ইনারিতোর এমোরেস পেরোস তিনটা গল্প আর একটা দূর্ঘটনার ফিল্ম। কার এক্সিডেন্ট প্রথমেই ঘটে। এই দূর্ঘটনার সাথে যুক্ত তিনটা ক্লাসের তিনটা গল্প তুলে ধরা হয়েছে। তিনটাতেই ভালোবাসা প্রাধান্য পেয়েছে। এবং যা দেখা যায়, তিনটা গল্পেই ভালোবাসা কিছু কমপ্লেক্স দুঃখ নিয়ে আসে। এমোরেস পেরোসের ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে লাভ’জ এ বিচ। পরিচালক একে বলেছেন দূর্বল অনুবাদ। তিনি বলেন এটা একটা এপোরিজম তার মানে এরকম, “কখনো তুমি ভালুক শিকার করো, আর কখনো ভালুক শিকার করে তোমারে।”
তিনটা গল্পেই কুত্তা আছে।
প্রথম গল্পে অক্টাভিও নামে এক যুবক তার ভাইয়ের বউয়ের প্রেমে পড়ে। সে মেয়েটিকে নিয়ে দূরে পালিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখে। তার কুত্তা কফি একদিন ঘটনাক্রমে ডগ ফাইটে জেতা একটা কুত্তাকে মেরে ফেলে।
অক্টাভিও তার ভাইয়ের বউরে নিয়ে পালিয়ে যেতে চায়। এর জন্য তার টাকা দরকার। তার মাথার বুদ্ধির উদয় হয় কফির বীরত্ব দেখে। যদিও অক্টাভিও তার কুত্তাকে ভালোবাসে, যদিও সে জানে ডগফাইটে তার কুত্তার মরে যাওয়ার চান্স আছে তথাপি সে কফিরে নিয়া ডগ ফাইটে যায়। এখানে দুই ভালোবাসার মধ্য থেকে এক ভালোবাসাকে অক্টাভিওর স্যাক্রিফাইস করতে হইছে।
ডগ ফাইটে তার কুত্তা জিততে থাকে এবং সে টাকা জমিয়ে তার ভাত্রীবধূরে নিয়ে দূরে চলে যাবার স্বপ্নে আরো মগ্ন হয়।
অক্টাভিওর ব্রাদার আবার খুব হিংস্র টাইপ। সে তার বউকে প্রায়ই প্রহার করে। তার বউ অর্থাৎ যারে আমাদের নায়ক অক্টাভিও লাইক করেন। কিন্তু তার বউ তাকে ভালোবাসে, প্রহার স্বত্ত্বেও। ফলে সে অক্টাভিওরে আশকারা দিলেও জামাইরে ছাড়তে চায় না।
একসময় অক্টাভিওর কুত্তা গুলিতে আহত হয়। এইটাই মূলত ছিল গাড়ি দূর্ঘটনার কারণ।
অক্টাভিওর গল্প ওয়ার্কিং ক্লাসের। এরপরের গল্প উঁচা শ্রেণীর। অক্টাভিওর কুত্তা কফি গুলিতে একদিন আহত হয়। তারে নিয়া অক্টাভিও এবং তার এক ফ্রেন্ড খুব দ্রুত গাড়ি চালাইতেছিল। এইখানেই একসিডেন্ট হয়। তাদের ধাক্কা লাগে সুন্দরী লম্বা ট্যাং এর মডেল ভ্যালেরিয়ার গাড়ির সাথে।
মডেল ভ্যালেরিয়ার সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল ড্যানিয়েলের। ড্যানিয়েলের এক বউ আর দুই ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে আছে। ফিল্মে দেখা যায় ড্যানিয়েল তার বাচ্চাদের অনেক ভালোবাসেন। বাচ্চাদের ছবি তার অফিসের টেবিলে একসময় দেখা যায়।
যাইহোক, ভ্যালেরিয়ার প্রেমে পড়ে ড্যানিয়েল দুই মেয়ে এবং এক বউয়ের মায়া ত্যাগ করে তাদের ছেড়ে চলে আসেন। এখানেও খেয়াল করলে দেখা যাবে লাভের জন্য লাভ বিসর্জন। অর্থাৎ ভ্যালেরিয়ার মায়ায় পইড়া স্ত্রী কন্যার মায়া ত্যাগ করলেন ড্যানিয়েল।
ভ্যালেরিয়ার সাথে তার নয়া সংসার শুরু করার কথা ছিল। ভ্যালেরিয়া তখন দেশের সেরা সুন্দরী মডেল। কিন্তু এরই মাঝে ভ্যালেরিয়া তার কুত্তা রিচিকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন অক্টাভিওর দ্রুতবেগে আসার গাড়ির সাথে তার গাড়ির ধাক্কা লাগে।
দুইটা ক্লাসের এমন মিলন অবশ্যই সুখকর নয়। যেখানে একটু আগে ফিল্মে দেখানো হয় ওয়ার্কিং ক্লাসের প্রতিনিধিত্বকারী অক্টাভিওর বন্ধু টিভি টকশোতে ভ্যালেরিয়াকে দেখে তার মুগ্ধতা প্রকাশ করে। এই দুই ক্লাসের এমন সংযোগ সহজ ছিল না, কিন্তু দূর্ঘটনা তা সহজ করে দেয়।
যাইহোক, দূর্ঘটনায় ভ্যালেরিয়ার পা ভেঙ্গে যায়।
এই ভাঙ্গা পা নিয়া ভ্যালেরিয়া এবং ড্যানিয়েলের একত্রে থাকা শুরু হয়। এই ধরনের অবস্থায় যদি ভ্যালেরিয়ার পা ভালো থাকত তাহলেও সাইকোএনালিস্টরা বলবেন, “ড্যানিয়েল এখন বুঝতে পারবে ভ্যালেরিয়াকে সে চায় নি। কারণ মানুষ জানে না সে কী চায়। ফলে ভ্যালেরিয়ার সাথে তার সম্পর্ক ভেঙ্গে যাবে।”
ফিল্মে সেটা হয় নি। ভাঙ্গা পাওয়ালা ভ্যালেরিয়ার সাথে ড্যানিয়েল সংসার চালিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেন। তখন আবার এক সমস্যা দেখা দিল। এইবারের সমস্যা ভ্যালেরিয়ার পিচ্চি কুত্তা রিচি।
ড্যানিয়েল-ভ্যালেরিয়ার এপার্টমেন্টে একটা গর্ত ছিল। সেই গর্ত দিয়ে রিচি নিচে নেমে যায়। সে আর আসে না। মাঝে মাঝে তার পদশব্দ শোনা যায়। ভ্যালেরিয়ার অশান্তি বাড়তে থাকে। কারণ সে রিচিকে অত্যধিক ভালোবাসে। এবং এই রিচির জন্য তার ভালোবাসা এবং উদ্বেগ ড্যানিয়েলের সাথে কিছু ঝামেলা তৈয়ার করে।
এখানে আমরা আরেকটি কমপ্লেক্স লাভ পাইলাম, রিচির প্রতি ভ্যালেরিয়ার ভালোবাসা। যেটা তাকে অশান্ত করে তুলে।
পরে এক সময় ড্যানিয়েল ফ্লোর ভেঙ্গে রিচিকে বের করে আনে, মৃত অবস্থায়। ভ্যালেরিয়ার পায়ের ক্ষত পচে যায়, রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায় সে অংশে। ফলে ডাক্তার বলেন কেটে ফেলতে হবে।
এইভাবে চলতে থাকে ড্যানিয়েল-ভ্যালেরিয়ার সংসার। তারপরে তাদের কী হয় আর বলা হয় নি। ভালো গল্পকারেরা সব গল্প বলে দেন না।
এবার তৃতীয় গল্পের দিকে হাটা যাক। তৃতীয় গল্পে আছেন একজন হোমলেস মানুষ। বুড়া মানুষ। তিনি কিছু রাস্তার কুত্তা পুষেন। তাদের নিয়ে বসবাস করেন। চুল দাঁড়িতে আকীর্ন তার মুখমন্ডল ও মস্তক। হাতের লম্বা নখ এবং তার ভেতরে নিবিড় বাসস্থান গড়ে নেয়া ময়লা। দেখতে তিনি যেন একালের ডায়োজিনিস।
এই বৃদ্ধ কন্ট্রাক্টে খুন করেন। একসময় তিনি ছিলেন প্রফেসর। তার ছিল এক কন্যা ও এক বউয়ের সুখী সংসার। তিনি তার পরিবার এবং কন্যারে ভালোবাসতেন। একসময় তার মনে হল, পৃথিবীটাকে বদলানো দরকার। বিপ্লবী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন। জেল খাটেন দীর্ঘদিন। এরপর থেকে কন্ট্র্যাক্টে মানুষ মারেন। মানুষের প্রতি তার কোন দয়ামায়া নাই। শুধুমাত্র তার কন্যা ছাড়া। আর তার মমতা কুত্তাদের জন্য।
তিনি খুন করে পয়সা জমান তার কন্যার জন্য। তাদের যে তিনি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন এই অপরাধবোধ তাকে দগ্ধ করে প্রতিনিয়ত।
অক্টাভিওর গাড়ি যখন ভ্যালেরিয়ার গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে ধুন্ধুমার অবস্থার সৃষ্টি করে ফেলেছে, তখন তিনি রাস্তার পাশেই ছিলেন। গিয়েছিলেন একটা খুনের কাজে। দূর্ঘটনা দেখে এগিয়ে যান। মৃত অক্টাভিওর পকেট হাতড়ে টাকা সরান। তারপর কোনরূপ আবেগ অনুভূতির প্রকাশ না দেখিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ তার চোখে পড়ে অক্টাভিওর কুত্তা পড়ে আছে। আগেই বলেছি এই কুত্তার নাম কফি এবং সে গুলি খেয়েছিল, তাকে নিয়েই দ্রুত গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিল অক্টাভিও এবং তার এক বন্ধু।
বৃদ্ধ লোক গুলি খাওয়া কফিকে দেখে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি কফিকে তার বাসস্থানে নিয়ে যান। শুশ্রুষা করে সুস্থ করেন।
তারপর একদিন বাইরে থেকে ফিরে এসে তিনি দেখেন তার সাত/আটটা কুত্তা মরে আছে। কফি মেরে ফেলেছে। যেহেতু কফি ডগ ফাইটে ছিল সুতরাং ফাইট তার নেশা। বৃদ্ধের হৃদয় প্রতিহিংসায় জ্বলে উঠে। কারণ এই কুত্তাগুলোই ছিল তার নিত্যসঙ্গী। তিনি পিস্তল বের করে কফির দিকে তাক করেন। কিন্তু কফিকে মারতে পারেন না। অবুঝ কুত্তাদের প্রতি তার মমতার কাছে তিনি হার মানেন।
বৃদ্ধ তার পোষা কুত্তাদের মৃতদেহ জ্বালিয়ে ফেলেন। আর জ্বলে যায় তার সব প্রতিহিংসা। মানুষের ওপর যে প্রতিহিংসা বা ঘৃনার কারণে তিনি ভাড়াটে খুনী হয়েছিলেন তা জ্বলে শেষ হয়ে যায় যেন।
পরে দেখা যায় তিনি দাঁড়ি গোফ কামিয়ে, নখ কেটে তার মেয়ের বাসায় যান। গোপনে দরজা খুলে প্রবেশ করেন। তার অর্জিত সব টাকা মেয়ের বালিশের তলায় রাখেন। নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলে রেখে আসেন ফোনের রেকর্ডারে। তারপর ফিরে আসেন। মেয়ের মুখোমুখি আর হন না তিনি।
শেষে আবার অক্টাভিওর গল্প দেখানো হয়। অক্টাভিও তার ভাইকে কিছু হায়ার করা গুন্ডা দিয়ে পিটাইছিল তার ভাতৃবধূর প্রতি প্রেমের কারণে। এতে হীতে বিপরীত হয়। অক্টাভিওর ভাই ভাবী তাদের ছেড়ে দূরে চলে যায়। এই অংশ প্রথম গল্পেই ছিল। শেষকালে দেখানো হয় অক্টাভিওর ভাই ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে খুন হয়েছে। অক্টাভিও দূর্ঘটনায় হাত হারায়, কিন্তু তবুও সে তার ভাতৃবধূরে পাওয়ার আশা ছাড়ে না।
তার এই হাত হারানো, কুত্তা হারানো, এমনকী ভাই হারানোও এই মেয়ের জন্য। কিন্তু শেষকালে সে বাসট্যান্ডে মেয়ে অর্থাৎ তার ভাতৃবধূর জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু মেয়ে আসে না। কারণ মেয়েটা একটা হাতহীন, দূর্ঘটনাপীড়িত লোকের সাথে ভাগতে নারাজ হয়ত।