পুতুলনাচ এক প্রাচীন বিনোদন মাধ্যম। নেপথ্যে একজন বা একাধিক লোক থাকেন যারা এই পুতুলদের মাধ্যমে বিভিন্ন গল্প, গান ইত্যাদি তুলে ধরেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পুতুলনাচ প্রাচীন শিল্পকলার অংশ। বিয়িং জন মালকোভিচ ফিল্মে পুতুলনাচ গুরুত্বপূর্ন একটি বিষয়। মানুষের আত্মপরিচয় সম্পর্কে প্রশ্ন, তার চিন্তার স্বাধীনতা-পরাধীনতা কিংবা আত্মার অস্তিত্ব ইত্যাদি নানাবিধ দার্শনিক প্রশ্ন ছুঁয়ে যাওয়ার দরুন এটি অন্যতম একটি দার্শনিক ফিল্ম হিসেবে খ্যাত।
ফিল্মের প্রধান চরিত্র ক্রেইগ শোয়ার্জ একজন পাপেটিয়ার। সে পুতুল নাচায়। পুতুল নাচানো তার নেশা। কিন্তু দর্শকেরা তার পুতুলনাচ খুব একটা পছন্দ করে না ফলে সে অসফল একজন পুতুলনাচক। প্রথমেই দেখা যায় সে পুতুলের মাধ্যমে তার অবস্থা, ফ্যান্টাসী ইত্যাদি ফুটিয়ে তুলে। তার পুরুষ পুতুলের মুখও তার মতো। মূলত এই পুতুলের মাধ্যমে সে নিজেকেই উপস্থাপন করে।
লেখালেখি বা ক্রিয়েটিভ রাইটিং নিয়ে এমন একটি কথা বলেছিলেন কমেডি রাইটার এবং চলচ্চিত্র পরিচালক মেল ব্রুকস –
‘‘Every human being has hundreds of separate people living under his skin. The talent of a writer is his ability to give them their separate names, identities, personalities, and have them relate to other characters living with him.’’
সব ধরনের শিল্পীই এই কাজ করেন। মানুষের চেতনার বাইরে আর তার অস্তিত্ব আছে কি?
যাইহোক, পুতুলনাচকে শোয়ার্জ মনে করে আরেকজনের ভেতরে প্রবেশ করে তার মতো দুনিয়া দেখা, অনুভব করা।
আবার কনশাসনেস তথা চেতনা নিয়ে শোয়ার্জের খেদোক্তি হলো-
চেতনা একটা অসহ্য অভিশাপ। আমি চিন্তা করি, অনুভব করি, তাই আমাকে ভুগতে হয়।
পুতুল নাচে উপার্জন না থাকায় শোয়ার্জ একটা কাজ খুঁজে নেয়। এবং সেই অফিসেই এক গুপ্ত দরজা বা সুড়ঙ্গের সন্ধান পায়। ঐ সুড়ঙ্গ দিয়ে প্রবেশ করে জন মালকোভিচ নামক এক বিখ্যাত অভিনেতার ভেতরে প্রবেশ করা যায় পনের মিনিটের জন্য।
শোয়ার্জ অফিসে একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে। ম্যাক্সিন নামের সেই মেয়ের সাথে এই সুড়ঙ্গ পনের মিনিটের জন্য ভাড়া দেয়ার ব্যবসা শুরু করে। যে কোন লোক টাকা দিয়ে পনের মিনিটের জন্য হতে পারত জন মালকোবিচ। ফিল্মের নাম এখান থেকে।
বিয়িং মালকোভিচ বা মালকোভিচের ভিতরে প্রবেশ করার পর সে মানুষ কি মালকোভিচ হয় নাকী তার নিজের অস্তিত্ব প্রধান হয়ে উঠে? ঐসময়ে মালকোভিচের অবস্থান আসলে কি বা কে?
মালকোভিচের ভেতরে যারা প্রবেশ করে তারা মালকোভিচকে অনুভব করতে পারে। কিন্তু কেবলমাত্র দুজন লোক তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে দেখা যায়।
১। ক্রেইগ শোয়ার্জ
২। এই পোর্টাল তথা অন্য মানুষ (ভেসেল) এর ভিতরে প্রবেশ করে অমর হওয়ার পন্থা যার আবিষ্কার বা জানা; সেই ডক্টর লেস্টার
অন্য যারা মালকোভিচের ভেতরে প্রবেশ করেছে তারা মালকোভিচের অস্তিত্বের একটা অংশ বা অনেকটা দর্শকের মত হয়ে ছিল তাদের অবস্থান। শোয়ার্জের কনশাসনেসের শক্তি তাকে মালকোভিচকে নিয়ন্ত্রন করতে সাহায্য করেছে।
লেখক কাউফম্যান এ বিষয়ে বলেন, “আপনি আরেকজনের ভেতরে, কিন্তু ক্রেইগ মালকোভিচ হবার অনুভূতি পায় নি, সে মালকোভিচকে ব্যবহার করেছে। সে ম্যাক্সিনকে পেতে তাকে ব্যবহার করেছে, মালকোভিচকে ব্যবহার করে নিজের পাপেটিয়ার ক্যারিয়ার গড়েছে। তাই এটা হয়ে গেছে “জন মালকোভিচকে ব্যবহার”।
মালকোভিচের ভিতরে অন্যদের এই প্রবেশ করা, মালকোভিচের মতো অনুভব করার নানা ধরনের ব্যাখ্যা হতে পারে। এর একটি হলো সোশ্যাল মিডিয়া তথা ইন্টারনেটে নিজেকে উপস্থাপন। এখানে একটি আইডি রেজিস্টার করতে হয়। সেই আইডি পুতুলের ভূমিকা পালন করে। কম্পিউটারের পিছনে থাকেন একজন লোক। তিনি এই পুতুলকে নিয়ন্ত্রণ করেন। অতি অবশ্যই সোশ্যাল মিডিয়ার আইডি তথা পুতুলের সাথে কম্পিউটারের পিছনে বসে থাকা লোকটির অনেক পার্থক্য আছে। যেমন, পুতুলের সাথে পার্থক্য থাকে যিনি পুতুলের নেপথ্যে থেকে এর নাচ পরিচালনা করেন তার। শোয়ার্জের সাথে যেমন পার্থক্য ছিল তার মতো দেখতে তার পুতুলের।
সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে সেলিব্রেটিদের ফেইক আইডি তৈরী করে কিংবা ছেলে হয়ে মেয়ের কিংবা মেয়ে হয়ে ছেলের আইডি করে থাকেন। তাদের এই ভিন্ন রকম স্বত্তা হয়ে অনুভবের একটা সুযোগ তৈরী করে দিয়েছে এই ইন্টারনেট। যেটা বিয়িং মালকোভিচে দিয়েছে সেই পোর্টাল। ক্রেইগ শোয়ার্জের স্ত্রী মালকোভিচের ভিতরে যায় এবং বাইরে এসে তার মনে হয় সে বোধহয় ট্রান্সসেক্সুয়াল।
আরেকটি ইন্টারেস্টিং বিষয়, জন মালকোভিচ পোর্টাল দিয়ে প্রবেশ করে খালি নিজেকে দেখতে পায়। মানব চিন্তায় নার্সিসিজমের বা ‘আমাদের কনশাসনেসের বাইরে আমাদের কোন অস্তিত্ব নেই’ এর চমৎকার কিন্তু ডার্ক রূপায়ন বলা যায় একে।
আত্মপরিচয় বিষয়ক গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন আমি কে বা আমার কনশাসনেস কি ইত্যাদি তুলে আনলেও ফিল্মকে অন্যভাবে দেখা যায়।
বেশিরভাগ মানুষ অন্য ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মত বা চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। তার ঐ চিন্তকের মতো চিন্তা করতে করতে অন্য এক অনুভবে চলে যায়। এতে তারা আনন্দ পেলেও তার নিজের আত্মপরিচয় বা নিজস্ব চিন্তার বিলোপ হয় এর মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠান যেসব ইল্যুশন তৈরী করে রেখেছে সেগুলো নিজস্ব চেতনার শক্তি দিয়ে না বুঝতে পারলে মানুষের আত্মপরিচয় বা স্বাধীনতা বলতে কিছু থাকে না। যে স্বাধীনতার কথা সচরাচর বলা হয়, সেই স্বাধীনতার মধ্যেও নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকে। জিজেকের বলেন, “We feel free because we lack the very language to articulate our unfreedom.” এছাড়া, মানব জীবনে অবচেতনের নিয়ন্ত্রণ তো আছেই, তা নিয়ে ডেনিস ভিলেন্যুভের এনিমি একটি উল্লেখযোগ্য ফিল্ম।