আফগানিস্তানের দিকে তাকিয়ে আওয়ামিলীগ-হেফাজত সমঝোতা বুঝা

বাংলাদেশের বর্তমান আওয়ামিলীগ সরকার হেফাজত তথা কওমী ধারার ইসলামিস্টদের সাথে সমঝোতায় গেছেন সম্প্রতি। কওমী নেতাদের দীর্ঘদিনের দাবী ছিল দাওরায়ে হাদীসকে মাস্টার্স এর সমমান দেয়ার জন্য, বর্তমান সরকার তাদের এই দাবী পূরণ করেছেন। আওয়ামিলীগের শাসনামলেই হেফাজতের আন্দোলন শক্ত হাতে দমন করা হয়েছিল (৫ ও ৬ মে ২০১৩)। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়ামিলীগ প্রগ্রতিশীল দল হিসেবে পরিচিত আর অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত জোট পরিচিত রক্ষণশীল দল হিসেবে। তাই হেফাজত-কওমীদের সাথে আওয়ামিলীগ সরকারের সমঝোতায় চলে যাওয়া নানা আলোচনা এবং বিস্ময় সৃষ্টি করেছে জনমনে।

বাংলাদেশে যখন আইএস ধারার জঙ্গী তৎপরতা অল্প বিস্তর শুরু হয়েছে, তা সরাসরি আইএস না হলেও আইএস প্রভাবিত নিঃসন্দেহে; এই অবস্থায় আওয়ামিলীগের হেফাজত-কওমীদের সাথে সমঝোতায় যাওয়াকে ভয়ংকর এক পদঃক্ষেপ মনে করা হচ্ছে অতি প্রগ্রতিশীল অংশ থেকে। ৪০৮ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি তাদের মতে “উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কাছে সরকারের অসহায় আত্মসমর্থনের প্রতিবাদ জানিয়ে” একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছেন (১০ মে, ২০১৭)। হেফাজত-কওমী’র সাথে আওয়ামিলীগের এই সমঝোতামূলক অবস্থানে খোদ আওয়ামিলীগের ভেতরেই তৈরী হয়েছে অস্বস্থি, এমন জানাচ্ছে বিবিসি বাংলা (১৪ এপ্রিল,২০১৭)।

আওয়ামিলীগ সরকারের এই অবস্থান বুঝতে হলে, আফগানিস্তানের দিকে চোখ দেয়া যায়। ২০০১ সালে আমেরিকা এবং তার মিত্ররা আফগানিস্তানে যে যুদ্ধ শুরু করে তার উদ্দেশ্য ছিল আল কায়দাকে ধ্বংস করা ও তালিবানকে ক্ষমতা থেকে সরানো। আফগানিস্তান জাতিগত ভাবে ভিন্ন লোকদের একটি দেশ। এবং এর ভূ-প্রকৃতি গেরিলা সংঘটনের জন্য উপযুক্ত। আমেরিকা’র আফগানিস্তানে এই যুদ্ধটি সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী একটি যুদ্ধে পরিণত হয়। এখনো আফগানিস্তানে বিভিন্ন জাতি ভিত্তিক গেরিলা সংঘটন যুদ্ধ করে যাচ্ছে। এদিকে আফগানিস্তানের বর্তমান আশরাফ ঘানি’র সরকার অদক্ষ নেতৃত্ব, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় আক্রান্ত। আমেরিকা এখন চাচ্ছে আফগানিস্তানে তালিবান ও সরকারের মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগির মাধ্যমে একটা মীমাংসা করে চলে আসতে। রাশিয়া এবং পাকিস্তানেরও একই চাওয়া। রাশিয়া মনে করে আফগানিস্তানের নব উত্থিত আইএস জঙ্গীদের দমনে তালিবানদের ভূমিকা অপরিহার্য। এখানে ভারতের দ্বিমত ছিল, কারণ আফগানিস্তানে তালিবানের ক্ষমতা থাকলে তাতে পাকিস্তানের প্রভাবও বিদ্যমান থাকবে, কিন্তু ভারতের আপত্তি টিকে নি।

ছবিঃ মাঝে বামের জন প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি, ডানের জন একসময়ের আফঘান ওয়ারলর্ড গালবুদ্দিন হিকমোতায়ার, যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ভবনে

সম্প্রতি প্রায় বিশ বছর আত্মগোপনে থাকার পর প্রকাশ্যে এসেছেন আফগানিস্তানের হিজব-ই-ইসলামী’র নেতা গালবুদ্দিন হিকমোতায়ার। রাশান আগ্রাসনের সময়কালে যেসব নেতা এর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন তিনি তাদের একজন এবং ১৯৯০ সালের গৃহযুদ্ধে অন্যান্য দলের সাথে কাবুল দখল নিয়ে তিনি কাবুলে ব্যাপক রক্তপাত ঘটিয়েছিলেন। কাবুলে তখন কোন কোন দিনে হাজারের মত রকেট ছোড়া হয়েছে যার বেশীরভাগের পেছনে ছিল হেকমোতায়ারের লোকেরা। এ কারণে তিনি বেশ কুখ্যাত। ১৯৯৬ সালে তালিবানরা পাকিস্তান ও সৌদি আরবের সহায়তায় কাবুল দখল করে নিলে হিকমোতায়ার ইরানে পালিয়ে যান। ২০০২ সালে বহিঃস্কৃত হন ইরান থেকে। ২০০৩ সালে আল কায়দা ও তালেবানকে সহযোগীতার অভিযোগে আমেরিকা তাকে সন্ত্রাসী তালিকায় রেখেছিল কিন্তু ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে আফগানিস্তানের বর্তমান ঘানি সরকারের সাথে তার চুক্তি হয়, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে তার নাম আমেরিকার সন্ত্রাসী তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। আফগান সরকার তার পূর্বের সব অপরাধ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়, তার সাথের যেসব লোকেরা বন্দী ছিল তাদের মুক্তি দেয়। হিকমোতায়ার প্রকাশ্যে আসেন শান্তির আহবান জানিয়ে। তিনি তালেবানদের শান্তির পথে এবং আলোচনার টেবিলে আসার আহবান জানাচ্ছেন এবং তাকে আশরাফ ঘানির সরকারের পক্ষ থেকে বরণ করে নেয়া হয়। যদিও তিনি তার বক্তব্যে পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট সরকার ও সংসদীয় পদ্বতির সমালোচনা করেছেন। অবস্থা দেখে ধারনা করা যায়, তালিবানদের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি ও আফগানিস্থানের ভবিষ্যত রাজনীতিতে তার বেশ বড় ভূমিকা থাকবে।

ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে আফগানিস্তান সরকারের উপর আমেরিকার চাপ আছে। এ নিয়ে সরকার ও তালেবানদের মধ্যে আলোচনা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু যেহেতু বিভিন্ন জাতি ও গোত্র ভিত্তিক এসব গেরিলা সংঘটন, তাই যারা গুরুত্ব পাচ্ছে না বা তাদের মতের সাথে মিলছে না, এদের অনেকে আইএসকে সমর্থন দিচ্ছে এবং হামলায় অংশ নিচ্ছে। ফলে আফগানিস্তানে শান্তি প্রক্রিয়া খুব সহজ বিষয় হবে না।

সম্প্রতি (৮ মে, ২০১৭) আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ফরেন পলিসি ও মিলিটারী উপদেষ্টারা আফগানিস্তানে সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধির ব্যাপারে একটি প্রস্তাব পেশ করেছেন। এই সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে  সম্পূর্নরূপে বিজয় অর্জনের জন্য নয়,  যাতে শেষ একটি আঘাতের মাধ্যমে তালিবানকে আলোচনার টেবিলে আনা যায় এজন্য। অর্থাৎ, যেসব তালিবানরা সরকারের সাথে আলোচনায় বসতে নারাজ তাদের রাজী করানো। ২০০১ এ আমেরিকার পলিসি ছিল দমনমূলক, এবং বর্তমানে বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে তা হয়ে দাঁড়িয়েছে সমঝোতামূলক।

আমেরিকার এই নীতির প্রেক্ষাপটেই বর্তমান আওয়ামিলীগ সরকারের হেফাজত-কওমীদের সাথে সমঝোতাকে দেখা যেতে পারে। আমেরিকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের নীতি’র সময়ে হলে আওয়ামিলীগের এই সিদ্ধান্তকে সন্দেহের চোখে দেখা হত বৈশ্বিক পরিমন্ডলে। কিন্তু বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে তা হচ্ছে না। বরং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি একে ভালো উদ্যোগ মনে করছে। অর্থাৎ, এই পদক্ষেপের জন্য বাইরে থেকে বিরূপ কোন প্রকার চাপের তেমন কোন সম্ভাবনা নেই।

মূলত, এই কারণেই আওয়ামিলীগ সরকারের পক্ষে হেফাজত-কওমী ইস্যূতে সমঝোতামূলক পদঃক্ষেপ নেয়া সহজ হয়েছে। বৈশ্বিক রাজনীতির এই কারণ ছাড়াও অবশ্যই স্থানীয় রাজনৈতিক কারণও আছে আওয়ামিলীগের এই সিদ্ধান্তের। একদিকে শাহবাগ-হেফাজতের পরে প্রগ্রতিশীল এবং অতি প্রগ্রতিশীল অংশের সাথে বিএনপি’র বিরোধ স্পষ্ট হয়ে গেছে এবং এই অংশের পূর্ন সমর্থন স্থায়ীভাবে আওয়ামিলীগ নিজের ঘরে নিতে পেরেছে। ফলে, বর্তমানে হেফাজতের সাথে সমঝোতায় গেলেও এই অংশ আওয়ামিলীগের সমর্থনেই থাকবে, অন্য কোথাও তাদের যাওয়ার জায়গা নেই। ফলে আওয়ামিলীগ ক্ষমতা আরো কিছুদিনের জন্য স্থায়ী করতে হেফাজত-কওমী তথা ইসলামিস্টদের সাথে নিয়ে চলতে শুরু করেছে। অনেকে আবার বিষয়টিকে এভাবেও বলতে পারেন, ক্ষমতার সেই বিখ্যাত নিয়মটিই মানছে আওয়ামিলীগঃ ‘কিপ ইওর ফ্রেন্ডজ ক্লোজ, বাট ইওর এনিমিজ ক্লোজার।’