কালকে চার্লি নামক মালায়ালাম ফিল্মটা দেখলাম। প্রচুর মাতামাতি দেখেছি এটা নিয়ে। দেখা শুরু করেছিলাম আগেরদিন। কিন্তু প্রায় ত্রিশ মিনিট দেখে বাদ দেই। পরে কাল আবার শুরু করি। কাহিনী শুরু হইতেই প্রায় ত্রিশ মিনিট, মানে আগ্রহ জাগাইতে। পরে আগ্রহ থাকল। কিন্তু নায়ক, নায়িকা কারো অভিনয়ই ভালো লাগে নাই। সেকন্ড নায়িকার অভিনয় ভালো লাগছে।
নায়ক নায়িকার অভিনয় যে ভালো লাগে নাই, তা তাদের অভিনয়ের দোষ কি না জানি নে, মনে হয় চরিত্রের আনরিয়েলিস্টিকতার জন্য। অবশ্য কাহিনীকার বা নির্মাতা এই দুইখান চরিত্রকে রিয়ালিস্টিকও করতে চান নাই। তবে আমার মনে হইল নায়ক আনরিয়ালিস্টিক হইতে গিয়া বেশী করে ফেলছে। মানে আমার মনে হইছে অতি অভিনয়। বিরক্তিকর।
ভালো অভিনয় লাগছে সেকন্ড নায়িকা, যে গলায় দড়ি দিয়া মরতে গেছিল। তবে এইখানেও বলতে হয় তার চরিত্রটা অনেকটা রিয়ালিস্টিক ধাঁচের। কাহিনীকারও তারে কিছু গম্ভীর গম্ভীর কথা ও ভাবভঙ্গী দিছেন।
অভিনয় সম্পর্কে ভালো লাগা ও মন্দ লাগার কথা বাদ দিলে, ফিল্মের জায়গাগুলার কথা বলতে হয়, সুন্দর। গানগুলাও ভালো। শুন্দরী পেন্ডে…ভাষাটাও বাংলার সাথে মিলে বলেই মনে হইল।
তবে, গল্প নিয়া ভাবি একটু, বা চার্লি ক্যারেক্টারটা নিয়া। তাহলে এই চরিত্রকে কেন এই অঞ্চলের দর্শক লাইক করল তা বুঝা যাইতে পারে।
আমরা বর্তমান যে সমাজে আছি তা হলো হাইলি কেরিয়ারিস্ট সমাজ। আমরা পড়ালেখা করি, বিসিএস গাইড পড়ি, চুল দাঁড়ি কামাইয়া, ফেইসওয়াশ, বডি স্প্রে মাইরা চাকরি খুঁজি বা একটা কেরিয়ার গড়তে চাই। কারণ আমাদের শেখানো হইছে এইটা। এইটাই আমাদের জীবন-যৌবন এখন, আমরা তীব্র প্রতিযোগীতায় ও আমরা ব্যস্ত। কারণ আমরা যদি ভালো কেরিয়ার গড়তে না পারি, তাইলে আমাদের জীবনের হইবে কী? শুন্দরী পেন্ডে কি পাবো আমরা? অতঃপর বাচ্চাকাচ্চা, যেই বৈবর্তনিক জেনেটিক এজেন্ডা আমাদের ভিতরে ভইরা দিছেন মাদার আর্থ (অথবা কোন ভীন গ্রহে কম্পিউটার গেইম খেলতে থাকা টিনেজ হ্যাকার), নিজেদের জিন ছড়াইয়া দেয়ার!
এই যে আমাদের কৃত্রিম এক প্রতিযোগীতায়, নকল এক চাকরী করা চাকর জীবনে ফেলে দিছে আধুনিক সমাজ, ক্যাপিটালিজম, তা কিন্তু আমাদের মানব প্রকৃতিতে ছিল না। আমরা ছিলাম সহযোগীতামূলক। শিকার কইরা আনতাম আমরা, সবাই মিলে খাইতাম। আমাদের ছিল কম্যুনিটি ভিত্তিক সমাজ।
কৃষিভিত্তিক সমাজ শুরু হইছে খুবই অল্পকাল আগে। মানব হিসেবে আমরা প্রায় ৯৫ ভাগ সময় কাটাইছি জঙ্গলে, শিকার ও সংগ্রহ সমাজে। কৃষিভিত্তিক সমাজ শুরু হইছে মাত্র ৫ ভাগ সময় জুড়ে, তাতেই এত পরিবর্তন হইছে। প্রযুক্তি, শ্রমবিভাগ, শ্রমিক ও মালিক। বড়ভাই, ছোট ভাই, চুদিরভাই নানা ভাগ ও বিভাজন।
আমরা পইড়া গেছি গো অন্য এক ধান্দায়। মানব জীবনের উদ্দেশ্য কিন্তু ছিল না এমন।
ফলে আমাদের ভিতরে একটা আকাঙ্খা আছে ঐ আদী জীবনের প্রতি। যে জীবন কেরিয়ারিস্ট না, যে জীবন কবির ভাষায় দোয়েলের ও ফড়িঙ এর। কিন্তু তা আমরা পাইব কোথায়?
চার্লি ফিল্মে পরিচালক আমাদের তেমনি এক জীবন দেখান চার্লির মাধ্যমে, অল্প অবশ্য। তারে দেইখা আমাদের ঐ ভিতরের আকাঙ্খা নিজেরে দেখে বলে আমাদের ফীল গুড হয়।
এমন জিনিস আমাদের দেখাইতেন হুমায়ূন আহমেদ হিমুর মাধ্যমে। মানে আমাদের অতৃপ্ত থাকা ইচ্ছাগুলিকে গল্পের মাধ্যমে তৃপ্ত করার চেষ্টা।
চার্লি দেখবেন ভ্লাদিমির লেনিনের কথা বলে, রোজা লুক্সেমবার্গের কথা বলে, ভি এস আচুতানান্দান এর কথা। এরা সবাই লেফটিস্ট, মার্ক্সিস্ট ধারার দার্শনিক-রাজনীতিবিদ, এবং পুঁজিবাদী সমাজের বিরোধীতা কইরা কাটাইছেন তাদের সারাজীবন। এরা সবাই মুক্ত জীবনের কথা বলতেন, তার জন্য কইরা গেছেন কাজ।
চার্লির কাছে এই নামগুলা পাওয়ারফুল, কিন্তু এই ভ্যাগাবন্ড পোলা এইসব নাম পাইল কোথায়? তখন ধইরাই নিতে হয় এদের সম্পর্কে সে জানে ও এদের দ্বারাই সে ইনফ্লুয়েন্সড।
লাইফস্টাইলে সে আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজরে ডিনাই করে।
যেসব দর্শক চার্লি দেখে, চার্লির বোহেমিয়ান ভ্যাগাভন্ডী জীবন, মানুষের প্রতি মমতা ইত্যাদি দেখে আহা উহু করতেছে, এরা কিন্তু জিন্দেগীতে আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজের বিরুদ্ধে যাবে না। নিদেনপক্ষে মার্কিস্ট বা স্পষ্টভাবে বললে এনার্কিস্ট চিন্তা নিয়ে ভাববে না। রোজা লুক্সেমবার্গের নাম তারা এই প্রথমবার শুনল অনেকে।
ফিল্ম দেখে তাদের ফীল গুড হবে, এবং এরপর তারা তাদের কেরিয়ারিস্ট জীবনেই মগ্ন হবে।
অবশ্য পরিচালকেরও ইচ্ছা ছিল না বিপ্লবী কোন ফিল্ম বানানোর। খুবই হালকা চালেই এন্টারটেইনিং ফিল্ম বানিয়েছেন তিনি। কিন্তু তার মাঝেও হালকা ভাবে রাজনৈতিক দর্শনটা আসছে নায়ক চার্লির, যা ইন্টারেস্টিং।
সমাজরে খুব বড় করে ক্রিটিক করতে যান নাই পরিচালক। কিছু কিছু খন্ড খন্ড গল্প আনছেন। মানুষের মানবিক জায়গাকে টাচ করতে চাইছেন ও বলতে চাইছেন, তোমাদের জীবন সুন্দর নয়, ভিতরে ভিতরে তোমাদের সহযোগীতামূলক এক মানবিক জীবন আকাঙ্খা আছে।
ফিল্মে চার্লি হচ্ছে সেই লোক, যে ভিন্নভাবে চিন্তা করে জীবন সম্পর্কে। টেসা এইখানে কেরিয়ারিস্ট জীবন থেকে পালানো একজন, চার্লি সম্পর্কে জেনে সে আগ্রহী হয়, সে বুঝতে পারে এই জীবন সে চায়।
চার্লির সাথে শেষদৃশ্যে দেখা যায় তা্রে, একটা ট্রাকে, সব্জী টব্জীর উপরে তারা শুইয়া আছে, মানে সে তখন চার্লির মতই মুক্ত জীবনে।
চার্লি ফিল্মের কাহিনীর দুর্বলতা হইল, চার্লির মানবিক অবস্থানের বাইরে আর কোন অবস্থান নাই। স্বস্তা কিছু জিনিস, চমক টমক, মানুষরে চমকে দেয়া ইত্যাদিতেই মগ্ন সে। অবশ্য সে একবার মারমুখী হয় ম্যারীর বাচ্চারে বাঁচাইতে তার বাপের হাত থেকে, ফলে তার বিপ্লবী স্বত্তা যে নাই তা না। কিন্তু কাহিনীকার তারে ফুটাইয়া তুলতে পারেন নাই, বা ইচ্ছা কইরাই তিনি তার চরিত্ররে পুরা দেখান নাই।
যাক, রিভিউ শেষ, এইবার শুন্দরী পেন্ডে ও পান্ডারা, চলেন এনার্কিজম সম্পর্কে একটু জানি। একটু চমস্কি পড়ি, একটু মার্ক্স, একটু রোজা লুক্সেমবার্গ। একটু সমাজ নিয়া ভাবি, ভাবি সমাজের শ্রেণীভাগ নিয়া। ভাবি নিজেদের লাইফ নিয়া, কীভাবে আমরা নিজেদের ও অন্যদের লাইফরে আরো মানবিক ও আনন্দময় কইরা তুলতে পারব, কীভাবে কেরিয়ারিস্ট ইঁদুর দৌড় থেকে বাইর হইতে পারব আমরা, কীভাবে আমরা হইত পারব সহযোগীতামূলক, ও ভাগ কইরা খাইতে পারব আমাদের সব হালুয়া রুটি।