি।
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের বইটি যারা সাংগঠনিক কাজ করেন, তাদের অনেক ভালো ইনসাইট দিতে পারে।
আত্মসমালোচনামূলক বই কিছু ইম্প্রুভমেন্টের জায়গা দেখিয়ে দেয়। সেইজন্য বাঙালি বিষয়ে হুমায়ূন আজাদের কথাগুলিও চিত্তাকর্ষক।
একটা সমাজের লোকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্মানে তার ভৌগলিক অবস্থা প্রভাব ফেলে। প্রভাব ফেলে তার অর্থনৈতিক অবস্থাও। এছাড়া আরেক দিক থাকে সামগ্রিক মানব সাইকোলজির। ভয়, হিংসা, রাগ, প্রতিযোগিতা ইত্যাদি অনুভব সকল অঞ্চলের মানুষের ভেতরই থাকে। কিন্তু এদের প্রতিক্রিয়ায় সব সমাজের মানুষ একই ধরণের আচরণ করবে না। একবার বৈশ্বিক সততা মাপার পরীক্ষা করা হয়েছিল রাস্তায় টাকাভর্তি মানিব্যাগ ফেলে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলিতে বেশি মানুষ মানিব্যাগ পেয়ে ফিরিয়ে দিয়েছে। সেই পরীক্ষায় সততার মাপকাঠিতে তারা ক্লাশের সেরা ছাত্র। কিন্তু এই ধরনের পরীক্ষা ত্রুটিপূর্ণ। সাধারণ মানুষের সততা এভাবে মাপতে গেলে দেখতে হবে, দুই দেশের লোকদের অর্থনৈতিক সামাজিক অবস্থা কাছাকাছি কি না। সামাজিক নিরাপত্তা (ভাতা, চাকরি, বয়স্কদের সাহায্য, স্বাস্থ্য সাহায্য ইত্যাদি ইত্যাদি) কাছাকাছি কি না। তা না হলে এটি ভুল বিচার হয়।
আবু সায়ীদের লেখা এইরকম দোষে দুষ্ট। বাঙালীর স্বাস্থ্য খারাপ, এই দোষ তাদের দেবার আগে দেখতে হবে তাদের ক্রয়ক্ষমতা কেমন, সেই ক্রয়ক্ষমতার ভেতরে স্বাস্থ্যকর খাবার সরকার দিতে পারছে কি না। উন্নত দেশে ছাত্রছাত্রীদের খাবারের পুষ্টিমানের ব্যাপারে স্কুল সচেতন থাকে। স্কুল থেকে খাবার দেয়া হয় অনেক ছাত্রছাত্রীদের, যাদের মা বাপের আয় কম। সেই জন্য সরকারের আলাদা ফান্ড থাকে। স্কুলে ব্যায়ামের ক্লাস থাকে, সেগুলি নিয়মিত করানো হয়। তারা স্বাস্থ্যকে শিক্ষার অংশ হিসেবেই দেখে। কিন্তু বাংলাদেশে এই ব্যবস্থা কি আছে? বাংলাদেশের মানুষের ট্যাক্স ভ্যাটের টাকা যে নেয় সরকার, মানুষকে এসব সুবিধা কেন দিতে পারছে না? যদি দিতে পারত তাহলে কি বাঙালীদের স্বাস্থ্য উন্নত হত না?
সায়ীদ এই দিকে না গিয়ে চলে গেলেন সোজা কুখ্যাত ইউজেনিক্সের ধারণায়। ( উইকিপিডিয়া।)
আবু সায়ীদ এই বই লিখেছেন ২০০৩ সালে। অর্থাৎ পরিণত বয়সে। কম বয়েসে লিখলে তাও কথা ছিল, অনেক কিছু হয়ত উপেক্ষা করা যেত পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায়। আবু সায়ীদের সংগঠন ও বাঙ্গালি বইয়ের যে সরলীকরণ ও রেসিস্ট অবস্থান, তা পরিণত বয়সের একজন লেখক, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সংগঠক, জ্ঞানবৃক্ষের আলো ছড়িয়ে দেয়া ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া, তাই হতাশাজনক।
আবু সায়ীদ এক জায়গায় লিখেছেন বাঙালী চরমপন্থী। সোনালি মধ্যপন্থা তারা খুঁজে পায় না। আয়রনি হলো, আবু সায়ীদ নিজেও তার বইতে চরমপন্থা দিয়েই দেখেছেন। তার কথিত ‘সোনালি মধ্যপন্থার’ দৃষ্টি, ও যুক্তি দিয়ে দেখতে ব্যর্থ হয়েছেন।
বইটি এন্টারটেইনিং, মোটিভেশনাল, ইনসাইটফুল, এই লাইনে কেউ গবেষণা করতে গেলে তার জন্য দরকারি কারণ এমন বিষয়ে বই অপ্রতুল এই দেশে। কিন্তু আবু সায়ীদের ব্যক্তিগত অবস্থান বিবেচনায়, এবং বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গীতে (বিগ পিকচারে) এই বইটি দূর্বল, সরলীকরণ ও আবেগের আতিশয্য দোষে দুষ্ট, এবং রেসিস্ট।