আমারে কয়েকজন জিজ্ঞেস করলেন, আমার তো বয়েস হয়ে গেছে ২৬, কিন্তু কিছু করি নাই, তাহলে এখান থেকে কি বেটার কিছু করা যাবে।
এইরকম প্রশ্ন, এবং আমাদের প্রতিদিনের কাজে, সিদ্ধান্তে ও চিন্তায় “বয়স” নামের জিনিশটা আছে।
কিন্তু এই জিনিশটা আসলে কী?
১
এইজরে ধরা হয় সময় মাপার ধারণা হিশাবে। উনার বয়স ত্রিশ বছর মানে, উনি সময়ের স্কেলে ত্রিশ বছর সময় ধরে আছেন, এমন আমরা ধরি।
এই ধরার কারণেই আমাদের মনে – বয়েস বেশি হয়ে যাওয়া, বা বয়েস বেশি হয়ে গেছে এখন শুরু করতে পারব কি না, বা অত বয়েস হবার পরেও সুন্দর ইত্যাদি চিন্তা আসে।
এই যে বয়সরে সময় মাপার স্কেল হিশাবে ধরা হয়, এটা ভুল।
কারণ আপনি ভাবলেই বুঝতে পারবেন, সময়ই আসলে বয়স মাপার স্কেল। আপনার যদি বয়েস না থাকে, তাহলে আপনার অস্তিত্বই থাকে না, তখন আপনার জন্য সময়ও থাকে না।
সময়রে বুঝতে হইলে আমাদের অবশ্যই বয়স লাগবে।
২
একজন ব্যক্তির এইজের কথা বলছি। ধরা যাক, তার বয়স ২৫। ঐ সময়ে তার ভেতরে যে “আমি” আছে, উনি ত্রিশ বছরে গেলেও সেই “আমি”ই থাকে। তার চিন্তার বদল হইতে পারে, দৃষ্টিভঙ্গি লাইফস্টাইল বদলাইতে পারে, কিন্তু ওই “আমি” ঠিকই থাকে। কোন একটা ভাবে শুরুর আমির সাথে তার একটা পরিচয়সূত্র বিদ্যমান। ঐ “আমি” দ্বারাই তিনি সব প্রত্যক্ষ করেন।
মানুষ আসলে প্রতিটা দিনেই তার জীবন যাপন করে। সে যদি কাল ঘুম থেকে আর না উঠে, মারা যায়, তাহলে তার দিন যাপন শেষ। তার জীবনও শেষ। তার জন্য বয়েস শেষ, সময়ও শেষ।
৩
কিছু দ্রব্য আছে, যেগুলা নির্দিষ্ট সময়ের পরে নষ্ট হয়ে যায়। যেমন, কোন সব্জী, ধরা যাক কুমড়া।
একটা কুমড়া আমি ঘরে রাখলাম, এবং একটা মানুষরে রাখলাম।
এই দুই জিনিশ আমার কাছে এক না কারণ কুমড়ার “আমি” নাই, কিন্তু ওই মানুষের “আমি” আছে।
কুমড়া আমার কাছে বস্তু, কিন্তু মানুষ বস্তু না।
কারণ তার ‘মানুষতা” আছে। কোন মানুষরে বস্তু মনে করা মৌলিক অনৈতিকতা।
৪
মানুষ কেবল তার বডি হইতে পারে না। কারণ, আমরা দেখি যে, আলাদাভাবে বডির অংশগুলা মানুষের মত কাজ করতে পারে না।
বডি বিভিন্ন অংশ সংযুক্ত হয়ে আমরা যেটাকে বলি প্রাণ বা আত্মা তার কারণে, বা অন্য কোনভাবে মিলিত সিস্টেম হিশাবে কাজ করে। ঐটাই তার আমি বা মানুষতা। অনেক ধর্ম এই জায়গায় বলে, আত্মা অবিনশ্বর।
অর্থাৎ, এইসব ধর্ম মানুষরে বস্তুর চাইতে বড় বলে ঘোষণা করে।
৫
একটা কুমড়ার বা মানুষের আলাদা কোন অংশের বয়স, আর মানুষের বয়স একই পাল্লার জিনিশ হতে পারে না।
প্রথম দুইটা যেহেতু বস্তু, তারা একসময় পচে যাবে আমরা জানি, ও সেইটার উপর ভিত্তি করেই আমরা তার বয়েসের মাপ ঠিক করি, ও তাকে সেইভাবে দেখি।
কিন্তু একইভাবে যখন আমরা কোন জীবিত মানুষকে দেখি, তার বয়েস হয়ে গেছে, তার টাইম শেষ, ক্ষমতা শেষ ইত্যাদি সংযুক্ত ধারণাগুলি, তখন আমরা তাকে বস্তু হিশাবেই দেখি।
এবং মানুষকে, সেটা অন্য মানুষ বা নিজে যেটাই হোক না কেন, মানুষকে বস্তু হিশাবে দেখা মৌলিক অনৈতিকতা।
৬
বয়স এবং এর সমাজে এর ব্যবহার একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যু।
সাম্প্রতিক কালে আপনারা দেখবেন বাংলাদেশের ক্রিকেটার ইমরুল কায়েস বলেছেন বয়েস ত্রিশ হলেই আমাদের দেশে ধরে নেয়া হয় এর দিন শেষ। শোয়েব মালিক তার বয়সের জন্য আলোচনায় ছিলেন এই বিশ্বকাপে, এবং তিনি ম্যাচ জেতালেও পত্রিকা লিখেছে প্রশংসায় বুড়ো হাড্ডির জোর দেখালেন তিনি।
আরেকটি কমন পপ কালচার ঘটনা, জয়া আহসানের সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে তার এইজকে সামনে নিয়ে আসছেন তার ভক্তদের অনেকে।
এইসব প্রশংসার সেন্টার পয়েন্ট হচ্ছে, বয়স বাড়লে সৌন্দর্য কমবে, বা শক্তি কমবে, অর্থাৎ সে ভ্যালু হারাবে।
এই ধারণাটার মূলে আধুনিক সমাজের ভ্যালুর ধারণা, যেটা ক্যাপিটালিস্ট।
এক্সট্রিম ক্যাপিটালিস্ট ভিউতে গেলে, শ্রমিক হচ্ছে প্রডাকশনের বস্তু। ততক্ষণ তার ভ্যালু আছে যতক্ষণ সে শ্রম দিয়ে আমার লাভে সহায়তা করতে পারবে। যতদিন যাবে, যত তার বয়স হবে তত সে তার ভ্যালু হারাবে, কারণ তার উৎপাদনের ক্ষমতা কমে যাবে।
যেমন একটা বস্তুর ক্ষেত্রে হয়। আমার মোবাইল যত দিন যাবে, তত তার ভ্যালু হারাবে।
আধুনিক সমাজে এই ধারণা প্রচলিত থাকায়, মানুষ মানুষের “ভ্যালু”রে তার বয়সের সাথে যুক্ত করে দেখে।
৭
এখন আসলে ভ্যালু কী?
ধরা যাক, আপনার মা আপনাকে এক কাপ চা বানালেন। দশ টাকা হবে এই চায়ের দাম।
আপনি কোন এক রেস্টুরেন্টে ৫০ টাকা দামের চা খেলেন।
এই দুই কাপের মধ্যে কোন কাপের ভ্যালু বেশি?
বাজারমূল্য বলেই দিয়েছি, রেস্টুরেন্টের চা ৪০ টাকা বেশি এগিয়ে বাজার মূল্যে। আপনার মায়ের হাতের চা বাজারে বেচলে আপনি ৫০ টাকা কখনোই পাবেন না। ইভেন, আপনি ব্যবসা করতে চাইলে আমি পরামর্শ দিব না, আপনার মায়ের হাতের চা ৫০ টাকায় বিক্রির চেষ্টা করেন বাজারে।
কিন্তু আপনার কাছে ভ্যালুর দিক থেকে, আপনার মায়ের হাতের চা বেশি ভ্যালুয়েবল।
এখানে ভ্যালুর জায়গাটা অদৃশ্য একটা বাস্তবতা যে, এটি আপনার মা বানিয়েছেন।
যে কারণে পৃথিবীর ৭ বিলিয়ন লোকের মধ্যে, অনেক অনেক ভালো মহিলা থাকলেও কেবল এই মহিলা আপনার মা হন, বা আপনার কাছে বিশেষ হন, সেই একই কারণে তার হাতের চায়ের চাইতে দামী চা বাজারে থাকলেও, তার চা আপনার কাছে বেশি ভ্যালুয়েবল হয়।
প্রডাকশনমুখী ক্যাপিটালিজম এই ভ্যালু বুঝে না।
৮
মানুষকে ও নিজেকে সম্মান করা হল, মানুষকে বস্তু মনে না করা।
যে ভ্যালু ক্যাপিটালিজম বুঝে না, অর্থাৎ বস্তুগত অবস্থার বাইরে গিয়ে, মানুষকে তার প্রধান জিনিশ, যেই কারণে সে মানুষ সেই “মানুষতা” দিয়ে বুঝা।
এইভাবে চিন্তা করতে পারলে আপনি দেখবেন, মানুষ ও আপনি নিজে, অসীম সম্ভাবনা নিয়ে আছেন।
কোন এইজ বা এইরকম মানসিক বাঁধ বাঁধা হবে না।