মামুনুল হক ও হাছান মাহমুদের ভোজন
মামুনুল হকের খাবারের ছবি একবার ভাইরাল হইছিল। এবার হইল হাছান মাহমুদের খাওয়ার ছবি।
মামুনুল হকের খাবার ছবি দেয়ারা এবার ছবি দিতেছেন না। তারা এবার মন্ত্রীর ছবিটা ফেইক কি না, সেই বিষয়ে তারা চিন্তিত।
মামুনুল হকের ছবি যারা দেন নাই, এইবার হাছান মাহমুদের ছবি তারা দিতে পারতেছেন। ছবি দেয়ার ক্ষেত্রে সবার সুযোগই আছে, এবং এই ক্ষেত্রে আল্লাহর অসীম কৃপায় কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, তা হয় না।
পয়েন্ট এইখানে হিপোক্রেসি না, যেহেতু এইটা এত কমন যে, এ নিয়ে কথা বলে লাভ তেমন নাই। হিপোক্রেসির চেয়েও বড় বিষয়, খাইতে থাকা একজন লোকের ছবি ব্যবহার করে, তার খাওয়ারে আক্রমণ করাটা নিয়ে।
দুই পক্ষই এটা করলেন।
মামুনুল হকের ছবির টাইমে আমার বিরক্ত লাগছিল, কারণ খাওয়া নিয়া কথা না বলে যেখানে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টই আছে ঐ ব্যক্তির, সেখানে খাওয়াটারে ফোকাস করা অরুচিকর, এবং দুর্বলও পয়েন্ট হিশাবে। জনাব হাছান মাহমুদের ছবির ক্ষেত্রেও একই কথা।
মামুনুলের ছবি দেয়ারা, বা মন্ত্রীর ছবি ফেইক কি না বলনেওয়ালারা, এত পদ নিয়া খাবারের ছবির বিরুদ্ধেই। ছবিগুলা তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু।
উচ্চ মিডলক্লাস কমবেশি এইভাবেই খায় দাওয়াতে। বুফে তো খানই, পারিবারিক দাওয়াতেও প্রায় এইরকম আয়োজন থাকে।
এর মানে এই না হাছান বা মামুনুল ওইসব খাবার একা খাইয়া ফেলতেছেন। এক ব্যক্তির খুব বেশি খাইলেও এতসব খাওয়া পসিবল না।
দাওয়াত যারা দেন, তারা তাদের আতিথেয়তার পাওয়ার দেখাইতে অনেক পদ আয়োজন করেন, সাজান। খুব বেশি খরচও যে হইছে ঐ দুই টেবিলের খাবারে এমনও না। এইটাও না যে এরা প্রতিদিনই, প্রতি অক্তে এইরকম খান।
তবে, প্রতিদিন নন ভিজুয়াল ভাবে খাইতে পারেন অনেক কিছু, যেমন ঘুষ, ব্যাংকে টাকা আসতেছে, জনগণের টাকা, মানবাধিকার ইত্যাদি।
মন্ত্রীর পেইজ থেকে লোকেরা জানান দিছে এটা নাকি ফেইক ছবি। তখন ছবি দাতারা দেখাইছেন এটা আসল ছবি।
সুতরাং দেখা যাইতেছে মানুষ যে ছবিটারে খারাপ হিশাবে নিছে, এটা মন্ত্রীর লোকদের ভালোই গায়ে লাগছে। তারা মনে করতেছে এটা তার রেপুটেশনের জন্য খারাপ।
তারা কি ভাবছে মানুষেরা এই ছবিটারে সিম্বোলিক হিশাবে নিছে? ও বুঝাইতেছে এইভাবেই এরা দেশটারে খাচ্ছে?
এমন হবে ধারণা করি।
এত পদ সামনে নিয়া যখন মন্ত্রী খাইতেছেন, সিম্বলিক্যালি এইখানে মানুষের কাছে যায় মেসেজ, কত আরামে আছে, এইভাবেই এরা খাচ্ছে সব, আমাদের ভাগ না দিয়া?
মামুনুল হকের ছবির ক্ষেত্রে কী হইছিল, তিনি তো আর মন্ত্রী না। তবে তিনিও এক অথরিটি, সামাজিক ধর্মীয় নৈতিকতার অথরিটি।
সেইখানে মানুষের, মানে যারা ছবিটা দিয়া আক্রমণ করছিলেন তাদের পয়েন্ট ছিল, দেখো এরা কীভাবে খাইতেছে, মানুষরে ভুলভাল বুঝাইয়া, কিন্তু নিজেরা কীরকম খায়!
আমি মনে করি, মানুষের খাবার ছবি নিয়া তারে এটাক লেইম হয়।
খাবারের ছবি
ফুড গ্রুপগুলাতে অনেকে দামী দামী খাবারের ছবি দেন। খাবার দোকানের বিজনেসের জন্য এই ব্যাপারটা ভালো। এই জায়গায়, খাবার সোশ্যাল স্ট্যাটাস বাড়াইতে সাহায্য করে। একজন দামী খাবারের ছবি দিয়া বুঝাইতে পারেন যে তিনি এগুলা খাইতে পারেন, তার সেই এবিলিটি আছে। মানুষ কিন্তু তাঁর নিত্যদিনের খাবারের ছবি দেন না। এইসব ক্ষেত্রে, খাবারই মানুষরে খায়।
তবে খাবারের ছবি দেবার উদ্দেশ্য আরও অনেক হইতে পারে। যেমন অই খাবার অনেক ভালো লাগে কারো, সেই ভালো লাগার প্রকাশ ঘটাইতেও অনেকে দেন।
রান্না করে কেউ সেই খাবারের ছবি দিলে তা আরও ব্যতিক্রম। এটা আর্টের মত। যেমন একজন লেখক তাঁর বইয়ের ছবি দেন বা ফটোগ্রাফার তার ফটো দেন, তেমনি হয়।
খাওয়া ও বাঙালি
খাওয়া বাঙালি সমাজ সংস্কৃতিতে টিকে থাকা নিরাপত্তার সমার্থক। এইজন্যই এই বিখ্যাত লাইন আমরা শুনি, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। বা মাছে ভাতে বাঙালি। বা একসময় ছিল গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু।
অর্থাৎ নিরাপত্তা ও প্রাচুর্য বুঝাতে আসে খাবারের অনুষঙ্গ।
হাজার বছর ধরে উপন্যাসে মন্তু টুনিরে বলে, “খাইছো?” এই জিনিশরে আধুনিক পপ কালচারের ট্রল বাবু খাইছোর সাথে মিলানো যায়। খেয়াল কইরা এই বাবু খাইছো একসময় কিছু লোক ব্যবহার করত, পরে এইটা নিয়ে ট্রল শুরু হয়।
খাইছো কিন্তু আসলে কালচারাল জিনিস, অনেক গভীরে আছে। ধরেন এই জায়গায়, বুড়া মকবুলের ঘরে খাবার নাও থাকতে পারে। সে যেহেতু নিজে কিছু করে না বউদের কাজ করাইয়া চলে। সুতরাং, টুনি না খাইয়া থাকতে পারে। অথবা বুড়া মকবুলের সাথে বা সতীনদের সাথে তার ঝগড়াও হইতে পারে এবং এজন্যও সে না খাইয়া থাকতে পারে। সুতরাং, মন্তুর এই এক খাইছো প্রশ্নে যে কেয়ার আছে, আর কোন সহজ কথায় এমন তীব্র কেয়ার হয়ত দেখানি যাইত না। মনে হয় না অন্য কোন ভাষাতে এমন খাইছো এর মত সহজ কিন্তু ডিপ কেয়ারিং শব্দ আছে।
খাবারের সাথে কালচারাল সংশ্লিষ্টতার কারণ সম্ভবত, এই অঞ্চল নিচু হওয়ায় প্রাকৃতিক দূর্যোগ প্রবণ ছিল। বন্যা হইত অনেক। এতে ফসল পানির নিচে গিয়া নষ্ট হইত। দেখা দিত খাদ্যাভাব। বাংলায় খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকেও দূর্ভিক্ষ হইছিল এমন নজির মিলে মহাস্থান গড়ের শিলালিপিতে। বাংলায় ১১৭৬ সালের মনত্ত্বরের প্রধান কারণ ছিল ব্রিটিশ নীতি, অতি বৃষ্টি ও বন্যা। ১৮৯৮-৯৮, ১৯৪৩, ১৯৭৪ সহ নানা সময়ে বাংলায় দুর্ভিক্ষ ও খাদ্যাভাব ছিল।
বাংলাদেশে ক্ষুধার বাস্তবতা গ্লোবাল হাংগার ইনডেক্স থেকে দেখা যায়। হাংগার ইনডেক্সে ০ হচ্ছে ক্ষুধামুক্ত, যত বেশি হবে মান তত বেশি ক্ষুধা।
ইন্ডিকেটর | বাংলাদেশে অবস্থা |
---|---|
দেশে মোট জনসংখ্যার অনুপাতে কত মানুষ অপুষ্ঠ আছে। যতটা খাওয়া দরকার খাইতে পারতেছে না। | ১০০ জনে প্রায় ১৩ জন। তীব্র খাদ্য অনিরাপত্তায় আছে ১০০ জনে প্রায় ১০ জন। |
এই অপুষ্ঠির কারণে, ৫ বছরের নিচের শিশুদের কত অংশ একটি মেডিকেল কন্ডিশন ওয়েস্টিং এর শিকার। | প্রতি ১০০ জনে প্রায় ১২ জন। |
কত অনুপাত পাঁচ বছরের নিচের শিশু অপুষ্ঠির কারণে আরেকটি মেডিকেল কন্ডিশন স্টান্টেড গ্রোথ এর শিকার। অপুষ্ঠির কারণে উচ্চতায় খাটো। | বাংলাদেশে মোট শিশুদের মধ্যে ১০০ জনের ৩৭ জনই এমন। |
পাঁচ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুহার। | ৩.০৮% |
উৎসঃ Max Roser and Hannah Ritchie (2019) – “Hunger and Undernourishment”. Published online at OurWorldInData.org. Retrieved from: ‘https://ourworldindata.org/hunger-and-undernourishment‘ |
১৯৯২ এর দিকে বাংলাদেশ ক্ষুধা ইনডেক্সে ছিল ৫২.৪০। এখন ২৬।
হাংগার ইনডেক্স মতে ৫০ এর উপরে হলে খুবই এলার্মিং অবস্থা। সেইখান থেকে কমে বাংলাদেশ এখন যে অবস্থায় আছে, এটাও হাংগার ইনডেক্স মতে “সিরিয়াস” অবস্থা।
অর্থাৎ, খাদ্যাভাব বাংলাদেশে এখনো তীব্রই। রিমার্কেবল উন্নতি হইছে, কিন্তু এখনকার অবস্থাও খারাপ।
ঘানায় ক্ষুধা ১৯৯২ তে ছিল ৪২.৭০ এবং এখন ১৫.২০।
বাংলাদেশে এখনো ক্ষুধা ও খাবার এক সিরিয়াস বাস্তবতা। ভারতচন্দ্রের কাব্যে দেবী অন্নপূর্ণার কাছে ঈশ্বরী পাটনী সন্তান দুধে ভাতে থাকার যে প্রার্থনা করেছিলেন, তা এখন পর্যন্ত রিয়ালাইজড হয় নি, ঈশ্বরী পাটনীরে বঙ্গজননী এবং বাংলায় জন্ম নেয়া সকল লোকরে বঙ্গ সন্তান ধরলে।
এমতাবস্থায়, যখন বেশি পদের খাবারের ছবিওয়ালা মামুনুল হক ও মন্ত্রী হাছান মাহমুদরে নিয়া মানুষ ট্রল করেন ও হাসেন, তাদের এইটাও ভাবা উচিত, এইরকম দাওয়াত, রেস্টুরেন্টে গিয়া খাওয়া ইত্যাদিতে খাদ্য অপচয় হইতেছে কি না, যেইটার অংশ তারা নিজেরাও। যেই দেশে হাংগার সিরিয়াস সমস্যা গ্লোবাল বিচারে, সেই দেশে খাদ্যের অপচয় সিরিয়াস অন্যায়।
তবে আমি এই আপত্তি তুলি না দেশের মানুষ ক্ষুধায় আছে তাই অন্যরা খাবারের ছবি ফেসবুকে দিতে পারবে না।