ফেইসবুকে যে লাইক বাটন আছে, এইখানে যখন একজন ব্যক্তি ক্লিক করেন তখন আসলে তিনি কী বুঝান? পোস্টদাতা কী বুঝেন এই লাইকের অর্থ? এবং অন্যান্য যারা এটি দেখেন তারা কী বুঝেন এই লাইক থেকে?
কমিউনিকেশন হিশাবে লাইক নামক একটিভিটির এই তিনটা দিক।
লাইক ত্রিমুখী কমিউনিকেশন।
লাইকদাতা
পোস্ট দাতা
ও দর্শক
ধরা যাক, আমি পোস্ট দিলাম, সরকারী অফিসে একজন অফিসার আমার কাছে অন্যায়ভাবে ঘুষ চেয়েছেন।
অনেকে এতে লাইক দিলেন।
এখন, আমি কি বুঝব তারা ঐ অফিসারের কাজটি লাইক করেছেন? নাকি আমার উপর হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ হিশাবে লাইক দিয়েছেন?
এবং বাকি যারা লাইকটি দেখবেন তারা কীভাবে বুঝবেন?
এমন হতে পারে, লাইক দাতা আসলেই আমার খারাপ অবস্থায় খুশি হয়ে লাইক দিয়েছেন।
আরেকটা উদাহরণ দিলে হয়ত ভালো বুঝা যাবে।
আমি একজন নেতার সুস্থতা কামনা করে পোস্ট দিলাম। একজন লাইক দিলেন। তো, তিনি কি ঐ নেতার সুস্থতা কামনা করলেন লাইক দিয়ে, না আমাকে তার পছন্দ এই কারণে ঐ নেতাকে অপছন্দ হলেও, লাইক দিলেন?
এইখানেও দর্শকেরা কী বুঝবেন?
দেখা যাচ্ছে, লাইক কোন স্পষ্ট কমিউনিকেশন না।
এখানে স্পষ্ট কমিউনিকেশন অসম্ভব কারণ আমরা জানতে পারছি না ব্যক্তি কী বুঝাচ্ছেন।
এই অস্পষ্ট কমিউনিকেশনই লাইকের প্রকৃতি।
কিন্তু লাইক এক ধরণের কমিউনিকেশন হিশাবে কাজ করে। এবং রহস্যজনক ভাবে, দাতার উদ্দেশ্য যাইহোক না কেন, লাইক পজেটিভ জিনিশ হিসেবে ধৃত হয়।
আজ থেকে ১০০ বছর আগের কাউকে গিয়ে আপনি যদি বলতেন, লেখায় দশটা লাইক পেয়েছি, তিনি ব্যাপারটা বুঝতে পারতেন না। কারণ এই ধরণের কমিউনিকেশন তখন ছিল না।
আধুনিক ইন্টারনেট প্রযুক্তি এই নতুন ধরণের মানব কমিউনিকেশন তৈরি করেছে। ব্রেইন এটি যেভাবে বুঝে, এইরকম ভাবে বুঝার মত কোন কমিউনিকেশন আগে ছিল না, আমরা ধরতেই পারি। বিভিন্ন সময়ের ও অবস্থার প্রেক্ষাপটে মানুষের ব্রেইন নানা নতুন কিছুর সামনে আসে, বুঝার চেষ্টা করে এবং এইভাবে তার পরিবর্তন সাধিত হয়।
আপনি হয়ত বাইকামেরাল মাইন্ড হাইপোথিসিসের কথা শুনে থাকবেন। সাইকোলজিস্ট জুলিয়াস জেইনস এর প্রবক্তা। এই হাইপোথিসিস মতে, প্রাচীনকালে মানুষের ব্রেইন দুই অংশে বিভক্ত ছিল, এক অংশ কথা বলত আরেক অংশ শুনত ও মানত। প্রায় তিন হাজার বছর আগেই এমন চিন্তার অবস্থা মানুষের জন্য স্বাভাবিক ছিল। এক স্টেইজে স্কিজোফ্রেনিয়া নামক মানসিক সমস্যায় আক্রান্তরা যেরকম কথাবার্তা শুনতে পান, সেইরকম অবস্থা ছিল তখন মানুষের।
পরে, ধীরে ধীরে তা পরিবর্তিত হয়, এবং মানুষ চিন্তার বর্তমান অবস্থায় আছে। এইখানে স্থির হবে বলা যায় না। নতুন প্রযুক্তি সমাজ পরিস্থিতি তাকে বিভিন্ন ধরণের নতুন কমিউকিনেশন, কাজ ইত্যাদির দিকে নিবে, ফলে তার চিন্তা তথা ব্রেইন বদলাতে থাকবে।
আধুনিক পপ কালচারের তৎপরতা হচ্ছে, মানুষকে যতোটা পারা যায় প্যাসিভ রাখা।
প্রাচীন রোমের কলোসিয়ামে খেলাধুলার আয়োজন করা হত মানুষকে খুশি রাখতে। এখনো খেলাধুলা নির্ভর বাণিজ্য হয়। এইসব খেলাধুলার ক্ষেত্রে দর্শকেরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ, দর্শকদের জন্যই মূলত খেলাগুলি আয়োজিত হয়। দর্শকেরা দেখেন, দেখার মাধ্যমে উত্তেজনা অনুভব করেন এবং না খেলেও খেলার বা জিতা-হারার ফিল পান। এটাই উদ্দেশ্য।
আধুনিক পপ কালচার আরও অনেক মানুষের এক্টিভিটিকে এই ফ্রেমে নিয়ে আসতে চায়।
আপনি যুদ্ধ না করেও যুদ্ধ করার ও জয়ের ফিল যাতে পান।
আপনি কমিউনিকেশন না করেও যাতে কমিউনিকেশন করার ফিল পান।
এইসব প্রযুক্তি, জিনিশটা পুরা না করেও এর ফিল আপনারে দেয়ার ফ্রেম থেকেই আগত।
লাইকের আরেক বিষয়, এটাকে দেখেন এক মার্কার ব্যালটের মত।
ব্যালটে কেবল একটাই মার্কা আছে। দুইটা অপশন আছে এমন ফিল দিবে আপনারে, হ্যাঁ ভোট এবং না ভোট।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, অপশন একটা। হ্যাঁ ভোট।
যারা না ভোট দিবে, এদের জন্য কোন বাটন নাই, ফলে আমরা হয়ত ধরতে পারি যারা দেখেও লাইক দেয় নাই তারা না ভোট দিছে। কিন্তু এই ফিল হবে না আমাদের। আমরা ধরে নিব, এরা হয়ত দেখে নাই। কারণ ফেসবুক আমাদের নর্মাল প্রোফাইলে সরাসরি তুলনামূলক ওই এনালিটিকস দেখাবে না, কয়জন দেখছে আর কয়জন লাইক দিছে। আর দেখাইলেও, আমরা সেটাকে দেখছে কিন্তু লাইক দেয় নাই হিশাবে বিচার করতে কম আগ্রহী থাকব ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে। কারণ ফেসবুক এনালিটিকসে “দেখা” বলতে যা দেখায়, তা স্পষ্ট না, হতে পারে স্ক্রল করতে একবার সামনে পড়ে গেছে কারো।
হ্যাঁ না অপশন না থেকেও এর ফিল থাকলে, হ্যাঁ না এর অবস্থা কেমন, তা বিচার করতে যাবে কে!
এবং, যারা দেয় নাই তারা ‘না’ দিছে, এটা শতভাগ ধরাও যায় না। হয়ত এমনিতেই দেয় নাই, অনেকে আছে নিভৃতে পড়তে পছন্দ করেন। এসব ব্যক্তি ভাববে, কারণ এগুলা তার পক্ষে যায়।
আমাদের ভোটের বাক্সে লাইকগুলি ভোট হিশাবে জমা হন। আমরা দেখি এবং অন্যরাও দেখেন।
এই দর্শকরা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা বেশি লাইক পেলে, ভোট ব্যাংকের এই সংখ্যা ক্ষমতা হিসেবে কাজ করে। সোশ্যাল ক্যাপিটাল হয়ে যায় আমাদের।
ক্যাপিটাল হলো সেই জিনিশ যার মধ্যে শ্রম আছে, বা শ্রম দ্বারা অর্জিত। যেমন, আট ঘণ্টা কাজ করে আপনি ৫০০ টাকা পেলেন। বলা যায় এটা একরকম ক্যাপিটাল, এর অর্থনৈতিক মূল্য আছে। যেইসব ক্যাপিটাল ব্যক্তি সমাজে তার অবস্থান, নেটয়ার্ক ইত্যাদির মাধ্যমে অর্জন করেন, সেগুলি সোশ্যাল ক্যাপিটাল। এর সরাসরি অর্থমূল্য না থাকতে পারে, কিন্তু এগুলি ব্যবহার করে অর্থনৈতিক লাভ সম্ভব বা সহজ হয়।
লাইক সংখ্যার প্রভাবে দর্শকদের চোখে আমাদের পোস্টের গুরুত্ব বাড়ে। এবং ফলে আমাদের আরও লাইক পাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
এবং যেহেতু যারা লাইক দিচ্ছেন, এরা মানুষ ও সমাজে থাকেন, ফলে এই ভোটসংখ্যা তথা লাইকের বদৌলতেই সমাজে আমাদের কথার গুরুত্ব তৈরি হতে থাকে।
কেউ কেউ এই সোশ্যাল ক্যাপিটাল এনক্যাশ করতে পারেন।
যেমন খেলাধুলা করে অনেক খেলোয়াড় যে সোশ্যাল ক্যাপিটাল কামান, তা এনক্যাশ করে পরে রাজনীতি বা ব্যবসায় সুবিধা পান। এরকম অভিনেতা, লেখক এদের অনেকেও এমন সোশ্যাল ক্যাপিটাল এনক্যাশ করেন, শাহরুখ খানেরা ব্র্যান্ডের প্রমোশন করে টাকা বানান, ভারতে সাউথের নায়কেরা রাজনীতি করেন, সিএম হন। মাশরাফি এম্পি হলেন। একইভাবে নীশ ভিত্তিক বেশি লাইক প্রাপ্ত ইনফ্লুয়েন্সারদের টাকা দিয়ে হায়ার করা হয় পণ্য প্রচার করতে।
এই জিনিশটা নিজে থেকে খারাপ বা ভালো না, কী উদ্দেশ্যে তিনি এনক্যাশ করছেন, কীভাবে করছেন তার উপর নির্ভর করে ভালো খারাপ হয়।
তাহলে কী দাঁড়াইল? যখন লাইক দিচ্ছেন তখন আসলে আপনি কী দিচ্ছেন?
তার সোশ্যাল ক্যাপিটাল বাড়াইতে সাহায্য করতেছেন, নিজে কিছু না দিয়েও কিছু একটা দিচ্ছেন। জ্যাক লাকা নাকি বলছিলেন, পীরিত হইল তোমার যা নাই তা অন্যরে দেয়া, যেইটা আবার সে চায় না। ভাবি, লাইকের ব্যাপারে তিনি কী বলতেন!
একইলোক পাড়ার মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিলে, একইরকম সোশ্যাল ক্যাপিটাল দিতে হলে, আপনাকে তার সামনে যেতে হত, হাততালি দিতে হত বা বলতে হত ভাই সাথে আছি।
কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার লাইকের কারণে এগুলি না করেও, ইভেন, এগুলি না মিন করেও, পুরা প্যাসিভ থেকে আপনি তার সোশ্যাল ক্যাপিটাল বাড়াতে সাহায্য করতে পারতেছেন।
এইজায়গাতে ভয়ংকর দিকটা দেখা যায়।
যেহেতু প্যাসিভ থেকে দিতে পারতেছেন তাই মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে দেবার সময়ে আপনি যতোটা গুরুত্ব দিতেন, চিন্তা করতেন, এখানে তা করেন না। লাইক দিয়ে দেন।
এটা আরো ভালোভাবে বুঝতে পারবেন, যদি বলি আপনি কোন পর্নো তারকার, বা এইরকম কোন জিনিশের পেইজে লাইক দেন না কেন ফেসবুকে?
কারণ আপনার ক্লাসের, ফ্যামিলির লোকেরা দেখলে আপনার ইজ্জ্বত যাবে। আপনার সম্পর্কে তাদের ধারণা খারাপ হবে। ফলে আপনে ঐগুলাতে লাইক দেন না।
ঠিক এই কারণেই পাড়ার কোন খারাপ লোককে সমর্থন দিতে আপনি যান না।
কিন্তু যখন ফেসবুক পোস্টগুলা অত ক্লিয়ার খারাপ হয় না, তখন মানুষ বেশি বিবেচনা করেন না লাইক দেবার আগে।
কারণ তাদের কাছে মনে হয় এটা লাইকই, আর কিছু না। হাসি কৌতুকের পোস্ট দিয়ে দিলাম লাইক। লাইকদাতা জানেন এই লাইক অস্পষ্ট কমিউনিকেশন, লাইক দেবার জন্য তারে শাস্তি দিবে না কেউ এখানে।
সমস্যা হয় যখন এইরকম সোশ্যাল ক্যাপিটাল গেইন করে, কেউ কেউ ফেসবুক সেলেব্রেটি হয়ে এটা খারাপ উদ্দেশ্যে এনক্যাশ করেন। ধরা যাক, কোন ফটকা কোম্পানি, যেমন ইভ্যালির ব্র্যান্ড মুখ হয়ে মানুষের টাকা হাতিয়ে নিলেন তিনি। মানুষেরা তাকে বিশ্বাস করল, কারণ ভোট ব্যাংকে তার লাইক বেশি ছিল, সোশ্যাল প্রুফে তার সোশ্যাল ক্যাপিটাল বেশি দৃশ্যমান ছিল। এইখানে, ঐ যারা কোন কিছু না ভেবে লাইক দিয়েছিলেন, তথা ভোট দিয়েছিলেন, তারাই কিন্তু তাকে পাওয়ারফুল করে তুলেছেন অন্যদের টাকা হাতিয়ে নেবার মত পাওয়ার অর্জন করতে। কিন্তু অবশ্যই ঐ লাইকদাতারা প্রত্যক্ষ দোষী নন, কেউ তো জানে নাই তিনি কীভাবে এই ক্যাপিটাল এনক্যাশ করবেন, কিন্তু তারা না ভেবে চিন্তে লাইক দিয়ে থাকলে, পরোক্ষভাবে তাদের উপর দায় বর্তায়। এই দায় নির্বুদ্ধিতারও।
এইভাবে ভোট তথা লাইক দিয়ে দিয়ে সমাজের জন্য ক্ষতিকর সামাজিক এনটিটি তৈরি করা সম্ভব।
লাইক যেহেতু সোশ্যাল ক্যাপিটাল, সেহেতু ক্ষমতার অংশ। প্রত্যেকটা লাইক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পাওয়ারের ভগ্নাংশ।
এবং সাধারণত, লাইক পাওয়ার হওয়ায় ফেসবুকের মত মাধ্যমে জ্ঞান সাধনা ও খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব। কারণ ট্রুথ কম লাইক পেলে তা নিচে চলে যাবে, ফলে কম গুরুত্ব পাবে। পক্ষান্তরে, ফালতু ও ফাতরা লেখা বেশি লাইক পেলে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে। জ্ঞান পাওয়ারের রক্ষিতা বা বউ হলে, সেটা পাওয়ারের অংশ হয়, তার নিজের অবস্থান হারায়।
Like