ইসলামিক গোল্ডেন এইজ বলে পরিচিত সময়ে, হাউজ অব উইজডমে শিক্ষা ব্যবস্থা এমন ছিল, একজন বিদ্বান ব্যক্তি বা স্কলার এবং ছাত্রের মধ্যেই বিদ্যাশিক্ষার চুক্তি ছিল, কোন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপার ছিল না।
তখন শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল ডিসেন্ট্রালাইজড। এখনকার মত কোন প্রতিষ্ঠানের অধীনে, প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট ক্রাইটেরিয়ায় ছাত্র ভর্তি করবে, পাশ সার্টিফিকেট দিবে, এরকম ছিল না।
এই ব্যবস্থার নাম ছিল হালাকা। হালাকার অর্থ চক্র বা বৃত্ত।
ঐ সময়ে ধরা যাক আপনি আছেন, এবং ইসলামিক আইন শিখতে চান। তাহলে আপনাকে যেতে হত এলাকার পরিচিত স্কলারের কাছে। যিনি স্থানীয় মসজিদে তার ছাত্রদের নিয়ে চক্র করেন। অর্থাৎ তারা বসেন ও ইসলামিক আইন নিয়ে আলোচনা করেন।
আপনি সেখানে গিয়ে যোগ দিলেন। প্রশ্ন করলেন। চক্রের অপেক্ষাকৃত এগিয়ে থাকা ছাত্ররা এর উত্তর দিলেন, আর বেশি জটিল প্রশ্ন হলে স্কলার বা পণ্ডিত ব্যক্তি ব্যাখ্যা করে দিলেন।
এভাবে আলোচনার মাধ্যমে আপনি শিখলেন।
আপনার জ্ঞানতৃষ্ণা ধরা যাক খুব বেশি। সেক্ষেত্রে আপনি একাধিক পণ্ডিতের চক্রে যোগ দিতেন, আপনি গণিতও শিখেন এক চক্রে। এসব ক্ষেত্রে পণ্ডিত বা স্কলার ব্যক্তির ইচ্ছার উপরই নির্ভর করত আপনার ভর্তি হওয়া।
কয়েক বছর এভাবে বিদ্যার্জনের পর আপনি বুঝতে পারলেন দূরের শহরে বাস করা খুব বিখ্যাত আরেক ইসলামিক আইন শাস্ত্র পণ্ডিতের কাছে যাওয়া দরকার আপনার। আপনি আপনার স্থানীয় স্কলার, যাদের কাছে এতদিন শিখেছেন তাদের কাছ থেকে চিঠি নিলেন। সেসব চিঠিতে তারা লিখে দিলেন ঐ বিখ্যাত পণ্ডিতের উদ্দেশ্যে যে, এই ছাত্রটি ভালো, তার জ্ঞানতৃষ্ণা প্রবল। একে আপনার চক্রে অন্তর্ভূক্ত করে নিন।
ওই বিখ্যাত পণ্ডিত যেহেতু অনেক বেশি পরিচিত তাই তার কাছে আসা আগ্রহীদের সংখ্যা বেশি। তিনি সবাইকে যুক্ত করতে পারেন না। তাই এইসব প্রশংসা পত্রের দরকার হয়।
আপনি যখন এসব নিয়ে তার কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন, উনি আপনার সাথে কথা বলে ও চিঠিগুলি দেখে আপনাকে তার চক্রে অন্তর্ভূক্ত করে নিলেন। আপনার জ্ঞানার্জন চলতে থাকল।
এক পর্যায়ে আপনি হাউজ অব উইজডমে কোন এক স্কলারের কাছে গিয়ে শেখার সুযোগ পেলেন।
আপনার পিতা ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তার অঢেল সম্পদ। ফলে, নিজেকে চালিয়ে নেবার মত টাকা আপনার কাছে সবসময়ই ছিল। তাই এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে গিয়ে থাকা, এবং জ্ঞানার্জনে আপনি সময় ব্যয় করতে পেরেছেন।
আপনার এক বন্ধু, যে খুব মেধাবী কিন্তু গরীব। সেও আপনার সাথে এসেছে। তার মেধা দেখে এলাকার একজন ব্যবসায়ী তার পড়ালেখা স্পন্সর করেছেন।
কিন্তু, আপনি জানেন যে আরো কেউ কেউ আছে, যারা মেধাবী ছিল কিন্তু গরীব, এবং কোন স্পন্সর পায় নি। ফলে তাদের জ্ঞানার্জন স্থানীয় পর্যায়েই রয়ে গেছে।
এই হালাকা ব্যবস্থায় শিক্ষকেরা ছিলেন স্বাধীন।
অষ্টম শতাব্দীতে কতিপয় মসজিদ শিক্ষক এবং ছাত্রদের জন্য বেতনের ব্যবস্থা শুরু করে। অনেক মুসলিম লোকেরা তাদের সম্পত্তি ওয়াকফ করে যেতেন। এসব সম্পত্তি সাধারণত শিক্ষার কাজে ব্যবহৃত হত। আস্তে আস্তে এখান থেকেই পরবর্তীকালে শুরু হয় মাদ্রাসা ব্যবস্থার শিক্ষা।
হালাকা ও মাদ্রাসা শিক্ষার মূল পার্থক্য ছিল শিক্ষকদের স্বাধীনতার ব্যাপারে। অর্থনৈতিক প্রভাব আসায় শিক্ষকদের স্বাধীনতা কমতে থাকে, ও আইনবিদ্যায় শাসকের প্রভাব বাড়তে থাকে।
ওয়াকফের বাইরে স্কলারেরা উপার্জন করতে পারতেন বই অনুবাদ করে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থসাহায্য পাওয়ার মাধ্যমে। সেইসময়ে অনুবাদ করে উপার্জনের অংকটা ছিল অনেক বড়।
হাউজ অব উইজডমে পড়তে হলে ছাত্রকে মুসলমান হতে হত না। খলিফা আল মামুনের সময়ে হুনাইন আল ইশাক নামে একজন অনুবাদক ও স্কলারকে বনু মুসারা খলিফার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন ৮১৭ সালে। তিনি ছিলেন খ্রিস্টান। ৮৩০ সালে তিনি হাউজ অব উইজডমের পরিচালক হয়ে যান। তিনি নয়জন খলিফার শাসনকালে তার পদে থেকে দায়িত্ব পালন করে যান, কিন্তু ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে হয় নি তাকে। কিন্তু কিছু কিছু স্কলারের সুবিধাদি পাওয়ার জন্য নিজ ইচ্ছায় ধর্মান্তরিত হতেন।
৮ম ও ৯ম শতকে বাগদাদে বেশীরভাগ ডাক্তারেরা ছিলেন ইহুদি ও খ্রিস্টান।
কিন্তু খলিফা মুতাওয়াক্কিলের সময়ে, ৮৫০ সালে তিনি ডিক্রি জারি করে, সরকারি জায়গায় অমুসলিমদের নিয়োগ নিষিদ্ধ করেন। ইসলামিক প্রতিষ্ঠানে অমুসলিম ছাত্রদের পড়া, মুসলিমদের মাধ্যমে অমুসলিমদের শিক্ষাদান, কোন ব্যবসায় মুসলমানদের উপরে অমুসলিমদের নিয়োগ নিষিদ্ধ করেন।
—
শিক্ষা নিয়ে আরো লেখাঃ
শিক্ষাব্যবস্থার বিমানবিকীকরণ – পেডাগোজি অব দ্য অপ্রেসড